নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
লেখার সাবজেক্ট খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল হাজি মদন আলীর কথা। হাজি মদন আলী সওদাগর, মদন হাজি নামেই যিনি সমধিক পরিচিত, একদা চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্যের জগতে যাঁর আবির্ভাব ধুন্ধুমার কান্ড ফেলে দিয়েছিলো, তিনি এখন একটি বিস্মৃত নাম। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে একটি অপ্রীতিকর ঘটনায় দুঃখনক মৃত্যু বরণের পর গত ৩৯ বছরের ব্যবধানে তাঁর স্মৃতি ক্রমান্বয়ে বিবর্ণ হতে হতে বিস্মৃতির গর্ভে তলিয়ে গেছে। যতদিন তিনি জীবিত ছিলেন, ততদিন দাপটের সাথে বিচরণ করেছেন, ভালো হোক মন্দ হোক মদন হাজির একটা ব্যবসাযিক সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিলো, তাঁর মৃত্যুর পর তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়েছেসেই সাম্রাজ্য। কারণ সাম্রাজ্য আগলানোর মত কোন রাজপুত্র ছিলো না।তাঁর আদম লিমিটেড, হাজি স্টোর্স, বাস, ট্রাক, কোচ সবই এখন অতীত। অপঘাতে মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভাগ্যলক্ষী তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে। মদন আলীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ বা শ্রেষ্ঠ উপহার তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র আলী আহমদ ভাই। এই ছেলেটিকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন, দ্বীপ কালারমোড়লের জাফর সওদাগরের পুত্র অধ্যাপক জাফর আহমদ মোস্তফা, গোরনাইনের সাহেব মিয়ার পুত্র রায়হান ফিরদাউস মধু সাঁইদাইরের, আনু মিয়া ডিলারের পুত্র আহমদ শরীফ মনীর এবং ওকন্যারা আবদুল হক প্রায় সমসময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। আলী আইমদ ভাই যথারীতি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড-খ্যাত দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে পিতার মুখ উজ্জ্বল করে ফিরে আসলেন। তারপর পিতা যে ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, সন্তানের বোধ হয় মনঃপুত্র হয়নি। পিতার ব্যবসা দেখাশোনা করতে তাঁর প্রবৃত্তি হয়নি, ফলে পিতার আকস্মিক অপমৃত্যুতে পিতার ব্যবসায়িক সিংসহাসনে বসার জন্য বোধ হয় আলী আহমদ ভাই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি দেখলেন না, অন্য ভাইরা তো ছোট, তখনো উপযুক্ত হয়ে উঠেনি। অতএব মদন হাজির কষ্টে গড়া ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে গেল। হাজি সাহেবের পুত্রকন্যাদের মধ্যে তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য রক্ষা করার যোগ্যতা কারো ছিলো না। শুনেছি মদন হাজির এক নাতি আলহাজ জামালউদ্দিন সুরুজ বর্তমানে তাঁর দাদার ধসে পড়া সাম্রাজ্য ঠেলে দাঁড় করাতে চাইছেন, জানি না তিনি কতটুকু সফলকাম হবেন। তাঁর চেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই।
মদন হাজি আমাদের পটিয়া এলাকার মানুষ। মদন হাজির পূর্বে শিকলবাহার বড় ব্যবসায়ী ছিলেন আছি মিয়া চৌধুরী। তিনি ছিলেন লঞ্চ ব্যবসায়ী এবং জমিদার। ভাগ্যলক্ষীর কৃপায় মদন আলীর ব্যবসা যখন রকেটের উপরে জ্ঞারে উঠছে তো উঠছেই, সেই সময় হঠাৎ আকাশ থেকে আছড়ে পড়েছিলেন তিনি। ১৯৮৬ খ্রিস্টাদের ২৮ মার্চ আনসারের গুলিতে তাঁর জীবন প্রদীপ নিভে যায়। এই ঘটনা তখন ব্যাপক আলোড়ন তথা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলো। মদন হাজির এমন পরিণতি কেউ ধারণা করতে পারেনি। তাঁর ইমেজ কিছুটা অপরিচ্ছন্ন ছিলো ঠিকই, কিন্তু আনসারের গুলিতে এভাবে তাঁর জীবন শেষ হয়ে যাক কেউ তা চায়নি। এই মৃত্যু ছিলো অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্খিত। ফলত নানা জল্পনা-কল্পনা পল্লবিত হয়ে উঠেছিলো মদন হাজির অপমৃত্যুকে ঘিরে। মিডিয়ায় অনেক দিন লেখালেখি হয়েছে। তিনি যে ব্যবসা করে সাফল্য অর্জন করেছিলেন, সেজন্য কিছু কৃতিত্বের হকদার তিনি হনই। কারো দয়ায় নয়, কৃপায় নয়, তিনি বড়লোক হয়েছিলেন কঠোর পরিশ্রম, বুদ্ধি আর মেধা খাটিয়ে।
পরিবহন ঠিকাদারি আর ট্রাক ব্যবসা খুব পরিচ্ছন্ন ব্যবসা নয়। তেল, মবিল, গ্রীজ, ধূলো-ময়লায় মাখামাখি হয়ে এই ব্যবসা করতে হয। সাফ সুতরো হয়ে ধোয়া ইস্ত্রি করা শার্ট প্যান্ট পরিহিত হয়ে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। পরিবহন ঠিকাদারি, ব্যবসা একথাগুলি মনে রাখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না মদন হাজি বড় হওয়ায় জন্য কী পরিশ্রমই না করেছেন। তিনি বড় হয়েছেন, বড়লোক হয়েছিলেন। অতি সাধারণ অবস্থা থেকে তিনি চট্টগ্রামের অন্যতম ধনী ব্যবসায়ীর মর্যাদা পেয়েছিলেন। আঙুল ফুলে কলাগাছ হননি, নিজের ভাগ্য নিজে গড়ে তুলেছেন। এই মদন হাজিকে সম্মান তো করতে হয়। তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানের আধিক্য নিয়ে মুখরোচক আলোচনা হয়। কিন্তু তাঁর বহুমুখী দান, শিক্ষা বিস্তার, সমাজ-উন্নয়ন পকেট উজাড় করে তিনি যে মানুষকে, সংগঠনকে অনুদান দিতেন, সে খবর রাখার গরজ কেউ অনুভক করেন না। ব্যক্তিগত জীবনের এসব দুর্বল দিক না ঘেঁটে তাঁর গুণের প্রতি নজর দিলে মানুষটাকে শ্রদ্ধা করার কিছু উপাদান খুঁজলে হয়তো পাওয়া যেতে পারে।
মদন হাজি জ্যাকপট মারেননি বা আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপও পাননি, তাঁর ধন সম্পদ, ঐশ্বর্য-সবই কষ্ট করে পাওয়া। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে পটিয়া থানার শিকলবাহা গ্রামে মদন হাজির জন্ম। পিতার নাম হাজী তালেব আলী, মাতা মাহমুদদা খাতুন। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি বার্মার সাথে চালের ব্যবসা শুরু করেন। পরে পরিবহন ঠিকাদারি, ট্রাক ব্যবসা এবং আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা করে তাঁর ভাগ্য খুলে যায়। আরো পরে বাস ও কোচ ব্যবসা শুরু করেন এবং দেশ জুড়ে তাঁর ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হয়। বর্তমানে পরিবহন ব্যবসার যে বিপুল বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেজন্য হাজি মদন আলী সওদাগরকে কিছু কৃতিত্ব দিতেই হয়। তাঁর হাতেই প্রথম এই ব্যবসায় গতি সঞ্চার হয় এবং আধুনিকতার ছাপ পড়ে।
স্বাধীনতার পর কে সি দে রোড হয়ে উঠলো পরিবহন ব্যবসার কেন্দ্র। বাকলিয়ার আবুল খায়ের সওদাগরের ভাই নূর মোহাম্মদ সওদাগর ইসলামিয়া হোটেল প্রতিষ্ঠা করলে সেটি চট্টগ্রামে পরিবহন ব্যবসার বিকাশে ব্যাপক ভ‚মিকা রাখে। হাজি মদন আলী সওদাগরের হাতে কে সি দে রোডের পরিবহন ব্যবসা ফুলে কেঁপে উঠে। তিনিই এই ব্যবসার হিরো। হাজি মদন আলী চলে গেছেন, কিন্তু চট্টগ্রামের ব্যবসা জগতে তিনি যে চমক সৃষ্টি করেছিলেন, নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন, সেটি অস্বীকার করা যাবে না। চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্যের ইতিহাস যদিকখনো লেখা হয়, হাজি মদন আলী সওদাগরের নাম সেখানে থাকবে। স্বাধীনতা উত্তর কালে ৭০, ৮০’র দশকের ব্যবসায়িক ইতিহাস থেকে মদন আলী সওদাগরের নাম ফেলে দেয়া যাবে না।
১৯৮৬’র ২৮ মার্চ বুধবার রাত সাড়ে নয়টা নাগাদ মেসার্স হাজী স্টোর্সের কে, সি, দে রোডস্ব নাইট কোচ বুকিং কাউন্টারে ম্যানেজার কামালউদ্দিনের সাথে নাইট কোচে কর্তব্যরত দু’জন আনসারের কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে হাজী স্টোর্সের স্বত্বাধিকারী মদন হাজী ও তাঁর পুত্র আবদুস সবুর কাউন্টারে উপস্থিত হলে আনসাররা আরো উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং এক পর্যায়ে রাইফেল থেকে পাঁচ রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। এতে মদন হাজী ও কামালউদ্দিন গুরুতরভাবে ধম হলে স্থানীয় লোকজন তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে পৌঁছার পর ডাক্তাররা কামালউদ্দিনকে মৃত ঘোষণা করেন এবং মদন হাজীকে অস্ত্রোপচারের জন্য অপারেশন থিয়েটারে পাঠান। দীর্ঘ তিন ঘণ্টা পর রাত ১২টা ৪০ মিনিটে ডাক্তাররা মদন হাজিকেও মৃত ঘোষণা করেন।
এদিকে গুলি ছোঁড়ার পর পরই আততায়ী আনসাররা পালিয়ে যায় এবং পুলিশ কন্ট্রোল রুমে গিয়ে আশ্রয় নেয়। গুলির পনের মিনিট পর কোতওয়ালী পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মেগার্গ হাজি স্টোর্সের নাইট কোচে কর্তব্যরত অপর দু’জন আনসারকে গ্রেফতার করে। পুলিশ পরে আততায়ী আনসার দু’জনকেও গ্রেফতার করে। এদের নাম মোস্তফা কামাল-১, মহিবুর রহমান, মোস্তফা কামাল-২ ও হযরত আলী। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে পটিয়া থানার শিকলবাহা গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতার নাম হাজী তালেব আলী, মাতা মাহমুদদা খাতুন। মদন হাজি সরিষার তেল কল ও লবণ ক্রাশিং কল মালিক সমিতি, ঢাকা-চট্টগ্রাম কোচ মালিক সমিতি ও আন্ত:জিলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি ছিলেন। বাস মালিক সমিতির সূত্রে দেশব্যাপী তাঁর যোগাযোগ ও পরিচিতি ছিল। তিনি আদম লিমিটেডের ম্যানেজার ছিলেন।
ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সাফল্যের পাশাপাশি তিনি সমাজসেবায়ও আত্মনিয়োগ করেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আর্থিক সাহায্য দিয়ে তিনি সমাজসেবায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি দুদ কামাল প্রাইমারি স্কুলের চেয়ারম্যান হন। তিনি হাজি ওমরা মিঞা হাই স্কুল, এ, আই চৌধুরী হাই স্কুল কার্যকরী কমিটির দাতা সদস্য এবং এ, আই চৌধুরী কলেজ গভর্নিং বডির ভাইস-চেয়ারম্যান, কোলাগাঁও হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও কালারপুল হাজী ওমরা মিঞা হাই স্কুলের সভাপতি এবং পটিয়া কলেজ গভর্নিং বডির সদস্য।
হাজি মদন আলী ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পর পর তিন বার শিকলবাহা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি পটিয়া উন্নয়ন কমিটিরও সভাপতি জমিয়তুল ফালাহর দাতা সদস্য। এছাড়া তিনি শিকলবাহা মাতৃসদন এবং শিকলবাহা বালিকা বিদ্যালয়ের জন্যে জমি দান করেছেন। তিনি লায়ন্স ক্লাবের ভাইস চেয়ারম্যান এবং হাসপাতালের দাতা। তিনি ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতি, পুলিশ ক্লাব, বন্দর রাইফেল ক্লাব, দক্ষিণ চট্টগ্রাম রেডক্রস সোসাইটির আজীবন সদস্য। তাঁর আর্থিক সাহায্য প্রায় বহু অনাথ মেয়ের বিয়ে সম্পন্ন হয়।
হাজিমদন আলী সওদাগরের তিন পত্নীর ঘরে ৮ পুত্র ১৩ কন্যা লাভ করেন। তাঁরা হলেন-পুত্র : ১। আলী আহমদ, ২। আবদুস সবুর, ৩। আব্দুল গফুর, ৪। আবদুল কাদের, ৫। আবদুল করিম, ৬। আবদুল মান্নান, ৭। ফজল করিম, ৮। শওকত আলী।
কন্যা : ১। নুর জাহান বেগম, ২। আছিয়া বেগম৩। আলতাজ বেগম৪। নাছিমা বেগম৫। মনোয়ারা বেগম৬। রোওশোন আরা বেগম৭। মিনা ইয়াছমিন৮। কামরুননেছা৯। শাহনেওয়াজ বেগম১০। জাহানারা বেগম১১। আঞ্জুমান আরা বেগম১২। রোজি আক্তার ১৩। আফরোজা বেগম।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জ্যৈষ্ঠ সাংবাদিক