পূর্বদেশ ডেস্ক
নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে আগেই, আগামিতে আর ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমে ভোট হবে না। আগের ইসির সময়ে কেনা প্রায় দেড় লাখ ইভিএমের তাহলে কী হবে? এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিন্তু ইভিএম প্রকল্পের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে ৯ মাস আগে।
প্রকল্প যেহেতু নেই, তাই এই বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম কোথায় কীভাবে রাখা হবে, কী করা হবে- সেই প্রশ্ন সামনে আসছে। কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, প্রকল্প কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ইভিএমগুলো বুঝে নেবে ইসি। আপাতত সেগুলো সংরক্ষণ করা হবে। এরপর কী হবে, তা কেউ জানে না।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘প্রকল্প তো শেষ। আর প্রত্যেকটা জিনিসেরই একটা লাইফটাইম রয়েছে। হাজার কোটি টাকার ইভিএমের ভবিষ্যত কী হবে এটা সময়ই বলবে’।ইসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হস্তান্তরের প্রস্তুতি গুছিয়ে রেখে অপেক্ষা করছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। এ সংক্রান্ত চারটি কমিটিও কাজ করেছে। কিন্তু সেই কাজে ধীরগতিতে আটকে আছে হস্তান্তর।
এমন পরিস্থিতিতে ইভিএম হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় কমিটিগুলোর কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য কমিশন সভা বা সমন্বয় সভা করার অনুরোধ জানিয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। খবর বিডিনিউজের
এএমএম নাসির উদ্দিন নেতৃত্বাধীন বর্তমান ইসি গত নভেম্বরে যোগ দিয়ে পাঁচ মাস পার করেছে। এরই মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের জোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। কমিশন বলেছে, আগামি সংসদ নির্বাচন প্রচলিত ব্যালট পেপার ও স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে হবে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও ইভিএমে ভোট প্রক্রিয়া বাতিলের সুপারিশ করেছে।
ইভিএমে ভোট না নিলেও দেড় লাখ ইভিএমের রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে প্রকল্প থেকে তা বুঝে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় গত ১২ জানুয়ারি নতুন ইসির দ্বিতীয় কমিশন সভায়।
নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সেদিন বলেন, ‘আমরা জরুরি ভিত্তিতে এটার দায়-দায়িত্ব বুঝে নেব, রক্ষণাবেক্ষণ করব। এসব ইভিএম আর ব্যবহৃত হবে কি হবে না, ভবিষ্যতে সে সিদ্ধান্ত হবে’।
সংস্কার কমিশনও ইভিএমের বিরুদ্ধে
নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিধান বাতিল করার সুপারিশ করেছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। বদিউল আলম মজুমদার নেতৃত্বাধীন সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হয়েছিল যে ছয় আসনে, তার ভোটার উপস্থিতির হার এবং ব্যালট পেপার ব্যবহার করা আসনগুলোর ভোটার উপস্থিতির হারের মধ্যে ‘উল্লেখযোগ্য পার্থক্য’ দেখা যায়। এ পার্থক্য নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও ভোটের হার নিয়ে সন্দেহ এবং বিতর্কের জন্ম দেয়।
ইভিএমের কার্যকারিতা নিয়ে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ ও আপত্তি উঠেছে। ইভিএম কেনা ও রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে আর্থিক অনিয়ম এবং বিপুল অর্থ অপচয়ের অভিযোগও ওঠেছে।
কমিশন বলেছে, ‘ইভিএমের এই সীমাবদ্ধতাগুলো বিবেচনায় নিয়ে এবং বিভিন্ন অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে বলা যায়, ইভিএম অনিরাপদ এবং স্বচ্ছ ভোটগ্রহণ পদ্ধতি নয়। এটি নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকে জটিল ও ব্যয়বহুল করে তোলে। এই বাস্তবতায়, আপাতত ইভিএম ব্যবহার পরিহার করার জন্য নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হচ্ছে’।
সিইসি এএমএম নাসির উদ্দিন ১১ জানুয়ারি সিলেটে স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচন ইভিএমের মাধ্যমে হবে না, এটা স্পষ্ট। আগামি জাতীয় নির্বাচন ইভিএমের মাধ্যমে করার কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই’।
ইভিএমের কী হাল
ইসি সচিবালয়ের অধীনে ইভিএম প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল। পরে ব্যয় না বাড়িয়ে মেয়াদ ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ায় সরকার। প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়ায় ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের জন্য ইভিএমগুলো হস্তান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেজন্য চারটি কমিটি করা হয়।
অচল ইভিএম শনাক্ত ও বিনষ্টকরণ, যাচাই বাছাই করতে একটি কমিটি; ওয়ারহাউজের ভাড়ার হার নির্ধারণ করে সুপারিশ করতে আহব্বায়ক কমিটি; প্রকল্পের যাবতীয় নথি ও মালামাল গ্রহণে কমিটি এবং ইভিএমের সোর্সকোর্ড, ক্রেডেনশিয়াল, কার্ড কাস্টমাইজেশনের যাবতীয় সরঞ্জমা গ্রহণে কমিটি।
জানা গেছে, বর্তমানে দেড় লাখের মধ্যে ৮৬ হাজারের মত ইভিএম প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে (বিএমটিএফ) সংরক্ষিত রয়েছে। প্রায় ৬২ হাজার যন্ত্র রয়েছে মাঠ পর্যায়ে। প্রায় ১,২০০ ইভিএম নির্বাচন কমিশন ভবনে রয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের ঝামেলায় ইভিএমের একটি বড় অংশই অকেজো হয়ে গেছে।
প্রকল্প পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান জানান, ৪৫ থেকে ৫০ হাজারের মত ইভিএম ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত নির্বাচনে ব্যবহারোপযোগী ছিল। ৬০-৭০ হাজার ইভিএম বিকল, তবে মেরামতযোগ্য। বাকিগুলো মেরামতযোগ্যও নয়।
বুঝে নিতে বিলম্ব কেন
মেরামতযোগ্য ও সচল ইভিএম সংরক্ষণ সংক্রান্ত কারিগরি কমিটির একটি সভা হলেও কাজের তেমন অগ্রগতি নেই। ওয়্যারহাউজ ভাড়ার হার নির্ধারণে গঠিত আহব্বায়ক কমিটি ইসি সচিবালয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। মালামাল, কম্পিউটার সামগ্রী, যানবাহন, সফটওয়্যার স্বত্ব ও প্রযুক্তি হস্তান্তর, গ্রহণ ও সংরক্ষণে গঠিত কমিটি তাদের সুপারিশ দিয়েছে, কিন্তু হস্তান্তর প্রক্রিয়া এগোয়নি।
ইভিএম সফটওয়্যার, সোর্সকোর্ড, ক্রেডেনশিয়াল গ্রহণে কমিটি তাদের কাজ অনেকটা এগোলেও মালামাল হস্তান্তর হয়নি।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘এসব যন্ত্রপাতি বুঝিয়ে দিতে দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে কাজ করতে হবে। এখানে কী কী আছে তার একটা তালিকা হতে হবে। মূল্য নির্ধারণের বিষয় থাকলে সেটা দেখতে হবে। কম্পিটেন্ট অথরিটি এটাকে অ্যাসেস করবে। অ্যাসেস করার পরে কোনটা কী, তার তালিকা হবে। যিনি নেবেন, ওই তালিকা ধরে বুঝে নেবেন’। এসব যন্ত্রের আয়ুষ্কাল ১০ বছর ধরা হলেও পাঁচ বছরের মাথায় অধিকাংশ ইভিএম অকেজোঁ হয়ে যায়। এসব যন্ত্রের আয়ুষ্কাল ১০ বছর ধরা হলেও পাঁচ বছরের মাথায় অধিকাংশ ইভিএম অকেজোঁ হয়ে যায়।
প্রকল্প পরিচালক যা বলছেন
ইভিএম প্রকল্প পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান বলছেন, সমস্ত প্রস্তুতি শেষ করে বুঝিয়ে দেওয়ার যত কার্যক্রম রয়েছে, সব তারা শেষ করেছেন। কমিশন যেভাবে চেয়েছে সেভাবে সব কিছু রেডি। কয়েকটি কমিটিও কাজ করেছে। কিন্তু কোনো কমিটি কাজ সম্পন্ন করেনি।
তিনি বলেন, ‘কমিশন মাঠ থেকে রিপোর্ট নিয়েছে, বিএমটিএফ- এ পরিদর্শনে গেছে। সোর্স কোড দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সার্ভারের ক্রেডেনশিয়ালও দিয়েছে, কমিশন নিজেদের মত চেইঞ্জ করে নিয়েছে। প্রিন্টিং মেশিন সব দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন প্রজেক্ট শেষ, বুঝে নেবেন। বুঝে নেওয়ার বিষয়টা উনাদের শেষ করতে হবে।
ইভিএমের দেড় দশক
২০১০ সালে ইভিএম চালুর পর স্থানীয় নির্বাচনেই তা ব্যবহার হচ্ছিল। এটিএম শামসুল হুদা কমিশন সিটি কর্পোরেশনে বড় পরিসরে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু সংসদ নির্বাচনে নিতে পারেনি। ২০১২ সালে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন ইসি আগের ইভিএমকে অনেকটা অকেজোঁ অবস্থায় ফেলে গিয়েছিল। তখন সিটি নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহার হোঁচট খায়। এরপর কেএম নূরুল হুদার কমিশন নতুন করে ইভিএম নিয়ে এগোয়। ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে দেড় লাখ ইভিএম কেনার প্রকল্প অনুমোদন পায়। আইন সংশোধন করে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে ছয়টি সংসদীয় আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়।
এসব যন্ত্রের আয়ুষ্কাল ১০ বছর ধরা হলেও পাঁচ বছরের মাথায় অধিকাংশ ইভিএম অকেজোঁ হয়ে যায়। সেগুলো মেরামতে বড় অংকের অর্থের সংস্থান আর পরে হয়নি। এর মধ্যেও কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন স্থানীয় সরকারের বেশিরভাগ নির্বাচন আয়োজন করে ইভিএমে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অন্তত দেড়শ আসনে ইভিএমে ভোট করার পরিকল্পনা ছিল ইসির। তবে কোভিড পরবর্তী সময়ে আর্থিক সংকটের মধ্যে আরও দুই লাখ নতুন ইভিএম কেনার প্রস্তাবে সরকার সায় দেয়নি। ফলে দ্বাদশ সংসদে ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা থেকে কমিশন সরে আসে।