নিজস্ব প্রতিবেদক
চট্টগ্রামের রাউজান ও রাঙ্গুনিয়া আসন থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্ষমতার জোরে তিন মেয়াদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ফজলে করিম চৌধুরী ও ড. হাছান মাহমুদ। ২০০৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল; পুরো সময় জুড়ে রাউজান ও রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রামরাজত্ব কায়েম করেন ফজলে করিম চৌধুরী ও ড. হাছান মাহমুদ। দীর্ঘ ষোল বছর ধরে ফজলে করিম চৌধুরী ও ড. হাছান মাহমুদের অবৈধ উপার্জনের বিপুল অর্থ আরব আমিরাতের আজমাইনে লগ্নি করেছেন নোয়াপাড়ার প্রবাসী জসিম উদ্দিন (প্রকাশ সিএনজি জসিম)।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, শুধু ফজলে করিম চৌধুরীর পনের শত কোটি টাকা দুবাইয়ের বিভিন্ন শহরে আবাসন ও ল্যান্ড ডেভেলপমেন্টে বিনিয়োগ করেছেন সিএনজি জসিম। এর মধ্যে আজমাইন শহরের সৌদি জার্মান হসপিটালের পেছনে চল্লিশ বিঘা জায়গা ক্রয় করেছেন সিএনজি জসিম। বিনিয়োগকৃত অর্থের পুরোটাই রাউজানের সাবেক সংসদ সদস্য ফজলে করিম চৌধুরীর। দীর্ঘ ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই শহরে ব্যবসা করছেন ফটিকছড়ির প্রবাসী রফিক আহমেদ। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রফিক আহমেদ বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করে আবাসনখাতে বিনিয়োগ করেছেন ফজলে করিম চৌধুরী ও ড. হাছান মাহমুদ। রাউজানের সিএনজি জসিম এই দুই আওয়ামী লীগ নেতার অবৈধ টাকা আরব আমিরাতের আজমাইনে বিনিয়োগ করেছেন।’
এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের ওমানে প্রবাসী বাংলাদেশীদের সংগঠন ওমান-বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের কয়েকজন নেতা ফজলে করিম চৌধুরীর অর্থ বিনিয়োগ সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন। তারা জানান, ড. হাছান মাহমুদ ও ফজলে করিম চৌধুরী বিদেশে অর্থ পাচার করে বিনিয়োগের জন্য কয়েকজন চিহ্নিত প্রবাসী ব্যবসায়ীর সাহায্য নিয়েছেন। তাদের সবাই প্রবাসে এক সময় শ্রমিকের কাজ করলেও অবৈধ অর্থ বিনিয়োগ করে বনেছেন ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অবৈধ অর্থ বিদেশে সরিয়ে নিতে সাহায্য করার প্রতিদান হিসেবে সিএনজি জসিমের ছেলে যোবায়েরকে সিআইপি (কমার্শিয়াল ইম্পর্ট্যান্ট পারসন) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে তদবির করেন ড. হাছান মাহমুদ।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার এক কর্মকর্তা জানান, ‘শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে সোনা চোরাচালানের বড় অংশই নিয়ন্ত্রণ করছিলেন ফজলে করিম ও ড. হাছান মাহমুদ। হাছান মাহমুদের ভাই খালেদ মাহমুদ ও এরশাদ মাহমুদ চট্টগ্রামের স্বর্ণ চোরাচালান ও হুন্ডি ব্যবসার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতেন – এমন তথ্য গোয়েন্দা শাখায় রয়েছে। আর ফজলে করিম চৌধুরীর হয়ে সোনা চোরাচালানের বিষয়টি দেখভাল করতেন তার ব্যক্তিগত সহকারী সুমন। সোনা চোরাচালানের রুট নিয়ন্ত্রণে এমইএস কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক জিএস, নগর আওয়ামী লীগ নেতা আরশেদুল আলম বাচ্চু ও পটিয়ার সাবেক সংসদ সদস্য, হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর ছেলে শারুনকে ব্যবহার করেছেন ড. হাছান মাহমুদ।’
দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন ফজলে করিম চৌধুরী। ফজলে করিম চৌধুরীর প্রত্যক্ষ মদদে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল দুর্নীতি ও অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে জানান, ‘গত ১৬ বছরে চট্টগ্রাম রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান কার্যালয়ের সব টেন্ডার এবং ইজারা নিয়ন্ত্রণ করতেন বিএনপি নামধারী মাফিয়া শাহ আলম, নগর আওয়ামী লীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর ও আইয়ুব আলী। এই তিনজনের সিন্ডিকেটকে মূলত শেল্টার দিতেন ফজলে করিম চৌধুরী।’
প্রসঙ্গত, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ২০০৮ সালের পর চট্টগ্রামের রাজনীতিতে শীর্ষ প্রভাবশালী হিসেবে আবির্ভূত হন। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে জলবায়ু তহবিলের অর্থ লোপাট করে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিলেন ২০১৫ সালে। ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র, শিপ বিল্ডিং ও ব্রেকিং শিল্পের ছাড়পত্রের নামে শতকোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন তিনি।
দেশ ছেড়ে কানাডায় পালিয়ে যাওয়া চট্টগ্রামের এক শীর্ষ শিল্পপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে জানান, ‘২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল; সরকারের প্রথম মেয়াদে সীতাকুÐের অধিকাংশ শিপব্রিকিং ইয়ার্ড নামে বেনামে দখলে নেন হাছান মাহমুদ ও তার সহযোগীরা। সীতাকুÐের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান (পরবর্তীতে সংসদ সদস্য) মামুনের দখলবাজির গডফাদার হিসেবে কাজ করেছেন ড. হাছান মাহমুদ।’
নিজের স্ত্রীর নামে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা খুলে জলবায়ু তহবিলের অর্থ আত্মসাৎ করেন ড. হাছান মাহমুদ। মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে ‘সোনার বাংলা’ এনজিও খুলে সেটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিজে ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজের স্ত্রীর নাম দেন। সেই প্রতিষ্ঠান জলবায়ু তহবিলের চব্বিশ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন ড. হাছান মাহমুদ। এ বিষয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করলে সেই প্রতিবেদনও ক্ষমতার জোরে সরিয়ে নেওয়া হয়।
প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সরকারের প্রথম মেয়াদে পরিবেশ ফান্ডে (জলবায়ু) বাংলাদেশ প্রচুর টাকা পেয়েছিলো। নয়টা এনজিও’র মাধ্যমে এসব টাকা বিতরণ করা হয়েছিলো, যার প্রত্যেকটির চেয়ারম্যান ছিলেন ড. হাছান মাহমুদ নিজেই।