হাকিমের হত্যাকান্ড ‘পরিকল্পিত’ তবে আসামি অজ্ঞাত

4

হাটহাজারী প্রতিনিধি

চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মদুনাঘাট ব্রিজের অদূরে পানি শোধনাগার সংলগ্ন এলাকায় দুষ্কৃতকারীদের এলোপাতাড়ি ছোড়া গুলিতে রাউজানের কথিত বিএনপি কর্মী ব্যবসায়ী আবদুল হাকিম (৪৬) গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হওয়ার ঘটনায় থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে বিষয়টি নিশ্চিত করেন হাটহাজারী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মনজুর কাদের ভ‚ঁইয়া। এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাতে রাউজানের বিএনপি কর্মী আবদুল হাকিমের স্ত্রী তাছপিয়া আলম তানজু হাটহাজারী মডেল থানায় মামলাটি দায়ের করেন।
ঘটনার প্রায় তিন দিন পর হাটহাজারী মডেল থানায় দায়ের করা হত্যা মামলার বাদী নিহত হাকিমের স্ত্রীর দাবি, ‘তার স্বামী মূলত একজন ব্যবসায়ী, তিনি রাজনীতিতে কিছু করে নাই’। এদিকে, গুলিবিদ্ধ হয়ে আবদুল হাকিম নিহত হওয়ার ঘটনার দিন রাতে আটক সন্দেহভাজন ৩ জনকে থানা পুলিশ ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে প্রেরণ করেছে।
নিহত আবদুল হাকিমের স্ত্রী তাছপিয়ার দায়ের করা হত্যা মামলায় সুনির্দিষ্ট কাউকে আসামি করা হয়নি। পাশাপাশি মামলার এজাহারে তিনি তার স্বামীকে বিএনপি নেতা বা কর্মী অথবা সমর্থক-কোনোটাই উল্লেখ করেননি। ওই এজাহারে তার স্বামীকে অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতিকারীরা পরস্পর যোগসাজশে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে বলে দাবি করেন। এছাড়া মামলার এজাহারে তাছপিয়া তার নিহত স্বামী আবদুল হাকিমকে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং তার গ্রামের বাড়িতে নিজের নামে হামিম এগ্রো নামে একটি ফার্ম এবং অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে এজাহারে উল্লেখ করেছেন।
জানা গেছে, নিহত ব্যবসায়ী আব্দুল হাকিম বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ অনুসারী হিসেবে পরিচিত এবং তিনি একজন কথিত বিএনপির কর্মী বা সমর্থক বলে লোকমুখে প্রচার হচ্ছে। পাশাপাশি তাকে রাউজান উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নে গতবছর ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বিএনপির সদস্য সংগ্রহ ও ফরম বিতরণসহ নানা অনুষ্ঠানে তার অংশগ্রহণের কিছু ছবি ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
এছাড়া এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরপর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, হাকিম দলের কোনো কর্মী নন। রিজভির এমন বক্তব্যে দলের নেতাকর্মীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
তবে দলে তার কোনো আনুষ্ঠানিক পদ ছিল না। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি ভেষজ পণ্যের ব্যবসা, গরুর খামার ও কর্ণফুলী নদী থেকে বালু উত্তোলনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি রাউজান উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের পাঁচখাইন এলাকার হাজী রাজা মিয়ার বাড়ির ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত আলী মদনের ছেলে। তিনি দুই মেয়ে ও এক ছেলের জনক ছিলেন।
মামলার এজাহারে সেদিনের ঘটনা বর্ণনায় জানা গেছে, গত ৭ অক্টোবর ব্যবসায়ী হাকিম তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হামিম এগ্রো ফার্ম দেখার জন্য বেলা ১১ টার সময় চট্টগ্রাম শহরস্থ পাঁচলাইশ থানাধীন জাতিসংঘ পার্ক এলাকা থেকে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে নিজস্ব প্রাইভেটকার (ঢাকামেট্রো-ঘ ১৬-০৯৪৯) যোগে রওনা করেন। সেখানে পৌঁছে খামার দেখাশোনা করে খামারের সকল কর্মচারীদেরকে প্রয়োজনীয় দিকনিদের্শনা প্রদান করে নিজ গ্রামের বাড়ি রাউজান উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের পাঁচখাইন হাজী রাজা মিয়ার বাড়িতে নিজের পৈত্রিক ঘরে যান। এরমধ্যে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে পুনরায় আবার হামিম এগ্রো ফার্মে উপস্থিত হয়ে কর্মচারী সোলায়মান ও ফুফাতো ভাই শুক্কুরের সাথে কথা শেষ করে বিকাল অনুমানিক ৫ টার দিকে চট্টগ্রাম শহরস্থ নিজ বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
এ সময় ফুফাতো ভাই শুক্কুরও সাথে ছিলেন। তাদের গাড়িটি হাটহাজারী উপজেলার মদুনাঘাট ব্রিজ অতিক্রম করে পানি শোধানাগারের সামনে পৌঁছালে ৩টি মোটরসাইকেলযোগে ৬ জন হেলমেট ও মুখোশ পরা অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতিকারী হাকিমের গাড়ির সামনে গতিরোধ করেন তাকে লক্ষ্য করে এলোপাতারি গুলি বর্ষণ করতে থাকেন। একপর্যায়ে দুষ্কৃতিকারীদের এলোপাতারি গুলির আঘাতে হাকিম গাড়িতেই লুটিয়ে পড়েন। গাড়ি চালক মো. ইসমাইল (৩৫) গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণে বাঁচার জন্য গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে মদুনাঘাট বাজারের দিকে চলে যান। ওই সময় হাকিমের ফুফাতো ভাই শুক্কুর দুষ্কৃতিকারীদের এলোপাতারি গুলির ভয়ে গাড়ির পেছনের সিটে লুকিয়ে থাকেন। পরবর্তীতে স্থানীয় লোকজন হাকিমকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে এভারকেয়ার হসপিটালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়।
কি কারণে এমন হত্যাকান্ড হতে পারে- প্রশ্নের জবাবে নিহত আব্দুল হাকিমের স্ত্রী ও হত্যা মামলার বাদী তাছপিয়া আলম তানজু বলেন, আমি কী বলব! আমার স্বামীতো রাজনৈতিক কিছু করে নাই। তিনি মূলত একজন ব্যবসায়ী। আমার স্বামী কারও সাথে কোথাও এমন কিছু করে নাই। ওই দিন সন্ধ্যার আগে গ্রামের বাড়ি থেকে শহরে ফেরার পথে তার গাড়ি থামিয়ে গুলি করে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের পরিবারের কারও সঙ্গে কোনো বিরোধ ছিল না। আমি শুধু এই হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচার চাই।
এদিকে, ঘটনার দিন রাতে রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া থেকে হত্যাকান্ডের ঘটনায় আটক করা হয় সন্দেহভাজন ৪ জনকে। এর মধ্যে ৩ জনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বৃহস্পতিবার ৫৪ ধারায় আদালতে সোপর্দ করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন হাটহাজারী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজী মো. তারেক আজিজ।
তিনজন হলেন রাউজান উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের গশ্চি ব্রাহ্মণহাট এলাকার নুরুল ইসলামের ছেলে মো. নাসিম (২৬), পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের বদু মুন্সির পাড়া রমজান আলির ছেলে মো. মহিউদ্দিন মহিন (২৩) ও একই এলাকার আরবান আলীর ছেলে আরফাত হোসেন (২২)।
অন্যদিকে, ঘটনার তিন দিন অতিবাহিত হলেও এখনও পর্যন্ত ঘটনার সাথে জড়িত সুনির্দিষ্ট কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। পাশাপাশি কি কারণে এই হত্যাকান্ড এবং হত্যাকান্ডের পেছনে কোন বিষয় কাজ করেছে তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে এখনও কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। যদিও পুলিশ বলছে, একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে।
হাটহাজারী মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) এবং মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোস্তাক আহম্মদ চৌধুরী জানান, সন্দেহভাজন হিসেবে আটককৃতদের যাচাই-বাছাই করে আদালতের মাধ্যমে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। হত্যার মূল কারণ এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে, আমরা সর্বোচ্চটা দিয়ে তদন্ত করছি। আশা করি, অস্ত্রধারীদের খুব শীঘ্রই শনাক্ত করা সম্ভব হবে।