হস্তশিল্পের প্রসার, অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার করতে পারে

2

রতন কুমার তুরী

এককালে হস্তশিল্প ছিল মানুষের রোজীরোজগারের বিরাট ক্ষেত্র। কালের বিবর্তনে শিল্প সমূহে মেশিন কিংবা যন্ত্রের দাপটে এ শিল্পটি তার স্বাভাবিক গতি হারায়। অনেক মানুষ এ পেশা ছেড়ে দিয়ে যন্ত্র শ্রমিকে যোগ দেয়। ফলে এ শিল্পের ক্ষেত্রটি আমাদের দেশে কিছুটা ছোট হয়ে যায়। অথচ হস্তশিল্পের এদেশে বিরাট সম্ভাবনা ছিল এবং বাইরের দেশেও এ শিল্পের বেশ চাহিদাও রয়েছে। হস্তশিল্পের ক্ষেত্র বিশাল।
মাঝে মাঝে বিভিন্ন মেলা এবং কিছু নির্দিষ্ট হস্তশিল্পের স্টলে হাতের তৈরি কিছু চমৎকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্র দেখা যায়। যা বাংলাদেশের সব শপিংমল কিংবা বাজারের দোকানগুলোতে তেমন একটা দেখা যায়না। এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষের মধ্যে রয়েছে তাতের তৈরি বিভিন্ন রঙবেরঙের শাড়ি, চাদর, ফুলদানি, কলমদানি, নকশি করা কাঁথা, কম্পিউটার কিংবা টেলিভিশন ঢাকনা দেয়ার কাভার, বিভিন্ন ডিজাইনের কারুকার্য খচিত ওয়ালমেট, হাতের বিভিন ডিজাইনের মোড়া, বাঁশের তৈরি খাট, বাঁশের তৈরি রসুই ঘরের বিভিন্ন তৈজষপত্রসহ আরো অনেককিছুই রয়েছে যার সবকিছুই কোন যন্ত্র ব্যতিত মানুষকে হাতের ছোঁয়ায় নান্দনিক হয়ে ওঠছে। এ ধরনের হস্তশিল্প দূর অতীতেও ছিল তবে তা বর্তমান সময়ের মত এতবেশি নান্দনিক ছিলনা। সময়ের সাথেসাথে হস্তশিল্পের ধারণা এবং ধরনও পাল্টেছে। একসময় হস্তশিল্প বলতে শুধুমাত্র হাতের তৈরি তাঁতের শাড়িকে বোঝানো হতো এখন কিন্তু হস্তশিল্পের ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় নান্দনিক অনেককিছুই এখন হাতে বানানো হয়।
বর্তমানে হস্তশিল্পের সবচাইতে বড় বাজার পার্বত্য চট্টগ্রাম। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এ তিন জেলার উপজাতীয়রা বাঁশ এবং বেত দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক জিনিষপত্র তৈরি করে তা বাজারে বিক্রি করে।
তাদের তাঁতের তৈরি থামি, চাদর, মেয়েদের পোষাক পাহাড়ে এবং সমতলে বেশ জনপ্রিয়। পাহাড়িরা এখন বাঁশ দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র তৈরি করছে যেগুলো শুধুমাত্র পাহাড়ে পাওয়া যায়। তিন পার্বত্য জেলায় যেহেতু প্রাকৃতিকভাবে বাঁশবাগান গড়ে ওঠে সেহেতু এ বাঁশলিল্পের সেখানে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। বাঁশের হাতের তৈরি খাট, চেয়ার, টেবিল, রান্না ঘরের বিভিন্ন তৈজষপত্রের বাজারে বেশ চাহিদা,রয়েছে। বাঁশশিল্পকে সরকারিভাবে পৃষ্টপোষকতা করলে এ শিল্প সমতলেও সমানভাবে জনপ্রিয়তা পাবে। হস্তশিল্প বিভিন্ন ধরনের আছে যেমন, তাঁতশিল্প, বাঁশশিল্প, বেতশিল্প, সেলাইশিল্প ইত্যাদি। বেতশিল্প একসময় বেশ জনপ্রিয় ছিল। বেতের হাতে গড়া শিতল পাটির খ্যাতি ছিল দেশজুড়ে। এ বেত একসময় পুরো সিলেট জেলায় জন্মাত এবং সেখান থেকে বেত সংগ্রহ করে শিতল পাটি তৈরি করে সারা দেশে বিক্রি করা হতো। বর্তমানে প্লাটিকের বেত বানিয়ে পাটি তৈরি করা হয় বিধায় সিলেটের শিতল পাটির কদর কিছুটা কমেছে। তবে বেত হস্তশিল্পটাকেও পৃষ্টপোষকতা দিলে এটিরও সম্ভাবনা প্রচুর। হস্তশিল্পের মধ্যে আরেকটি অন্যতম লিল্প হচ্ছে কাঠশিল্প। বড়বড় কাঠকে হাতে খোদাই করার মাধ্যমে বিভিন্ন অবয়ব সৃষ্টির মাধ্যমে দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলার মাধ্যমে মানুষের নজর কাড়ছে। কাঠ খোদাই শিল্প অতিপ্রাচিন হলেও এদেশে এটির প্রসার তেমন করে ঘটেনি। এটি এখন শুধুমাত্র খোদাই শিল্পিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ । এ কাঠ খোদাই লিল্পকে চারিদিকে ছড়িয়ে দিতে হবে এবং এটির প্রচারোরও ব্যবস্থা করতে হবে। যন্ত্রচালিত বিভিন্ন শিল্পের পাশাপাশি হস্তশিল্পকেও সমানভাবে প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে হস্তশিল্পের সুদিন ফিরে আসবে।
প্রকৃতপক্ষে যান্ত্রিক শিল্পের এ পৃথিবীতে টিকে থাকলে হলে যন্ত্রশিল্পের সাথে হস্তশিল্পকে টেক্কা দিতে হবে। হস্তশিল্পে আনতে হবে আধুনিকতার ছোঁয়া। যে আধুনিকতার ছোঁয়া হবে অত্যন্ত যুগোপযোগী ফলে হস্তশিল্প হয়ে ওঠবে সব মানুষের প্রিয়। তবে সবমানুষ যদি নিজ থেকে উদ্যেগী হয়ে হস্তশিল্পের জিনিষপত্র সমূহ কেনে তাহলে হস্তশিল্পের চাহিদা দিনদিন বাড়বে এবং এর বেচাকেনাও বাড়বে। আমরা একসময় গ্রামেগজ্ঞে হস্তচালিত তাঁত বোনার কাঠের যন্ত্র দেখতাম যা কুঠিরশিল্পে ব্যবহার হতো সভ্যতা ক্রমেই এসব কাঠের যন্ত্রকে গ্রাস করে নিচ্ছে। কাঠের তাতের যন্ত্রের স্থলে এখন আধুনিক ইলেক্ট্রিক মেশিন স্থান করে নিয়েছে। তবুও এদেশে তিন পার্বত্য জেলায় এখনও হস্তচালিত কাঠের কল দেখা যায়, যেগুলো দিয়ে এখনও তারা বিভিন্ন ধরনের কাপড় বোনে। পাহাড়ের অধিবাসিরা এখনও হস্তশিল্পের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে সেরূপ আমাদেরকেও হস্তশিল্পের প্রতি যত্নবান হতে হবে। একেবারে কিছু করতে না পারলেও পাহাড়িদের মত অন্তত নিজেদের পরনের কাপড়গুলো অন্ততপক্ষে হস্তশিল্প দ্বারা নিজেরাই বানানোটা শিখতে হবে তবেই পরিবারে অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়বে এবং নিজেদের দেশী জিনিষপত্রেও কদর বাড়বে। আমরা সকলেই যদি সম্মিলিতভাবে হস্তশিল্পের প্রসারের জন্য কাজ করি তাহলে এর সুদিন ফিরতে সময় লাগবেনা। বর্তমানে ঘরের সুন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য প্রতিটি জিনিষপত্রই হস্তশিল্পের মাধ্যমে নান্দনিক করা যায়। দেশের সৌখিন মানুষদের বাড়িতে এমন হস্তশিল্পমন্ডিত অনেক জিনিসপত্র দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে হাতের যেকোনো কাজকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হলে কিছুটা প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। সে প্রশিক্ষণশালাগুলো পুনঃজাগরণ প্রয়োজন। সে প্রশিক্ষণশালা থেকে স্বল্প মেয়াদি প্রশক্ষণ গ্রহণ করে একজন মানুষ সহজেই হস্তশিল্পী হতে পারে। মুলতঃ হস্তশিল্পের সুদিন ফেরাতে হলে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে পৃষ্ঠপোষকতা খুবই জরুরি। আর্থিক সামর্থ্য না থাকলে হস্তশিল্প এগিয়ে যেতে পারবেনা। দেশের বিভিন্ন জায়গায় হস্তশিল্পের যে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে সেসব জায়গা সমূহ চিহ্নিত করে তাদের আর্থিকভাবে সহায়তা প্রদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মুলতঃ হস্তশিল্পের প্রসার বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার করতে পারে।
আমরা প্রত্যাশা করবো সরকার হস্তশিল্পের সুদিন ফেরাতে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার করতে বিষয়গুলো চিন্তা করবেন এবং যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন।

লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক