হর্নের উচ্চমাত্রার শব্দ নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিন

2

কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম

সেদিন যানজটে পড়ে একটি স্টেশনে থামাতে হলো আমাদের বহনকারী সিএনজি অটোরিকশা। এসময় আশেপাশের গাড়িগুলো যেভাবে হর্ন বাজাচ্ছিল তাতে মনে হচ্ছিলো এক্ষুণি কান নষ্ট হবে! এভাবে প্রতিদিন অযৌক্তিকভাবে হর্নের উচ্চমাত্রার শব্দ যে কত মানুষের শ্রবণশক্তি কমাচ্ছে বুঝা মুশকিল। পাশাপাশি প্রায় সব গাড়ির হর্নের শব্দসুরও বেশ কর্কশ! শুনতেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। এমনিতেই হর্নের জ্বালা তার উপর কর্কশ এসব সুর চরম বিরক্তির উদ্রেক করে। প্রতিবাদ করলেও কোন কাজ হয়না। উলটো নিজের সম্মান নিয়ে সটকে পড়তে হয়। অনেকসময় হর্নের উচ্চমাত্রার শব্দে একজায়গায় স্থির হয়ে, শান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকাও সম্ভব হয়না। এমন অবস্থা! কোন কোন সময়তো হর্ন দেওয়ার প্রতিযোগিতা চলে। কে কত উচ্চে হর্ন বাজাতে পারে! কিছুদিন আগে ঢাকার নির্দিষ্ট কিছু সড়কে হর্ন বাজানো নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ নেয়া হলেও চালকরা সেসবের কোন তোয়াক্কা করছেনা। কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই।
অনিয়ন্ত্রিত ঝাঁঝালো হর্নের শব্দে প্রতিদিন সড়কগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। এ থেকে মুক্তির যেন কোন পথ নেই!
মানতেই হবে, দেশে যানবাহনের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এর যৌক্তিক কারণও রয়েছে অবশ্য। বাড়ছে মানুষ, তাদের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে যানবাহন। যে কারণে প্রতিদিন সড়ক, মহাসড়কে ঢুকছে অসংখ্য নতুন নতুন যানবাহন। কিন্তু যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে হর্নের মাত্রাও। হর্নের উচ্চমাত্রার শব্দে পথচলা দায়।
জরিমানার বিধান থাকলেও হাইড্রোলিক হর্নের শব্দের দূষণ বেড়েই চলেছে। এর আগে হাইকোর্ট গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু তারপরও এই অপতৎপরতা কমেনি। বরং ক্ষেত্রবিশেষে আইনকে বৃদ্ধাংগুলি দেখানোর প্রবণতা দেখা গেছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, শব্দ দূষণ যেকোন মানুষের জন্য ক্ষতিকর হলেও এতে শিশুরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়াও ট্রাফিক পুলিশ, রিকশা বা গাড়ি চালক, রাস্তার নিকটস্থ শ্রমিক বা বসবাসকারী মানুষ অধিকহারে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে গাড়ির হর্নের ঝাঁঝালো শব্দে। মানুষের শ্রবণ সীমার স্বাভাবিক মাত্রা ৪৫ ডেসিবল। যার বেশি হলে শব্দ দূষণে পরিণত হয় যা মানুষের শরীরে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শব্দ দূষণের ফলে মানুষের শ্রবণ ক্লান্তি এবং সর্বশেষ বধিরতা পর্যন্ত হতে পারে।
এছাড়া যে সকল রোগ হতে পারে তার মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ,কণ্ঠনালীর প্রদাহ, আলসার, মস্তিষ্কের রোগ, কাজ করার ক্ষমতা হ্রাস, বদমেজাজ বা খিটখিটে মেজাজ, ক্রোধ প্রবণতা, স্নায়বিক দুর্বলতা, রক্তনালীর সংকোচন এবং হার্টের সমস্যা অন্যতম।
ভুক্তভোগীদের মতে, শব্দ দূষণের ফলে তারা বিভিন্ন সমস্যায় পড়ছেন প্রতিদিন। হঠাৎ করে হর্ন বাজানোর ফলে অনেকেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। শব্দ দূষণ সমস্যার নামমাত্র জরিমানা থাকলেও তাও মানা হচ্ছেনা। যে কারণে শব্দ দূষণকারীরা আরো উৎসাহ পাচ্ছে। শব্দ দূষণ তথা গাড়ির হর্নের আওয়াজ নিয়ন্ত্রণে দ্রæত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি কঠোর আইন ও জরিমানার পরিমাণ বৃদ্ধির ব্যবস্থা এবং তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। চালকদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
বহির্বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে হর্ন বাজানোর ব্যাপারে কঠোরতা রয়েছে। সেখানে হর্নের যন্ত্রণা নেই। এত গাড়ি চলে অথচ বিরক্তিকর হর্ন নেই!
শহরে শব্দ দূষণের অন্যতম কারণ গাড়ির হর্ন। বিশেষত যানজটে আটকে থাকার সময় গাড়িচালকদের অযথা হর্ন বাজানোর কারণে অনেক বেশি শব্দ দূষণ হয়ে থাকে। অথচ শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রশাসনিক এলাকা ইত্যাদি নিরব এলাকা। তা সত্তে¡ও এসব এলাকায় মানমাত্রার থেকে দ্বিগুণের বেশি শব্দ উৎপন্ন হচ্ছে। যানবাহনজনিত শব্দদূষণ কমাতে গাড়িচালকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে প্রতি পাঁচজনে একজন কানে কম শোনেন। যাঁরা কানে কম শুনছেন, তাঁদের ৮০ শতাংশ নি¤œ ও মধ্যম আয়ের দেশে বাস করেন। এই সচেতনতার জন্য বিভিন্ন দেশ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদেরও তেমন উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া রোধে বৈশ্বিকভাবে আলোচনা হচ্ছে এবং বিশ্বব্যাপী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। নীতি প্রয়োগ ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে আমাদের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
হর্নের জন্য আমাদের ধৈর্য কমে যাচ্ছে। অকারণে হর্ন বাজানো প্রাপ্তবয়স্কদের কানে কম শোনার বড় কারণ। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যেন শব্দদূষণ থেকে বাঁচতে পারে, তার জন্য কাজ করতে হবে। অকারণে হর্ন বাজানো বন্ধে নীতিমালা বাস্তবায়ন ও জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। নিয়মিত শ্রবণশক্তি পরীক্ষা করতে হবে। আশা করি এ ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ শব্দদূষণমুক্ত জাতি হিসেবে ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও পরিবেশ অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে পরিচালিত অভিযানকে গতিশীল করতে হবে। মূলত সচেতনতা ও আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে গাড়ির হর্ন নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ বিভিন্ন জরুরি স্থানে হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ করতে হবে। গাড়ি চালকদের মাঝে শব্দ দূষণের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। জনগণের মাঝেও সচেতনতা বাড়াতে হবে। সকলেই যদি সচেতন হয় তাহলে শব্দ দূষণ তথা গাড়ির হর্ন নিয়ন্ত্রণ কঠিন কিছু হবে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আহবান হর্নের উচ্চশব্দে বন্ধে নজরদারি বাড়ান। পাশাপাশি আমাদের সকলের সহযোগিতা, সচেতনতাও এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট