সোহেল মো. ফখরুদ-দীন
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা উপজেলায় অবস্থিত বটতলী। এখানেই হযরত শাহ মোহসেন আউলিয়ার দরবার শরীফে চিরনিদ্রায় শায়িত আধ্যাত্মিক সাধক হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহঃ)। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের এক প্রখ্যাত অলী ও ইসলাম প্রচারক।
‘ দ্বীন ইসলামের মিশনারি /
প্রচারে কোরআন হাদিসের বানী/
দেশ সমুদ্র নদী পার হয়ে – এলেন বঙ্গ মাটি ধরি/
শাহ মোহসেন, শাহ বদর, শাহ চাঁন্দ অলি /
চট্টগ্রামে জিন ভুতের রাজ্য রাজত্বে /
আবাদ নিলো আগুনের বাতি আর মাটির ছড়ি/
আজানের আহবান – আল্লাহ আকবর /
শামিল হলো অলি পীরের দলে /
মানুষ ছিনলো দুনিয়া – আখিরাতে /
মোহসেন আউলিয়া আনোয়ারা সাগরতলে /
শাহ চাঁন্দ নিলো পাহাড় শ্রীমাই নদের কুলে/
বদর উদ্দিন – বদর আউলিয়া চাটগাঁ নিলো ; জিন ভুত তাড়ি /
মানুষের সমাগমে দ্বীনের ইসলাম, জাগ্রত হলো হলো কলমার ঈমান /
মুসলমান মিশনারি- মোহসেন, শাহ চাঁন্দ ও বদর আউলিয়ার বাড়ী ; হলো বিজয়ে ইসলামের পতাকা বাহী – রাসুলে খোদার বানী। ’
হযরত শাহ মোহসেন আউলিয়া ( রাহ 🙂 ৮৮৬ হিজরী, ১৪৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়ালে জন্মগ্রহণ করেন বলে ইতিহাস থেকে জানাযায় । হযরত বদর আউলিয়া (রহঃ) এর ভাগিনা হিসেবে তাঁর রূহানিয়াতের যাত্রা শুরু হয়, এবং মামা-ভাগিনার এই রূহানী সম্পর্ক ইসলামী ঐতিহ্যে বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়।
হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহঃ) ইসলামের আলো ছড়াতে সমুদ্রপথে চট্টগ্রামের উপক‚লে আগমন করেন। কিংবদন্তি অনুসারে, তিনি তাঁর মামা হযরত বদর আউলিয়ার (রহঃ) অনুগামী হিসেবে ঝিওরী গ্রামের শংখ নদীর তীরে অবস্থান নেন। সেখানে এক বোবা ছেলেকে কথা বলাতে সক্ষম হওয়ার অলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তির প্রমাণ মেলে। তাঁর ইচ্ছায় গ্রামবাসীরা সেখানে একটি ঘর নির্মাণ করে দেন যা পরবর্তীতে তাঁর সাধনাস্থলে পরিণত হয়।
৯৮৫ হিজরী, ১৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ৬ আষাঢ়ে হযরত মোহছেন আউলিয়া (রহঃ) ইন্তেকাল করেন এবং তাঁকে তাঁর সাধনাস্থলে দাফন করা হয়। শংখ নদীর ভাঙনের কারণে পরবর্তীতে স্বপ্নাদেশে তাঁকে স্থানান্তর করে বটতলী গ্রামে পুনরায় দাফন করা হয়। তাঁর ব্যবহৃত পাথরখানাও দরবার শরীফে সংরক্ষিত আছে।
আধ্যাত্মিক অলৌকিকতা ও কারামাত: হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহঃ) এর জীবনে বহু অলৌকিক ঘটনা রয়েছে। তাঁর কারামাতের অন্যতম উদাহরণ হলো বোবা শিশুদের মুখে বুলি ফোটানো। খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার জুলেখা ও বাঁশখালীর এক কিশোরীর মুখে তাঁর দরবারের তবারুক গ্রহণের পর বুলি ফোটে – এই ঘটনা প্রমাণ করে তাঁর রূহানিয়াত আজও জীবিত। তাছাড়া সাগরে ডুবে যাওয়া জেলে জুনু মাঝির মৃত্যুর মুখ থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া এবং তাঁর মান্নত পূরণ করার ঘটনাও হযরতের অলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণ।
দরবার শরীফের পরিচালনা ও ধর্মীয় শৃঙ্খলা : হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহঃ) এর দরবার শরীফ ইসলামী শরীয়তের পূর্ণ অনুসরণে পরিচালিত হয়। এখানে নারী জেয়ারতকারীদের জন্য পর্দা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয় এবং নামাজের সময় দরবারের প্রধান ফটক বন্ধ রাখা হয়। এই দরবার শরীফের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেন হযরতের তিন আওলাদের বংশধরদের দ্বারা গঠিত ‘দরগাহ পালা কমিটি’, যাদের নেতৃত্বে রয়েছেন তিনজন মতোয়াল্লী। এ দরগাহ কমিটি মোগল আমলে প্রাপ্ত ঐতিহাসিক “নবাবী সনদ”-এর উপর ভিত্তি করে পরিচালনা করে আসছে। যদিও বর্তমানে ঐ ১০ দ্রোন জমি ওয়ারিশদের নিয়ন্ত্রণে নেই, তবে সনদটি দরগাহ কমিটির কাছে সংরক্ষিত রয়েছে বলে জানাযায়, তবে আমি সন্ধান করেও পায়নি বা দেখেনি।
ইতিহাসের সাক্ষী চাটি প্রদীপ : চট্টগ্রাম শহরের নামের উৎপত্তির সাথে যে “চাটি” প্রদীপের ইতিহাস জড়িত, তা হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহঃ) ও হযরত বদর আউলিয়া (রহঃ) এর কেরামতের স্মারক। তাঁরা জ্বিন-পরীদের বিতাড়নের উদ্দেশ্যে চাটির আলো জ্বালিয়ে নির্দিষ্ট জায়গা আবাদ করেন। আজও দরবার শরীফে ঐতিহ্যবাহী চাটি জ্বালানো হয়, এবং চাটির তৈল রোগ মুক্তির উদ্দেশ্যে ভক্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়।
বিরূপ আচরণ ও তার পরিণতি : দরবার শরীফকে তিরস্কার করায় এলাকার পারকি গ্রামের এক ধনাঢ্য পরিবার পরিণতিতে মেয়েকে হারিয়ে বসে এবং পরবর্তীতে অলৌকিকভাবে মেয়েটির দরবারে ফিরে আসা তাদেরকে সত্য উপলব্ধি করায়। অবশেষে তারা দরবারের প্রতি ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং বিবাহ সম্পন্ন করে সম্মানের সাথে মেয়েটিকে তুলে দেয়। এমন অলৌকিক ঘটনা সমাজে ওলিদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে।
হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহঃ) ছিলেন ইসলামের এক নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক, যাঁর কারামাত, আধ্যাত্মিকতা ও মানবিকতা আজও মানুষের হৃদয়ে বিশ্বাস ও আশ্রয়ের প্রতীক। তাঁর দরবার শরীফ ইসলাম ও আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রস্থল হয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের অসংখ্য মানুষকে রূহানী শান্তি দান করছে। আল্লাহ পাক এই মহান অলির উসিলায় আমাদের জীবনকে বরকতপূর্ণ করুন। এক সময় এই প্রাচীন মাজারটি পাকা ও ছনের চাউনিতে তৈরি ছিল। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আলহাজ্ব এম. মনজুর আলম বহু টাকা ব্যয় করে একটি দৃষ্টিনন্দন মাজার ভবন তৈরি করে দেন। মাজার শরীফটি ২০২৪ সালে নতুন করে তৈরি করা মাজার শরীফ উদ্বোধন করা হয়। মাজার যাবার পথে একটি বড় গেইট রয়েছে। এই গেইটটি সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী ড. কর্নেল ( অব:) অলি আহমদ বীরবিক্রম তৈরি করেদেন। প্রতিদিন আনোয়ারা বটতলী রুস্তম হাট- হযরতশাহ মহোসেন আওলিয়া ( রাহ:) এর মাজার শরীফে হাজার হাজার লোক জিয়ারতে উপস্থিত হন। বার্ষিক ওরশে লক্ষ জনতা উপস্থিত হন। মাজার শরীফের ১/২ মাইল এলাকায় পাড়া মহল্লায় গরু ছাগল মহিশ জবেহ করে বিরিয়ানি রান্না করে ফাতেহা দেন। বাড়ীতে বাড়ীতে মেহমান আসেন। মাজার শরীফে লোকে লোকারন্য থাকে। ২০২৫ সালে শাহ মোহসেন আউলিয়ার ওরশ শরীফে বিনম্র চিত্তে তাঁকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।
লেখক : সভাপতি, মুসলিম হিস্ট্রি এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ
সম্পাদক, কিরাত বাংলা