হযরত শাহছুফি পেঠান শাহ (রহ.): জীবন ও কারামত

1

ড. নাছির উদ্দিন

হযরত শাহ ছুপি পেঠান শাহ (রহঃ) এর পিতার নাম মরহুম জিন্নাত আলী, মাতার নাম মরহুমা লাতু বিবি এবং পিতামহ’র নাম মরহুম মোহাম্মদ আলী। মরহুম মোহাম্মদ আলীর চার ছেলে ছিল। তাঁরা হলেন-মঈন উদ্দিন, গুরন আলী, এসন আলী, এবং জিন্নাত আলী। হযরত শাহ চুপি পেঠান শাহ (রহ.)’র নানার বাড়ি সাতকানিয়া উপজেলার ছদাহা ইউনিয়নে। হযরত শাহ চুপি পেঠান শাহ (রহ.) এই নিবন্ধের লেখকের (অধ্যাপক ড. নাছির উদ্দিন) পিতামহের আপন চাচাতো ভাই। মরহুম জিন্নাত আলী ও তাঁর পূর্বপুরুষের বাড়ী দক্ষিণ চট্টগ্রামের আধ্যাত্বিক রাজধানী-চন্দনাইশ থানার উত্তর কাঞ্চন নগর গ্রামে। হযরত জিন্নাত আলী চন্দনাইশের কাঞ্চন নগর গ্রাম হতে লোহাগড়া উপজেলার পদুয়া গ্রামে স্থায়ী হন। জীবদ্দশায় তিনি অসংখ্য কারামত দেখান। আমার জনামতে, বংলাদেশে জন্ম-গ্রহনকারী অন্য কোন আউলিয়া এত কারামত দেখাতে পারেন নাই। ভক্তবৃন্দ তাঁকে অলিকুল শিরোমনি নামে অভিহিত করেন। নি¤েœ তাঁর কিছু কারামতের অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হল।
গাছের উপর ছাই বসিয়ে মাছ ধরা: তাঁর মা একদিন মাছ ধরার জন্য ছাই বসাতে বললে, তিনি ছাইটি নদী, পুকুর, খাল বা বিলে না বসিয়ে গাছের উপর ছাই বসান। এটি দেখে মানুষ হাসাহাসি করেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে গাছ থেকে ছাইটি নামানোর পর ছাই ভর্তি মাছ দেখে তাঁর মা অবাক হয়ে যান।
মাত্র কয়েক মিনিটে লোহাগড়া থেকে রেঙ্গুনে- রেঙ্গুন থেকে লোহাগড়ায়: তাঁর বড় ভাই হামিদ আলী রেঙ্গুনে বসবাস করতেন। অনেকদিন তাঁর মায়ের সাথে যোগাযোগ না রাখায়, তাঁর মা চিন্তিত হয়ে কান্নাকাটি করতে থাকেন। তিনি মাকে বললেন একটি ভাতের মোছা দিতে। তিনি মোছা নিয়ে ঘরের চালে উঠে অদৃশ্য হয়ে যান। তিনি মোছাটি রেঙ্গুনে ভাইকে দিয়ে শুক্রবারের মধ্যে বাড়িতে আসতে বলেন। অল্পক্ষণের মধ্যে আবার বাড়িতে ফিরে আসেন। তাঁর কথা অনুসারে শুক্রবারে বড় ভাই বাড়িতে আসলে সাবাই বিশ্বাস করেন যে তিনি রেঙ্গুন গিয়েছিলেন। বাঘ তাঁর কথা শুনত: একদিন তিনি তাঁর মায়ের সাথে বাড়ির পূর্ব দিকে পাহাড়ে কাঠ আনতে গেলে বাঘের সামনে পড়েন। তিনি বাঘটিকে চলে যাওয়ার ইশারা করার পর বাঘটি চলে যায়।
বাঘের পিঠে চড়ে জঙ্গলে ভ্রমণ: তিনি বাড়ির পূর্ব দিকে বনে ধ্যান করতেন। ধ্যানকালে বনের বাঘ-ভাল্লুকসহ হিংগ্র প্রাণী তাঁকে পাহারা দিত। তিনি ইচ্ছা হলে বাঘের পিঠে চড়ে বন-জঙ্গল ঘুরে বেড়াতেন। কাঠ, বাঁশ ও অন্যান্য বনজ সম্পদ সংগ্রহকারীরা তা দেখে অবাক হয়ে যেতেন এবং লোকালয়ে এসে তা বলে দিতেন। পানির নিচে একটি ঘরে বসে গভীর ধ্যানঃ তিনি একদিন দুপুরে গোসল করতে নেমে অনেকক্ষণ পর্যন্ত উঠে না আসায় পরিবারের সদস্য ও ভক্তবৃন্দ চিন্তিত হয়ে পড়েন। একজন ডুবুরী (জলদাস) কে দিয়ে পুকুরের গভীরে তল্লাশি চালানো হয়। ডুবুরীর বর্ণনা অনুসারে- তিনি পানির নিচে একটি ঘরে বসে গভীর ধ্যানে মগ্ন আছেন।
জমিদার বাড়িতে কলেরাঃ তাঁর নাম ও খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় হিন্দু জমিদার ঈর্ষাকাতর হয়ে তাকে একটি বাড়িতে নিয়ে বন্দি করে নির্যাতন করে মেরে ফেলার উদ্যোগ নেয়। একসময় হঠাৎ জমিদার বাড়িতে কলেরা শুরু হলে, জমিদার তাঁকে মুক্ত করে দিয়ে ক্ষমা চান। আজও জমিদারের পরবর্তী ওয়ারিশগণ তাঁকে শ্রদ্ধার চোখে স্মরণ করে।
এই কাঁঠাল সেই কাঁঠাল: পাটিয়ার জিরি গ্রামের এক কৃষক একটি বড় কাঁঠাল নিয়ে তাঁর কাছে গেলে তিনি কাঁঠালটি পুকুরের এক কোণায় পুঁতে ফেলতে বলেন। এক বৎসর পর কৃষক আবার গেলে আগের কাঁঠালটি পুকুরে কোণা থেকে তুলে আনতে বলেন। কৃষক পুকুরের কোণা থেকে এক বৎসর পরে কাঠালটি তুলে আনেন টাটকা অবস্থায়
শীতল রোগ বিতাড়ন: তাঁর ছোটবেলায় এলাকায় শীতল রোগে গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া, হাঁস-মুরগী, গৃহপালিত পশুপাখির ব্যাপক হারে অকাল মৃত্যু ঘটে। এলাকার মানুষ দিশেহারা হয়ে যায়। তিনি নানা বাড়ির গোয়াল ঘরে এককোণায় প্রসাব করে বললেন- শীতল ব্যারাম (রোগ) আজ থেকে তাড়িয়ে দিলাম। সেই সাথে চলে যায় শীতল রোগ। আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় জানতেন অন্য এলাকার খবরঃ তাঁর বড় ভাই জনাব হামীদ আলী বার্মার রেঙ্গুনে বসবাস করতেন। আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বলে তিনি জানতেন যে তাঁর বড় ভাই সেখানে অত্যন্ত সুখে শান্তিতে আছেন। মায়ের সামনে বাঘ: তাঁর মা কোন এক কারণে কান্না করছিলেন। তিনি মায়ের সামনে একটি বাঘ এনে হাজির করেন। মাকে বাঘের ভয় দেখিয়ে তিনি কান্না করতে নিষেধ করেন। মা কান্না বন্ধ করলে তিনি বাঘটিকে চলে যেতে বললে বাঘটি চলে যায়।
উঁচু পাহাড় থেকে গভীর খাদে পড়েও অক্ষত তাঁর মাঃ তিনি মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় তাঁর মা একবার কাঠ সংগ্রহ করতে উঁচু পাহাড়ে উঠেন। দূর্ভাগ্যক্রমে তিনি গভীর খাদে পড়ে যান। সেখানে ছিল বিষাক্ত কাঁটা বন, ধারালো পাথরের টুকরা, বিষধর সরীসৃপের আবাসস্থল। আল্লাহর অশেষ রহমতে তাঁর মায়ের গায়ে একটি আঁচড়ও লাগে নাই।
কচু পাতার উপর দিয়ে খাল পার : তিনি কচুপাতর উপর ভর দিয়ে বাড়ির পূর্ব পাশের হাঙ্গর খাল পাড়ি দিয়ে বর্ষাকালে ধ্যান স্থানে যেতেন। জন্মের বৎসর এলাকায় প্রচুর শস্য উৎপাদিত: তাঁর জন্মের বৎসর এলাকায় প্রচুর শস্য উৎপাদিত হয়।
শ্রাবণ মাসে পুকুর খনন : একবার তিনি শ্রাবণ মাসে বাড়ির পুকুর খননের কাজ শুরু করেন। সে এলাকার চারিপাশে প্রচন্ড বৃষ্টিপাত হলেও, পুকুর খনন এলাকা ও তার চারপাশে কোন বৃষ্টিপাত হয়নি।
ইন্তেকালের পরের কারামত : মৃত্যুর পূর্বে তিনি বলেন, ‘আমার মৃত্যুর পর আমাকে গোসলসহ জানাযার নামজের জন্য যাবতীয় কার্য সম্পাদনের পর জানাযার ময়দানে নিয়ে অপেক্ষা করবে, উত্তর দিক থেকে এক ব্যক্তি এসে মৃদুস্বরে আমার জানাযায় অংশ গ্রহনের আহ্ববান জানাবেন। তিনি আমার জানযার নামাজ আদায় করে অদৃশ্য হয়ে যাবেন। তোমরা ভয় পেওনা। অতপর আমাকে বড়ভাই হামিদ আলীর কবরের বাম পাশে দাফন করবেন, যেন ব্যতিক্রম না হয়।’ তার মৃত্যুর পর জানাযার ময়দানে উত্তর দিক থেকে একব্যক্তি এসে মৃদুস্বরে সবাইকে জানাযার নামাজে অংশগ্রহনের জন্য আহবান জানিয়ে জানাযার নামাজ পড়িয়ে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়। এই দৃশ্য দেখে সকলে হঠাৎ হতবম্ভ হয়ে যায়।
চির বিদায় ও স্মরণ: আনুমানিক ১৮৮০ সালে জন্ম গ্রহন করেন এবং ১৯৪১ সালের ২ অক্টোবর (১৭ আশ্বিন, ১৯ রমজান) সোমবার ৬১ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। প্রতি বছর ১লা চৈত্র ও ১৭ আশ্বিন অলিকুল শিরোমনি হযরত শাহ ছুপি পেঠান শাহ (রহ.) এর ওরশ মোবারক অনুষ্ঠিত হয়। ভক্তবৃন্দ একত্রিত হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নামাজ আদায়, মাজার জিয়ারত, কুরআন তেলাওয়াত ও জিকির করে থাকেন।
লেখক: পূর্ব-পুরুষের আওলাদ, অর্থনীতিবিদ ও সমাজসেবক