নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গানকে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত করা হয়েছে। গোলাম আজমের ছেলে নাকি বলেছেনÑরবীন্দ্রনাথ হিন্দু, হিন্দুর লেখা গান কেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত
হবে ? তাহলে এটা কি ঠিক হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশ মুসলমানের দেশ, হিন্দুর দেশ নয়। কে ঠিক করলো, কখন ঠিক করলো। সেটা ঠিক করার অধিকার কে দিয়েছে?
পাকিস্তানের স্রষ্টা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও তো গণপরিষদের উদ্বোধনী ভাষণে বলেছিলেন-‘আজ থেকে আর আমরা কেউ হিন্দু নই, মুসলমান নই; আমরা সবাই পাকিস্তানি’। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের পর অবিভক্ত বাংলার মানুষ বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে গর্জে উঠে স্বদেশী আন্দোলন আরম্ভ করেছিলো। সেই আন্দোলনে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব বাঙালি অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেই আন্দোলনের সময়ে রবীন্দ্রনাথ ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি রচনা করেছিলেন। স্পষ্টতই আইয়ুব-মোনায়েমের প্রেতাত্মা তার কাঁধে ভর করেছে। আইয়ুব ৬১-তে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে বাধা দিতে চেয়েও পারেন নি। বটতলার উকিল মোনায়েম খাঁ তাঁর গৃহপালিত বুদ্ধিজীবীদের বলেছিলেন, তোমরা কি করো, রবীন্দ্র সঙ্গীত লিখতে পারো না। মুর্খ -মোনায়েম খাঁর মাথায় এটা ঢোকে নি যে তারা লিখলে সেটা তাদের গান হবে, কবিগুরুর গান হবে না। একাত্তরের দালাল চূড়ামণি গোলাম আজমের পুত্র কি বলতে চাচ্ছেন বুঝতে পারছি না। তাঁর পিতাও এমন কথা বলেননি।
আল্লামা ইকবালও তো হিন্দুস্থানকে ড়হি করে কবিতা লিখেছেন। তাই বলে তিনি কি হিন্দু হয়ে গেলেন? গোলাম আজমের ছেলে কি ইকবালের মুসলমানিত্ব খারিজ করে দিতে চান। ইকবালকে বাদ দিলে পাকিস্তানের থাকে কি। ইকবালই তো পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা, রহমত আলী অনেক অঞ্চলের আদ্যক্ষর নিয়ে চঅকওঝঞঅঘ শব্দ তৈরি করেছিলেন। আর বাংলার বাঘ এ কে ফজলুল হক ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ লাহোরে মুসলিম লীগের অধিবেশনে পাকিস্তান প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। জিন্নাহ সাহেব ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লি কনভেনশনে সোহরাওয়ার্দীকে দিয়ে সংশোধনী এনে ঝঞঅঞঊঝ শব্দকে ঝঞঅঞঊ না করলে বাংলা আলাদা রাষ্ট্র হত, পাকিস্তানের অংশ হত না। সোহরাওয়ার্দী সাহেব পরে তাঁর ভুল বুঝতে পেরে কিরণ শংকর রায়, শরৎ বসু ও আবুল হাশিমকে নিয়ে অখÐ বাংলা রাষ্ট্রের পরিকল্পনা পেশ করে বাংলা ভাগ রুখতে চেয়েছিলেন।
আল্লামা ইকবাল লিখেছিলেন
“সারা জাহাঁ সে আচ্ছা, হিন্দুসিতান হামারা
হাম বুলবুলে হ্যায় কি, ইহ গুলসিতান হামারা
গুরবত মেট হোন আগর হাম, রাহতা হ্যায় দিল ওয়াট্হান
মেন সামঝো উহিন হামেন ভি দিল হো জাহাঁ হামারা
……………………………………………..
মাহব নাহিন শিখাতা আপস মেন বাইর রাখা
হিন্দি হ্যায় হাম, ওয়াতহান হ্যায় হিন্দুসিতান হামারা
ইউনান ও-মিসর ও-রুমা, সব মিট গা’য়ে জাহাঁ সে
আব তাক মাগর হ্যায় বাকি, নাম ও-নিস্ন হামারা”
১৯১১-য় বঙ্গভঙ্গ রদ হলেও স্বদেশী আন্দোলনের পর পর ধর্ম পরিচয় ভুলে বাঙালি এক জাতি, এক সত্তা হয়ে খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন। সেই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন গ্রেট মওলানা শওকত আলী ও মওলানা মোহাম্মদ আলী ভ্রাতৃদ্বয়, মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু সিআর দাশ, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মতিলাল নেহেরু, জওহর লাল নেহেরু, মওলানা আবদুল্লাহেল কাফী, মওলানা আবদুল্লাহেল বাকী, বর্ধমানের ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, মওলানা আকরম খাঁ, আবুল হাশিম, চট্টগ্রামের দেশপ্রিয় জে এম সেনগুপ্ত, শেখ-এ-চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মওলানা আলী আহমদ ওলি ইসলামাবাদী, শাহ বদিউল আলম, লোকমান খান শেরওয়ানি, শিখ ধর্মগুরু কৃপাল দাস উদাসী, মহিম চন্দ্র দাশ, ত্রিপুরাচরণ চৌধুরী, তৎকালীন চট্টগ্রামের শীর্ষ ধনী আবদুল বারী চৌধুরী, নজির আহমদ চৌধুরী ও আবদুল গণি চৌধুরী প্রভৃতি সর্বজনমান্য নেতৃবর্গ। তাহলে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন হিন্দুর আন্দোলন ছিলো-একথা সত্য নয়। সুতরাং সেই আন্দোলনের জন্য রচিত গান ‘আমার সোনার বাংলা’। শুধু হিন্দুর গান ছিলো না, মুসলমান তথা সমগ্র বাঙালি জাতির গানই ছিলো।
জাতীয় সংগীত প্রসঙ্গে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব একটি হক কথা বলেছেন। গত ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার রাজধানীর উত্তরায় জেএসডির সভাপতির বাসায় অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ও মহানগরের সংগঠকদের এক সভায় তিনি বলেন, ’৭১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতার ইশতেহারে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের নামকরণ, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীতসহ মৌলিক প্রশ্নের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। এসব নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই।এসব মীমাংসিত বিষয়ের ওপর ভিত্তি করেই অগণিত আত্মত্যাগের বিনিময়ে ও রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। এ নিয়ে অহেতুক বিতর্ক জাতীয় অনুভূতি ও মননে আঘাত করে।
৬৯-৭০-৭১ খ্রিস্টাব্দের আ স ম আবদুর রবের মতই কথা বলেছেন ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের রব। ৭০-৭১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ছিলেন ডাকসুর সহ সভাপতি, বঙ্গবন্ধুর চার খলিফার অন্যতম খলিফা এবং ৭১ খ্রিস্টাব্দে গঠিত স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের শীর্ষ নেতা। তিনি একাত্তরের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। সেই রব স্বাধীনতার পরে জাসদ গঠনে নেতৃত্ব দেন এবং ৭৬-এ জাসদের রাজনৈতিক বিপর্যয়ের পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে জাসদ ভেঙ্গে ভেঙ্গে বাসদ এবং সর্বশেষ জেএসডি গঠিত হলে তিনি তার সভাপতি নির্বাচিত হন। ইতিমধ্যে তিনি একবার আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে সহযোগিতা করেও পরবর্তীকালে তিনি আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতির একজন প্রধান প্রবক্তা হয়ে উঠেন। এভাবে ৭০-এর অগ্নিবর্ষী নেতা রব হারিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যে একেবারেই ফুরিয়ে যাননি তারই প্রমাণ দিলেন ৮ সেপ্টেম্বর। আমাদের চট্টগ্রামে একটি কথা আছে- ‘খাল শুকিয়ে গেলেও রেক থাকে।’ ৮ সেপ্টেম্বর যে রবকে আমরা আবিষ্কার করলাম, তিনি চট্টগ্রামের প্রাচীন প্রবাদটাই মনে করিয়ে দিলেন। তবে আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিও তাঁরা দিয়েছিলেন, সে কথা রব ভাই বলেননি। তারা নিউক্লিয়াস থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে শেখ মুজিবকে উক্ত উপাধি দিয়েছিলেন। যদিও পল্টন ময়দানের জনসভায় ডাকসু’র ভিপি তোফায়েল আহমদই শেখ মুজিবকে আনুষ্ঠানিকভাবে উক্ত উপাধি প্রদানের ঘোষণা দেন। রব ভাইয়েরই একজন কনিষ্ঠ সহকর্মী রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক বঙ্গবন্ধুর জন্য উক্ত উপাধি উদ্ভাবন করেছিলেন। মুশতাকের বাড়ি চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার ভিংরোল গ্রামে। তিনি চট্টগ্রাম সমিতি-ঢাকার প্রথমে সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আশা করব রব ভাই পরবর্তী কোন এক সুযোগে বঙ্গবন্ধু উপাধি ইতিহাস বলবেন এবং এই উপাধিও যে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন সেটা সবাইকে মনে করিয়ে দেবেন। ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি মস্করা বা হাসিঠাট্টা করার বিষয় নয়।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সিনিয়র সাংবাদিক