নিজস্ব প্রতিবেদক
চট্টগ্রাম রেলওয়ের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী ও চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাব্বির ইকবালকে বদলি করা হয়েছে। গত ২৮ অক্টোবর (সোমবার) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পৃথক প্রজ্ঞাপনে এই দুই কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়। উপসচিব পদমর্যাদার দুই কর্মকর্তাই চট্টগ্রামে কর্মস্থল এমন দুই দপ্তরের দায়িত্ব পেয়েছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ মামুন শিবলী স্বাক্ষরিত পৃথক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী ও সরকারের উপ-সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা শাব্বির ইকবালকে বাংলাদেশ রাবার বোর্ডের উপপরিচালক করা হয়েছে। আরেক প্রজ্ঞাপনে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা ও সরকারের উপ-সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা সুজন চৌধুরীকে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে শাব্বির ইকবালের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। রেলওয়ের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তার পদে নিয়োগ পেয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড (রাঙামাটি) সদস্য মোহাম্মদ মাহবুবউল করিম।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রেলওয়েতে কর্মরত থাকাকালীন সময়ে সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ও রেলপথ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সাবেক সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর ঘনিষ্টজন হওয়ায় রেল অঙ্গনে ব্যাপক দাপট দেখাতেন সুজন চৌধুরী। তিনি রেলের টাকা লুটপাটে সাবেক এমপি ফজলে করিমের ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করতেন বলে সবার মুখে আলোচিত ছিলেন। সে কারণে তার বিরুদ্ধে কেউ টুঁ শব্দটিও করতে পারত না। আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালী দুই মন্ত্রীকে নিয়ম বহিভর্‚তভাবে জমি ইজারা, টেন্ডারে অনিয়ম, ভেলুয়ার দিঘির পাড়, আগ্রাবাদ ডেবা, শহীদ শাহজাহান মাঠসহ রেলওয়ের নানা স্থাপনা স্বার্থান্বেষী মহলের কাছে নীতিমাল না মেনে স্থানান্তরের অভিযোগ ওঠে সুজন চৌধুরীর বিরুদ্ধে। ইতোমধ্যে রেলপথ মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত অভিযোগও জমা পড়ে। এছাড়াও গত আগস্টে সরকার পতন আন্দোলন চলাকালে ছাত্রদের উপর হামলার পর তার অফিসে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতা-কর্মীরা অবস্থান নিয়েছিল। যা নিয়ে রেলে ব্যাপক আলোচিত হন।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে রেলওয়েকে জিম্মি করে রাখা আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর, দুই মাফিয়া-যুবলীগ ক্যাডার হেলাল আকবর বাবর ও এসএ কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান শাহ আলমকে নিরবচ্ছিন্নভাবেই অনৈতিক সুবিধা দিয়েছেন এই সুজন চৌধুরী। এই কাজে তিনি নিজেও হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল অংকের টাকা। এসব বিষয়ে ইতোমধ্যে দুদকে অভিযোগ জমা পড়েছে বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম জেলা পরিষদে সচিব ও প্রধান নির্বাহী পদে পৃথক মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন শাব্বির ইকবাল। তিনি দু’টি পদে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে জেলা পরিষদের রাজস্ব আদায়ে যুগান্তকারী ভ‚মিকা পালন করেন। পাশাপাশি জেলা পরিষদের ভ‚মি ব্যবস্থাপনাতেও আমূল পরিবর্তন আনেন। এই কর্মকর্তার নেতৃত্বে জেলা পরিষদে বিপুল পরিমাণ জায়গা উদ্ধার, বিভিন্ন স্থাপনা লিজ প্রদান, মার্কেট নির্মাণের মতো আয়বর্ধক প্রকল্প গ্রহণ করে জেলা পরিষদের আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নেন। প্রশাসনে সৎ ও আদর্শবান কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ২৪তম ব্যাচের এ কর্মকর্তা যেখানেই চাকরি করেছেন সুনাম অর্জন করেছেন। অনেকের ধারণা ছিল, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সৎ ও যোগ্য কর্মকর্তাদের যেভাবে মূল্যায়ন করছেন সে হিসেবে শাব্বির ইকবালকে ভালো কোনো পদে পদায়ন করা হবে। অথচ যে দপ্তরে বদলি করা হয়েছে সেখানেই ২৯তম ব্যাচের এক কর্মকর্তা সচিব পদে কর্মরত আছেন। মূলত সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারাই রাবার বোর্ডের উপপরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেন।
বদলি বিষয়ে জানতে চাইলে সদ্য বদলি হওয়া জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী শাব্বির ইকবাল কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রাম জেলা সমন্বয়ক ইমন মোহাম্মদ প‚র্বদেশকে বলেন, ‘সুজন চৌধুরীর সাথে আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীদের সাথে সখ্যতা ছিল। তাদের নাম ভাঙিয়ে নানা অপকর্ম করে বেড়াতো। এমনকি গত ৪ আগস্ট আন্দোলন চলাকালে সিআরবির ভেতরে সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিয়েছেন রেলের প্রধান ভূ-সম্পদ কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বদলে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে তাকে পুরস্কৃত করার বিষয়টি আমাদের জন্য দুঃখজনক। এই দোসরকে জেলা পরিষদের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় প্রধান নির্বাহী করা মানে, আমি মনে করি বীর চট্টলার শহীদ ওয়াসিম ও শহীদ তানভীরের রক্তের সাথে বেঈমানি করা। অতিদ্রæত এই দোসরের নিয়োগ প্রজ্ঞাপন বাতিল করতে হবে এবং ঐ জায়গায় স্থলাভিষিক্ত করতে হবে যাদের মেধা ও যোগ্যতা থাকা সত্তে¡ও আওয়ামী লীগের আমলে দীর্ঘ ১৭ বছর সুযোগ পায়নি তাদের।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের রাউজানের ঐতিহ্যবাহী কাগতিয়া মাদ্রাসার প্রধান ফটক দখল করে জেলা পরিষদের অর্থায়নে শহীদ মিনারের সীমানা প্রাচীর তৈরি বিষয়ে ফজলে করিমের অনুসারীদের অসহযোগিতা করেছিলেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাব্বির ইকবাল। আদালতের ১৪৫ ধারা জারি করা সত্তে¡ও চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ষড়যন্ত্রমূলক কাগতিয়া মাদ্রাসার প্রধান প্রবেশমুখ বন্ধ করে দেয়াল নির্মাণ করে এবিএম ফজলে করিমের অনুসারীরা। জেলা পরিষদের বরাদ্দ ব্যবহার করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধকতা তৈরির অভিযোগ পেয়ে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের বিল আটকে দেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাব্বির ইকবাল। বর্তমানে চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিজের ঘনিষ্ঠ লোক সুজন চৌধুরীকে বসিয়ে তারাই যেন প্রতিশোধ নিয়েছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের একদিন আগে (৪ আগস্ট) টাইগারপাসে সাবেক এমপি মহিউদ্দিন বাচ্চু তার অনুসারীদের নিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী ছাত্রজনতার উপর হামলা করার পর কর্মী বাহিনী নিয়ে সিআরবি রেল ভবনে সুজন চৌধুরীর দপ্তরে বসে চা নাস্তা করেন। রেল হতে লিজ ভ‚মিতে ফোর স্টার সিএনজি স্টেশনে অবৈধভাবে তালা ঝুলিয়ে দেন এই কর্মকর্তা। এছাড়া লিজকৃত বিভিন্ন নার্সারিকে নানাভাবে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ফোর স্টার সিএনজি পেট্রোল পাম্প মালিক আনোয়ার হোসেন বিষয়টি স্বীকার করেন।
গত ২৪ অক্টোবর চট্টগ্রাম বিভাগে রেলের অধীনে নরসিংদী জলাশয় ৫ বছরের জন্য লিজ প্রদানে টেন্ডার আহবান করে তা ফজলে করিম চৌধুরীর অনুসারীকে দেওয়ার চেষ্টা করলে তাতে ব্যর্থ হয়ে রেল শ্রমিক দল ও যুবদল নেতা কর্তৃক দরপত্র ছিনতাই হয়েছে বলে ভুয়া অভিযোগকারী দিয়ে মিথ্যা অভিযোগ দাখিল করানো হয়। পরে সেই টেন্ডার প্রক্রিয়া বাতিলের সত্যতা মিলেছে। সে সময় জানতে চাইলে সুজন চৌধুরী টেন্ডার প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়েছে স্বীকার করলেও বাদবাকি অভিযোগ অস্বীকার করেন।
রেলওয়ে শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. এম আর মঞ্জু চৌধুরী বলেন, তিনি আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে কাজ করেছেন। রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যাহার করে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন নেতাকর্মীদের লিজের জায়গাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিলেন। যার উদাহরণ অনেক আছে। আমরা রেল থেকে তাকে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে পুরস্কৃত পদায়নের পরিবর্তন চাই। ভালো মানুষের ভালো পদায়ন চাই’।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে সুজন চৌধুরীর সরকারি ফোনে কল দেয়া হলেও তিনি ধরেননি। জানতে চাইলে ভূ-সম্পত্তি বিভাগের এক কর্মচারী বলেন, ‘সুজন স্যার নিজের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিতেন। ফজলে করিম চৌধুরী যা বলতেন তাই করতেন। তার দপ্তরে ইচ্ছের বিরুদ্ধে কেউ গেলেই অযথা খারাপ আচরণ করতেন।’