কোনোকিছু লেখার শুরুতে বা প্রথম ধাপেই চ্যাটজিপিটির মতো বিভিন্ন জেনারেটিভ এআই টুলের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়লে শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করতে পারে না, স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যায় ও তাদের নতুন ধারণা তৈরিতেও সমস্যা হতে পারে বলে উঠে এসেছে গবেষণায়।
‘ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (এমআইটি)’র গবেষণায় শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এআই কীভাবে ব্যবহার করছেন তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠেছে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে শিক্ষাবিষয়ক নিউজ সাইট এডটেক ইনোভেশন হাব বা ইটিআইএইচ।
চ্যাটজিপিটির মতো জেনারেটিভ এআই টুল ব্যবহার করে লেখার সময় শিক্ষার্থীদের মানসিক মনোযোগের ওপর কেমন প্রভাব পড়ে– এমআইটি’র এ নতুন গবেষণায় তা খতিয়ে দেখেছেন গবেষকরা। খবর বিডিনিউজ’র
গবেষণার ফলাফলে উঠে এসেছে, প্রবন্ধ লেখার শুরুতেই যদি শিক্ষার্থীরা এআইয়ের সাহায্য নেন তবে তাদের মস্তিষ্কের সংযোগ কার্যক্রম কমে যাওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতি গঠনের প্রক্রিয়াও দুর্বল হতে পারে, যা শিক্ষার্থীদের শেখার প্রক্রিয়া ও চিন্তাশক্তি বিকাশে বাধা তৈরি করতে পারে।
‘ইওর ব্রেইন অন চ্যাটজিপিটি: অ্যাকুমলেশন অফ কগনিটিভ ডেট হোয়েন ইউজিং অ্যান এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট ফর এসে রাইটং টাস্ক’ শিরোনামের এ গবেষণায় ৫৪ জন শিক্ষার্থীর ওপর এ গবেষণা চালিয়েছেন গবেষকরা, যেখানে চারটি ভাগে লেখার সেশনের সময় উচ্চ-সংবেদনশীল মাত্রার ইইজি যন্ত্র ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা।
গবেষকরা বোঝার চেষ্টা করেছেন, এআইয়ের সহায়তায় লেখা শুরু করলে শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্ক কতটা সক্রিয় থাকে ও এটি তাদের মানসিক অবস্থা, চিন্তাশক্তি ও স্মৃতি গঠনে কেমন প্রভাব ফেলে।
গবেষণার পর্যায়টিকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন গবেষকরা। প্রথম ধাপে কোনও টুল নয়, অর্থাৎ কোনো প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়াই কেবল নিজের মস্তিষ্ক ব্যবহার করে লেখেন শিক্ষার্থীরা। দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে, তথ্য খোঁজার জন্য কেবল গুগল সার্চ ব্যবহার করতে পারবে তারা। তৃতীয়টি ধাপে চ্যাটজিপিটি’র উন্নত সংস্করণ ‘জিপিটি-৪ও’ মডেল ব্যবহার করে লেখা।
তবে শেষ ধাপে অর্থাৎ চতুর্থ সেশনে গবেষণায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার পদ্ধতি পরিবর্তন করেন গবেষকরা। এজন্য শুরুতে যাদেরকে চ্যাটজিপিটি দিয়ে লিখতে বলা হয়েছিল তাদেরকে এবার কোনও এআই ছাড়াই লিখতে বলা হয়। অন্যদিকে শুরুতে যারা প্রযুক্তি ছাড়া নিজের মস্তিষ্ক ব্যবহার করে লিখেছিলেন তাদেরকে এবার এআই ব্যবহার করে লিখতে বলেন তারা।
পুরো সেশনজুড়ে যেসব শিক্ষার্থীরা কোনও এআই টুল ব্যবহার না করে নিজে লিখেছেন তাদের মস্তিষ্কের ‘ফ্রন্টাল-প্যারিয়েটাল’ অংশ সক্রিয় হয়েছে, যা থেকে ইঙ্গিত মেলে, তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তি ভালো।
অন্যদিকে যারা শুরু থেকেই চ্যাটজিপিটির ব্যবহার করেছে ইইজি যন্ত্রে তাদের মস্তিষ্কের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ, বিশেষ করে ‘আলফা’ ও ‘বিটা’ অংশকে ঠিকভাবে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। প্রথমে এআই ব্যবহার করে লেখার কারণে পরে তারা নিজ থেকে লেখার চেষ্টা করলেও আগের লেখার বিভিন্ন বাক্য মনে রাখতে সমস্যায় পড়তে হয়েছে তাদের।
‘ডিউক ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ইনোভেশন’-এর চিকিৎসক ও নিউরোসায়েন্স গবেষক জিউন-টাইং ইয়েহ বলেছেন, “মানুষজন কষ্টে আছেন, তবু অনেকেই মানতে চান না যে, চ্যাটজিপিটির সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটানোর ফলে আমাদের মনোযোগ, সৃজনশীলতা ও বিচার করার ধরন বদলে যাচ্ছে।”
ডিউকে চিকিৎসা-সম্পর্কিত এআই নীতি ও নৈতিকতা গঠনে কাজ করেন ইয়েহ। এ গবেষণার গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেছেন, কীভাবে বারবার এআই ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ‘কগনিটিভ ডেট’ তৈরি হয় তা উঠে এসেছে এ গবেষণায়।
জেনারেটিভ এআইয়ের ওপর বেশি নির্ভরশীল হলে মানুষের মস্তিষ্কে নতুন তথ্য মনে রাখা ও তা আবার খুঁজে বের করা এবং বিভিন্ন তথ্য মিলিয়ে দেখে বোঝার সক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যায়– এমনটি বোঝাতে এখানে ‘কগনিটিভ ডেট’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন গবেষকরা।
গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হচ্ছে, এআই টুল ব্যবহারের সঠিক ক্রম বোঝা খুবই জরুরি। যেসব শিক্ষার্থীরা প্রথমে নিজের মতো করে কাজ শুরু করে তারপর এআইয়ের মাধ্যমে তা সংশোধন করেছেন তাদের মস্তিষ্কের সংযোগ সবচেয়ে ভালো দেখা গিয়েছে।
অন্যদিকে, যারা শুরুতেই এআই ব্যবহার করে পরে নিজের মতো করে লেখার চেষ্টা করেছেন তারা মস্তিষ্কের সেইসব অংশ ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেনি। ফলে তাদের লেখা ছিল ‘ভাষাগতভাবে নিস্তেজ বা প্রাণহীন’। তাদের পক্ষে খুব কম তথ্যও মনে রাখা সম্ভব হয়েছে।
যারা প্রথমে এআই দিয়ে লিখে পরে নিজে লেখার চেষ্টা করেছেন ৭৮ শতাংশ ক্ষেত্রেই নিজের আগের লেখা তাদের ঠিকভাবে মনে ছিল না, এমনকি একটি বাক্যও ঠিকমতো উদ্ধৃত করতে পারেননি তারা।
এদিকে, যারা প্রথমে নিজে লিখেছে ও পরে সেটি লিখেতে এআইয়ের সাহায্য নিয়েছে তাদের ৭৮ শতাংশই ঠিকভাবে নিজেদের আগের লেখা উদ্ধৃত করতে পেরেছেন।
এআই দিয়ে লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধ মানুষ ও অটোমেটিক সিস্টেম উভয়ের বিচারে ভালো নম্বর পেলেও, সেগুলোর মধ্যে ভিন্নধর্মী চিন্তা বা ব্যক্তিগত ভাবনার প্রভাব কম ছিল। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, শিক্ষার্থীরা বারবার একই ধরনের কনটেন্টে ফিরে গিয়েছে অর্থাৎ তারা তেমন কোনও নতুন চিন্তা আনতে পারেননি। এতে করে প্রশ্ন উঠছে, দীর্ঘমেয়াদে মানুষের সৃজনশীলতা ও কোনোকিছু শিখতে চাওয়ার প্রবণতা কতটা টিকে থাকবে।
গবেষকরা বলছেন, শুরুতেই জেনারেটিভ এআইয়ের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা তৈরি হলে তা শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কে তথ্যকে স্থায়ীভাবে জমিয়ে রাখার সক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে এবং তাদের পক্ষে নতুন কিছু ভালোভাবে শেখাও কঠিন হতে পারে।