শিশু সাহিত্যিক রমজান আলী মামুন পৃথিবীতে বেঁচে ছিলেন ৫১ বছর। ১৯৬৮ সালের ৩ আগস্ট তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর ৩৫ বছরের সাহিত্যিক জীবন আলোচনায় জুলাই মাসে একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের চেষ্টা করা হয়েছিল। এই উপলক্ষে একটি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়। গ্রন্থটি যথাসময়ে প্রকাশিত না হওয়ায় অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়। কবি সাইদুল আরেফিনসহ মামুনের কায়েক সাহিত্যিক বন্ধু উদ্যোগটিতে সহযোগী ছিলেন। গুণী শিশু সাহিত্যিক রাশেদ রউফ, গুনী শিশু সাহিত্যিক এমরান চৌধুরী এবং গুণী শিশু সাহিত্যিক রমজান আলী মামুন লেখালেখিতে সমসাময়িক ছিলেন। রমজান আলী মামুনের লেখা ১৫টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি বেতার-টেলিভিশনে গল্প, ছড়া, কবিতা পরিবেশন করতেন। প্রচার বিমুখ এই গুণীর সাহিত্য কর্মের আলোচনায় চট্টগ্রামের সাহিত্যাঙ্গন সমৃদ্ধ হত। চট্টগ্রাম এই পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। জীবনভর প্রচার বিমুখ থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করে এই শিশু সাহিত্যিক প্রচারের আলোয়ই এসেছেন।
২০০১ সালের দিকে শিশু সাহিত্যিক রাশেদ রউফ “দূরন্ত” নামে একটি শিশু পত্রিকা প্রকাশ করতেন। পত্রিকাটিতে সেই সময় “রমজান আলী মামুনের ছড়া সাহিত্য” শিরোনামে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল। সংখ্যাটি পড়েছিলাম। বোধকরি শিশু সাহিত্যিক রমজান আলী মামুনকে মূল্যায়নে শ্রেষ্ঠ কর্ম হতে পারে “দূরন্ত: পত্রিকার সেই সংখ্যাটি। প্রবাদ আছে, “রতনে রতন চিনে”। গুণী শিশু সাহিত্যিক রাশেদ রউফ খোঁজ পেয়েছিলেন রমজান আলী মামুনের প্রতিভার। শিশু পত্রিকা দূরন্তের মাধ্যমে শিশু সাহিত্যিক রমজান আলী মামুনকে আমার চেনা। মাসিক আন্দরকিল্লা কার্যালয়ে প্রথম পরিচিত হই। সাধাসিধে জীবনের অধিকারী ছিলেন। যে জীবন অনেকেই যাপন করতে পারেননা। তাঁর জন্ম চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের টেরীবাজারে। তাঁর চলন-বলনে তা বুঝার উপায় ছিল না। সাহিত্যিক হিসাবে আমরা তাঁর সফলতা নির্ণয় করতে পারিনি। কিন্তু নিরহংকার জীবন অর্জন করে তিনি নিজেকে সফল করে তুলতে পেরেছিলেন। তাঁকে জেনেছি সৎ, উদ্যোমি ও গুণী শিশু সাহিত্যিক হিসাবে। তিনি সহযোগিতার মনোভাব সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। ছিলেন সদালাপী। সাহিত্য চর্চার পাশপাশি সফল সংগঠক ছিলেন। আমৃত্যু ছিলেন মাসিক কথনের নির্বাহী সম্পাদক। এছাড়া মাসিক আন্দরকিল্লা পত্রিকার বিভাগীয় সম্পাদক, মাসিক কিশোর সমাবেশের সম্পাদক, সাহিত্য সংবাদের সম্পাদনা পর্ষদ সদস্য, কথন সাহিত্য ফোরামের সাধারণ সম্পাদক, বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা যুগান্তর সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কার্যনির্বাহী বোর্ড সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তিনি নিজেকে যোগ্য সংগঠক রূপে গড়ে তোলেন। লেখকদের মূল্যায়নে রমজান আলী মামুন ছিলেন আন্তরিক। কথন সাহিত্য ফোরাম প্রবর্তিত “কথন সাহিত্য সম্মাননা পদক” তার প্রচেষ্টার ফসল। চট্টগ্রামের লেখকদের মূল্যায়নে “কথন সাহিত্য সম্মাননা পদক” প্রদানে রমজান আলী মামুনের অগ্রণী ভূমিকার কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণযোগ্য। সমাজ চলছে, যেভাবে পারো নিজের ঢোল বাজাও, আখের গোছাও, অন্যের লেখা কাটিং করে হলেও নিজেকে লেখক বানাও তালে। পাঠক হৃদয় জয় করেছে তাঁর সহজ সরল ভঙ্গিমায় বিচিত্র লেখা। তাঁর লেখা দূর্বোধ্য নয়। সুখপাঠ্য লেখালেখিতে তাঁর পরিচিতির গন্ডি দেশব্যাপি। উদাহরণস্বরূপ ২০১৭ সালে প্রকাশিত তাঁর “তোর জন্য কষ্ট আমার” কাব্য গ্রন্থের “কৃষ্ণ-রাধা” সুখ পাঠ্য কবিতাটি পাঠ করি।
“এমন সুদিন আসবে কবে
জয় প্রেমেরই জয়
ছোট-বড়য় নেই ভোদাভেদ
নেই কোন সংশয়।
এমন সুদিন আসবে কবে
জয় প্রেমেরই জয়
যে প্রেম করে কৃষ্ণ-রাধা
অমর ও অক্ষয়।”
লেখালেখিতে কৃতিত্বের স্বীকৃতস্বরূপ তিনি ২০১২ সালে মনন সাহিত্য সম্মাননা, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ শিশু সাহিত্য একাডেমি কিশোর কবিতা সম্মাননা, ২০১৮ সালে অক্ষরবৃত্ত প্রকাশনের পান্ডুলিপি পুরস্কার লাভ করেন।
গত বছর সাপ্তাহিক চাঁটগা পত্রিকার আয়োজনে কবিতা পাঠের আসর করেছিলাম। এ বছরও একটি আসর আয়োজনে তাঁর সাথে পরামর্শ করি। তিনি স্বেচ্ছায় বলেছিলেন ৫শ টাকা সহযোগিতা দেবেন। তার কাছে ঋতী হলাম। রমজান আলী মামুন জন্ম গ্রহণ করেন মধ্যবিত্ত পরিবারে। সৃষ্টি করেছেন উচ্চ পর্যায়ের সাহিত্য। তাঁর উচ্চ মানের শিশু সাহিত্য কর্ম চট্টগ্রামে সাহিত্য চর্চার মান সমৃদ্ধ করেছে। শিশু সাহিত্যে তাঁর এই অবদান আমাদের আলোচনায় ফুটে উঠলে সেটি হবে তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন। আমাদের প্রতি তাঁর ঋণের কিছুটা শোধ। ২০১২ সালে সুলতান মাহমুদ সম্পাদিত “বসন্ত বাহার” কবিতা সংকলনে তাঁর লেখা “একা” কবিতা উদ্ধৃত করছি।
“সাগর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি একা
চনমনে রোদ ছড়িয়ে পড়ে পাশে,
স্মৃতির মাঝে কে দিয়ে যায় দেখা
স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন হয়েই ভাসে।
ঢেউয়ের পরে ঢেউ ছুটে যায় শুধু
যেদিক থাকায় তপ্ত বালু ধু ধু
অস্ত যাওয়া লালচে আলোর রেখা
দিচ্ছে জানান আজ আমি যে একা”।
নশ্বর পৃথিবী থেকে গুণী শিশু সাহিত্যিক রমজান আলী মামুন একা হয়ে গেছেন। তবে আমাদের স্মৃতির মাঝে তিনি দেখা দিয়ে যাবেন। ভাস্বর থাকবেন।