স্মৃতির দর্পণে মহীয়সী রমনী বেগম রোকেয়া

1

এম এ ফয়েজ

বেগম রোকেয়ার ৯৩ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা:
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের কথা। বাংলার নারী সমাজ পর্দার আড়ালে থাকতো। নারী সমাজকে তখন পুরুষের দাসী হিসেবে জীবন ধারণ করতে হতো। মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণের কোনো রীতি ছিলো না। নারী জাতিকে বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হতে হতো। তাদের কোন স্বাধীনতা ছিল না। সেই সময় পর্দার আড়ালে থাকা বন্দিনী নারী সমাজকে মুক্তির বাণী এবং আলোর পথে নিয়ে আসার জন্যে বাংলা সমাজে ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাব্ন্দ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে আবির্ভূত হন নারী জাগরণের অগ্রপ্রতীক খ্যাতিমান বাংলা সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক ও সমাজ সংস্কারক মহীয়সী রমনী বেগম রোকেয়া। তার প্রকৃত নাম ‘রোকেয়া খাতুন’ বৈবাহিক সূত্রে তার নাম বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।
তাঁর মাতার নাম রাহাতুন্নেছা সাবেরা চৌধুরানী এবং পিতার নাম ছিল জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ আলী সাবির। তাঁদের বংশের উপাধি ছিল ‘সাবির’। রোকেয়ার পিতা জহিরুদ্দিন সাবির বিরাট জমিদারের মালিক ছিলেন। সাড়ে তিনশ বিঘা জমিতে তাঁর বসত ভিটে ছিল। সাবির সাহেব আরবিও ফারসি,ভাষায় বিশেষ অভিজ্ঞ একজন নামকরা আলেম এবং খাঁটি মুসলমান ছিলেন। তবে ধর্মের ব্যাপারে তাঁর বড়ই গোঁড়ামী ছিল। তাঁর বাড়িতে পর্দার এমন কড়াকড়ি ছিল যে, বাইরের কোন পুরুষ মানুষ তো দূরের কথা; কোন অপরিচিত স্ত্রীলোক ও পর্দার ভেতরে বাড়ির আঙ্গিনায় প্রবেশ করতে পারতো না। এখন থেকে শতাধিক বছর আগের কথা। তখন মুসলমান সমাজের ঘোর দুর্দিন। অশিক্ষা কুশিক্ষায় সমগ্র সমাজ ছিল আচ্ছন্ন। একমাত্র ইসলাম শিক্ষা ব্যতিরেকে ইংরেজি, বাংলা কোন ধরনের শিক্ষা সুযোগ মেয়েদের কে দেয়া হতো না। মেয়েরা শুধু কোরআন শরীফ তেলাওয়াত এবং সামান্য উর্দু শিক্ষা গ্রহণ করবে এবং শরীয়তের মাসয়ালা মাসায়েল সম্পর্কে অবগত হবে। সাওম সালাত আদায় করবে এই ছিল তৎকালীন সমাজের সকল সম্ভ্রান্ত বংশের চিরাচরিত নিয়ম। এমনি সময়ে এমন এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও রোকেয়া বাইরের আলোকের পিপাসায় ব্যাকুল হয়ে পড়েন। রোকেয়া ছোটবেলা থেকেই জীবন সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তিনি অবরোধ জীবনের দুঃখ-বেদনা কখনো ভুলতে পারেননি। যা তাঁকে পরবর্তী জীবনে মহৎ কর্ম সাধনায় ব্রতী হতে সাহায্য করেছে। রোকেয়ার ছয় ভাই বোন। তিনি তাঁর বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের এর তত্ত¡াবধানে বাংলা ও ইংরেজি শিখেন। গভীর রাত জেগে ভ্রাতা ভগ্নি বই খুলে বসতেন জ্ঞানের সাধনায়। ইব্রাহিম সাবির তার ছোট বোন রোকেয়াকে পড়াবার সময় বইয়ের নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু ছাড়াও গল্প চলে দেশ-বিদেশের নানা কাহিনী বলে বোনের জ্ঞানের ভান্ডারও উৎসাহ বর্ধন করতেন। রোকেয়া সেসব কাহিনী মনোযোগের সাথে শ্রবণ করতেন ও হৃদয়ে গভীরভাবে অঙ্কিত করে রাখতেন।
বেগম রোকেয়া ছিলেন একজন অসামান্য রূপবতী ও সর্বগুণে গুণান্বিতা। লেখাপড়া, স্বভাব চরিত্র, আচার ব্যবহার, চালচলন প্রভৃতি সব দিক দিয়ে তিনি ছিলেন একজন সেরা নারী। ধীরে ধীরে তিনি যৌবনে পদার্পণ করলেন। রোকেয়ার পিতা মাতা মেয়ের বিয়ের জন্য চিন্তিত হয়ে উঠলেন। তাঁদের ইচ্ছে মেয়েকে উর্দু এবং আরবি জানা একজন উপযুক্ত পাত্রের হাতে সমর্পণ করার। আর এদিকে রোকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহিমের ইচ্ছে রোকেয়াকে এমন একজন আধুনিক উচ্চ শিক্ষিত লোকের সাথে তুলে দেবেন, যিনি তার জীবনকে অধিকতর মহান উন্নত করে তুলতে পারবে। ভাগ্যক্রমে একজন শিক্ষিত পাত্রের সন্ধান ও মিলল। ঠিক হয়ে যায়, রোকেয়ার বিয়ের দিনক্ষণ। ১৬ বছর বয়সে তাকে পাত্রস্থ করা হয় বিহারের অন্তর্গত ভাগলপুরের খান বাহাদুর উপাধিধারী বিহার সরকারের অধীনস্থ একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। বিবাহের পর তিনি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নামে পরিচিত হন। বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন ছিল মুসলিম নারীদের কুসংস্কার ও অন্ধকার পথ থেকে ফিরিয়ে আনার। মুসলিম নারীদেরকে শিক্ষার আলোকে জাগিয়ে তোলা ছিল তার প্রধানতম অন্তর কামনা। কেননা তিনি বুঝেন এবং জানেন, শিক্ষা মানুষের চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটায় এবং শিক্ষা মানুষের মনের চোখ খুলে দিতে সহায়তা করে। একটা সাধারণ চোখ যেখানে মাটি, বালি ও কয়লা দেখে; সেখানে শিক্ষিত চোখ বালি থেকে সাদা পাথর, মাটি থেকে হিরা মানিক, কয়লা থেকে হীরক আবিষ্কার করে। তাহলে মেয়েদের কেন শিক্ষার অভাবে এ চোখ চির অন্ধ হয়ে থাকবে? বেগম রোকেয়া বলেন, এদেশের নারী জাতি আত্মশক্তিতে বলীয়ান নয়। শিক্ষার আলো হতে তারা বঞ্চিত, অবহেলিত ও নিষ্পেষিত। এ অবস্থা নারী জাতির জন্য কিছুতেই কাম্য নয়। কাজেই নারীকে জেগে উঠতেই হবে এবং এ অবস্থা থেকে নারী সমাজকে মুক্তি পেতে হবে। বেগম রোকেয়া সর্বদা এসব বিষয়ে ভাবতেন। আর এদিকে তিনি স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের প্রেরণায় সাহিত্য চর্চা করেন। সাখাওয়াত হোসেন নিজের অন্তরের স্ত্রীর অসহায়তার কথা বুঝতে পারতেন এবং স্ত্রী রোকেয়াকে তিনি প্রাণের সাথে ভালবাসতেন। সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন অতিশয় একজন উদার প্রকৃতির লোক। তিনি যেমন জ্ঞানী ও বিচক্ষণ, তেমনি ছিলেন বড় দুঃখকাতর। তিনি চাকরি জীবনে সত্তর হাজার টাকা জমিয়েছিলেন এবং এই টাকার দ্বারা তিনি তার স্ত্রী রোকেয়ার স্বপ্নকে সফল করতে সংকল্প করেন। তিনি একসময় রোকেয়াকে বললেন, স্ত্রী জাতির শিক্ষা ব্যতীত সমাজ জীবন অসম্পূর্ণ ও বিফল। সুতরাং আমার মৃত্যুর পর আমার সঞ্চিত অর্থ দ্বারা একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবে। কালের নির্মম পরিহাস অকালে সাখাওয়াত হোসেন বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। অল্প বয়সে বিধবা হলেন বেগম রোকেয়া। স্বামী মৃত্যুর পাঁচ মাস পরে তিনি স্বামীর পূর্ব উপদেশ অনুযায়ী নারী জাতির চক্ষু উন্মীলনের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। ভাগলপুরে মাত্র পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে তিনি একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে কোন রকমে সময় কাটানোর ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু ইতোমধ্যে আরেকটি নতুন অশান্তির সম্মুখীন হলেন তিনি। স্বামীর মৃত্যুর পর সম্পত্তি নিয়ে গন্ডগোলের সৃষ্টি হলে অবশেষে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি স্বামীর ভিটে ত্যাগ করে কলকাতায় চলে আসেন। সেখানে তার ছোট বোন হোমেরাকে নিয়ে বাস করতে লাগলেন এবং তিনি নিজের পূর্ব সংকল্প ও স্বামীর বাসনা কার্য পরিণত করতে ইচ্ছে করে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ তারিখে আট জন বালিকা নিয়ে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেন।
পরলোকগত স্বামীর নামানুসারে তিনি এ বিদ্যালয়ের নাম রাখলেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’। তখনকার ধর্মান্ধ ও ঘুনেধরা সমাজ ব্যবস্থার জন্য তৎকালীন সমাজে মেয়েদের অবস্থান ছিল খুবই নিচু। মেয়েদেরকে তখন পুরুষেরা দাসী হিসেবে গণ্য করতো। তাই বেগম রোকেয়া চিন্তা করেন, এই দুরবস্থার অবসান করতে হলে প্রথমে মেয়েদের চাই শিক্ষা, আধুনিক জীবনের আলো। এই উদ্দেশ্যে শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি তিনি নানা সামাজিক সংগঠন করে তুলেছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্কুলের ছাত্রীর সংখ্যা সংগ্রহের জন্য ধর্না দেন। এভাবে ছাত্রী সংগ্রহ করে এদেশে প্রথম মুসলিম স্কুলটি তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন। এছাড়া মহিলাদের দুঃখ- দুর্দশা দূর করার জন্য বিভিন্ন প্রকার পদক্ষেপ ও গ্রহণ করেন তিনি। এই উদ্দেশ্যে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে আঞ্জুমানে খাওয়াতীম নামে তিনি একটি মহিলা সমিতি স্থাপন করেন। তাঁর সাহিত্য কর্মের মধ্যে ছিল নারী জাগরণের কথা আর নারী মুক্তির কথা। নারীর অধিকারও মর্যাদাকে ঘিরে তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। বাংলা রচনার পাশাপাশি ইংরেজি রচনাতেও তিনি ছিলেন পারদর্শী।
তৎকালে ২৫ বছর বয়সে তাঁর রচিত ‘Sultana’s Dream’ শিরোনামে একটি অসাধারণ গল্প বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। পরে তিনি তাকে বাংলায় ‘সুলতানার স্বপ্ন’ অনুবাদ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে-‘মতিচুর’ প্রথম খন্ড ও দ্বিতীয় খন্ড ‘পদ্মবাগ’ ও ‘অবরোধবাসিনী’ সুলতানা স্বপ্ন’ ‘ডেলিসিয়া হত্যা’ প্রভৃতি গ্রন্থ দেশের সর্বত্র বিশেষ প্রশংসা অর্জনে সমর্থ হয়। যার জন্য তৎকালীন হিন্দু মুসলমান যাবতীয় সাহিত্যিকবর্গ তাঁকে অশেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন। আজ বেগম রোকেয়া আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর প্রচেষ্টায় দেশে শত শত রোকেয়ার জন্ম হয়েছে। এটাই তাঁর জীবনের সর্বাপেক্ষা বড় সাফল্য। তিনি নিঃসন্তান হয়েও হাজার হাজার সন্তানের জননী। যতদিন দেশে শিক্ষার আদর থাকবে ততদিন সকলেই নিঃসন্দেহে শ্রদ্ধাভরে বেগম রোকেয়াকে স্মরণ করবে। আজ তাঁর ৯৩ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

লেখক : সম্পাদক-মাসিক শিক্ষামুকুর, গবেষক ও কলামিস্ট