স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্সের অপেক্ষায় অর্ধলক্ষ চালক

10

মনিরুল ইসলাম মুন্না

সাতকানিয়া উপজেলার মো. শাহেদুল ইসলাম সৌদি আরবের একটি ড্রাইভিং ভিসা পান। কিন্তু যেতে হলে লাগবে নিজ দেশের ড্রাইভিং লাইসেন্স। সে অনুযায়ী তিনি গত বছরের (২০২৩) সেপ্টেম্বর মাসে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেন। যথানিয়মে তিনি পরীক্ষা দিয়ে যাবতীয় কাজ সম্পাদন করেন। কিন্তু তিনি ই-ড্রাইভিং লাইসেন্স পেলেও পাননি স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স কার্ড। এর মধ্যে তিনি কয়েক দফায় বিআরটিএ কার্যালয়ে যোগাযোগ করলেও আসেনি কাক্সিক্ষত স্মার্ট কার্ড। যার জন্য আজও যাওয়া হয়নি সৌদি আরবে।
মো. শাহেদুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমি এম্বেসিতে ই-লাইসেন্সের কাগজপত্র জমা দিয়েছি। এরপরও আমার সেই লাইসেন্সটা তারা গ্রহণ করেনি। এরপর বিআরটিএতে কয়েকবার যোগাযোগের পর এখনও হাতে পাইনি আমার স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স। জানি না কবে পাবো। সে লাইসেন্সের আশায় এখনও অপেক্ষায় রইলাম। বাংলাদেশের লাইসেন্স নিয়ে সৌদি আরবে ড্রাইভিং করা যায় না বলে জেনেছি। তবে বাংলাদেশি লাইসেন্স নিতে হবে। আর সেখানে গিয়ে পুনরায় পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে সৌদি লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হবে। অথচ ভিসা পেয়েছি আগে, লাইসেন্স পেলে বিদেশে যাব বলে ঠিক করেছি। কিন্তু বিআরটিএ আমাকে আটকে দিয়েছে।’
একই সময়ে কক্সবাজারের মহেশখালী এলাকার বাসিন্দা মো. সাগরও ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়নের জন্য পরীক্ষা দেন। তারও ই-লাইসেন্স আসলেও আসেনি মূল স্মার্ট কার্ড। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়েছি প্রায় এক বছর হবে। এখনও কার্ড পাইনি। আর কতদিন ঘুরতে হবে আল্লাহই জানেন। একদিকে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাচ্ছি না, অন্যদিকে ই-লাইসেন্স দেখালে মানতে চান না ট্রাফিক পুলিশ। যেন সব দোষ আমাদেরই। তাদের কোনো দায় নেই।’
শুধু এ দুইজন নয়। চলতি বছরের ২৯ আগস্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৬ মাসের বেশি সময় ধরে চট্টগ্রাম জেলা ও মেট্রো বিআরটিএতে কার্ড স্বল্পতার কারণে ‘রেডি ফর প্রিন্ট’ বা পেন্ডিং লাইসেন্সের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার ৯২টি।
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে প্রতি বছর অন্তত ৭ লাখ স্মার্ট কার্ড প্রয়োজন। আগের ঘাটতি আছে আরও ৮ লাখ। এর সঙ্গে চুক্তি পরিবর্তনের সময় প্রায় ১২ লাখ আবেদন জমা পড়েছিল। চলতি বছর গ্রাহকদের চাহিদা প‚রণ করতে হলে অন্তত ২৭ লাখ কার্ড প্রয়োজন। অথচ গত সাড়ে তিন বছরে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মাত্র ১৬ লাখ কার্ড পেয়েছে বিআরটিএ।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২০২০ সালের ২৯ জুলাই ডুয়েল ইন্টারফেস পলিকার্বনেট স্মার্ট কার্ড তৈরির জন্য ভারতীয় প্রতিষ্ঠান মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স (এমএসপি) প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে বিআরটিএ। চুক্তির দিন থেকে পরবর্তী তিন বছর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির ২৪ লাখ কার্ড সরবরাহ করার কথা ছিল। কিন্তু সাড়ে তিন বছরে কার্ড সরবরাহ করেছে মাত্র ১৬ লাখের মতো। চুক্তির দিন থেকে ২০২৫ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি কাজ করবে। এই পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির ৪০ লাখ কার্ড প্রিন্ট করে সরবরাহ করার কথা আছে। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে চাহিদা অনুযায়ী কার্ড না পাওয়ায় গ্রাহকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহ করতে পারছে না বিআরটিএ।
বিআরটিএ সূত্র বলছে, কোম্পানিটি ডলার-সংকটের অজুহাত দেখিয়েছে। যখন চুক্তি হয়, তখন ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা, যা বর্তমানে ১২৫ টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে। এই কারণে তারা কার্ড আনতে পারছে না ভারত থেকে। এই কোম্পানির কাছে এখন কার্ড নেই। বিমানবন্দরে ২৫ হাজার স্মার্ট কার্ড আসলেও সেটি খালাস করতে পারেনি কোম্পানিটি। যদিও এই ২৫ হাজার কার্ডে চাহিদা মেটানো সম্ভব না।
এ বিষয়ে মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেডের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক আশরাফ বিন মুস্তফা পূর্বদেশকে বলেন, আগে এলসি (ঋণপত্র) চুক্তি নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল। সেটি কাটিয়ে গত বছর ৫ লাখ কার্ড দেশে আনা হয়েছিল আইপির (আমদানি অনুমতি) মাধ্যমে। এখন এলসি নিয়ে সমস্যা নেই। তবে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যাংক বড় অঙ্কের এলসি দিতে চাইছে না। এ কারণে কম কম করে কার্ড আনা হচ্ছে। তবে সেটাতে বিআরটিএ খুশি নয়। এখন ৫০ হাজার করে কার্ড আনা যাচ্ছে। শুধু শেষবার ২৫ হাজার কার্ড এসেছে। সম্প্রতি সাফটা (দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তি) চুক্তি করেছে। সেই চুক্তিতে নাম ভুল থাকায় বিমানবন্দর শুল্ক কর্তৃপক্ষ কার্ড ছাড় দিচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করছি, এর সংখ্যা বাড়ানোর ব্যাপারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআরটিএ’র সংশ্লিষ্ট শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানটির কাছে এখন কোনো কার্ড নেই। তারা জানিয়েছে, ডলার সংকটের কারণে কার্ড খালাস করতে পারছে না। চুক্তির সময় ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা, এখন পৌঁছেছে ১২৫ টাকায়। চুক্তি অনুযায়ী এই প্রতিষ্ঠানটি কখনোই ঠিকভাবে কার্ড সরবরাহ করতে পারেনি আমাদের।
বিআরটিএ চট্টগ্রাম জেলা ও মেট্রো কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিআরটিএ’র জন্ম থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত ৪ লাখ ২১ হাজার ৮৭৮টি লাইসেন্স প্রদান করা হয়। এর মধ্যে ই-লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে ৫০ হাজার ৬২০টি এবং স্মার্ট কার্ড স্বল্পতার কারণে ‘রেডি ফর প্রিন্ট’ বা পেন্ডিং লাইসেন্সের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার ৯২টি। যাদের আবেদনের মেয়াদ ছয় মাস পেরিয়ে গেছে বা এক বছর হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কার্ড পাননি তারা। এখন বিআরটিএ কার্যালয়ে কার্ডের জন্য যোগাযোগ করলে কর্মকর্তারা তাদের আবেদনে ডেলিভারির সময় বাড়িয়ে দিয়ে স্বাক্ষর করে দিচ্ছেন। কিন্তু কবে নাগাদ কার্ড সরবরাহ করবেন সেই তথ্য দিতে পারছেন না।
বিআরটিএ চট্ট মেট্রো-২ সার্কেল ও লাইসেন্স শাখার সহকারী পরিচালক (ইঞ্জি.) মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘আমাদের পেন্ডিং কার্ডের আবেদনগুলো প্রিন্ট করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে প্রিন্ট হয়ে না আসার কারণে সরবরাহ করা যাচ্ছে না। কার্ডগুলো প্রিন্ট হয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছলে মোবাইল ফোনে সংশ্লিষ্ট চালকদের কাছে ক্ষুদে বার্তা যাবে। তখন সেগুলো সংগ্রহ করে নিতে পারবেন চালকরা।
তিনি আরও বলেন, আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) কার্ড সরবরাহের বিষয়ে আমাদের সেন্ট্রালি একটি সভা হবে। সেখানে কার্ড আটকে থাকার কারণ, কবে নাগাদ সরবরাহ করা হবে, ইত্যাদি বিষয়ে জানতে পারবো। শীঘ্রই এ সমস্যার সমাধান হবে। আমরা চালকদের লাইসেন্সসহ বিআরটিএ’র যাবতীয় কাজ সহজ থেকে সহজতর করতে কাজ করে যাচ্ছি।