এস.এম. মিছবাহ্-উর-রহমান
আলহাজ¦ মীর আহমদ সওদাগর ছিলেন চট্টগ্রামের একজন স্বনামধ্য কৃতী ব্যবসায়ী এবং মীর গ্রুপের চেয়ারম্যান। বিশিষ্ট এ সমাজসেবক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষানুরাগী ১৯৩৪ সালে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার জিরি ইউনিয়নের জিরি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম আমছুর আলী এবং মাতা মরহুমা মরিয়ম খাতুন। শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যে ছিল প্রচন্ড শিক্ষানুরাগ। সেকালীন সময়ে পটিয়ার বৃহত্তর পশ্চিমাংশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল গুটিকয়েক। বিশেষ করে মুসলিম নারীদের শিক্ষায় অনগ্রসরতা তাঁকে ছোটবেলা থেকেই পীড়া দেয়। এ অনুভ‚তি তাঁকে এলাকার নারী-শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তোলে। এ চেতনার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৮১ সালে পটিয়ার আরেকজন কৃতী সন্তান বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিল্পপতি ‘কেডিএস গ্রুপে’র সম্মানিত চেয়ারম্যান আলহাজ¦ খলিলুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে জিরি খলিল-মীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এ জনপদে তখন নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। এ বিদ্যালয়টি ‘মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড চট্টগ্রাম’র অধীনে এস.এস.সি পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে এ বিদ্যালয়টিতে সহশিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে এবং এটির নাম জিরি খলিল-মীর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে উভয় শিক্ষানুরাগী শিল্পপতিদ্বয় ১৯৯৪ সালে জিরি-সাঁইদাইর গ্রামের মাঝামাঝি অবস্থানে খলিল-মীর কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। কলেজটিতে মনোরম পরিবেশে উচ্চ মাধ্যমিক, ডিগ্রি (পাস্) এবং অর্থনীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগে অনার্স-কোর্স চালু রয়েছে।
২০১৫ সালে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আহবানে সাড়া দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামীণ পর্যায়ে শতভাগ নিশ্চিত করতে সকল শিশুর জন্যে শিক্ষার সুযোগ-সৃষ্টির লক্ষ্যে জিরি গ্রামের পূর্বাংশে জিরি হাজী মীর আহম্মদ সওদাগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে শিশু শিক্ষার একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি পরিচালিত হচ্ছে।
ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে তিনি তাঁর বাড়ীর পাশের্^ একটি ফোরকানিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে তিনি বেশ কিছু মসজিদ, এবাদত খানা এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদান রেখেছেন। একজন সফল শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে তিনি আজীবন সততা ও নিষ্ঠার সাথে নিজ ব্যবসায় পরিচালনা করে গেছেন। গড়ে তুলেছেন দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান মীর গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। এ গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানসমূহ: মেসার্স হাজী মীর আহমদ সওদাগর, মেসার্স এম.এ সালাম এন্ড কোং, মেসার্স হাসান এন্ড ব্রাদার্স, মেসার্স হোসেন এন্ড ব্রাদার্স, মীর পাল্প এন্ড পেপার ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ, মীর বনস্পতি প্রোডাক্টস, মীর ফুড এন্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ, হাসান অয়েল মিল লিঃ, ইবনাত এডিবল অয়েল মিলস্, মীর ফিলিং স্টেশন, মীর সিএনজি ফিলিং স্টেশন, মীর ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, কর্ণফুলী সি.এন.জি এন্ড ফিলিং স্টেশন। এ শিল্পগ্রুপের মাধ্যমে এ মহান ব্যক্তি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রসারে ব্যাপক ভ‚মিকা পালন করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিল্প-প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে; যা চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের দারিদ্র বিমোচনে ভ‚মিকা রেখে যাচ্ছে। এ মহান বিদ্যোৎসাহী ছিলেন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ইসলামী শরিয়াহ্ ভিত্তিক পরিচালিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ‘আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক পিএলসি-এর একজন প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। তিনি অত্যন্ত সফলতার সাথে এ ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেছেন। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু বিমা প্রতিষ্ঠানের সাথেও জড়িত ছিলেন।
এ মহানুভব ব্যক্তি জনকল্যাণে নিজকে সদা নিবেদন করে গেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অটল বিশ^াসী ছিলেন। সমাজ সংস্কারের লক্ষ্যে তিনি অসংখ্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন এবং পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অত্যন্ত ধার্মিক এবং ইসলামের অনুশাসন কঠোরভাবে পালন করেন এবং নিজ পারিবারিক পরিমন্ডলে এর র্চ্চা অব্যাহত রাখতে সদা সচেষ্ট ছিলেন। পারিবারিক জীবনে তাঁর স্ত্রী নুরজাহান বেগম, চার পুত্র ও পাঁচ কন্যা। তাঁরা প্রত্যেকেই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। বার্ধক্যের শত জটিলতা ও বাধা অতিক্রম করে আলহাজ¦ মীর আহমদ সওদাগর আলোকবর্তিকা হাতে পথ দেখিয়ে গেছেন এ জনপদের মানুষকে। বিগত ২৭ জানুয়ারি ২০২৪ খ্রি., শনিবার সকাল ৮ টায় এ মহান আলোকিত ব্যক্তিত্ব মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর আলোকিত অবদানের কারণে এ জনপদের মানুষ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে স্মরণ করবে এ-মহানুভব ব্যক্তিকে। ক্ষণজন্মা এ-মহান ব্যক্তির প্রতি পটিয়াবাসীর সশ্রদ্ধ সালাম। আমরা খলিল মীর শিক্ষা পরিবারের পক্ষ থেকে আমাদের এই অভিভাবকে তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত স্মরণসভায় অকৃত্রিম শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি এবং তাঁর পবিত্র আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
লেখক : অধ্যক্ষ, খলিল-মীর কলেজ, পটিয়া, চট্টগ্রাম