অ্যাড. সালাহ্উদ্দিন আহমদ চৌধুরী লিপু
গণতন্ত্রের অপরিহার্য পূর্বশর্ত হলো একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। কিন্তু আমরা দুর্ভাগা জাতি স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও আমরা একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারিনি। বাংলাদেশের অধিকাংশ নির্বাচন কমিশন বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেনি বার বার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৮[৪] অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকার কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান হলেও প্রকৃত অর্থে ইহা কখনও স্বাধীন ছিল না। স্বাধীনাত্তোর বাংলাদেশে ১৯৭৩, ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯১, ১৯৯৬, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৩ সালে মোট ১২টি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তৎমধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে চারটি, বিএনপি সরকারের অধীনে ২টি, জাতীয় পার্টি সরকারের অধীনে ২টি ও তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে চারটি জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। আর এ পর্যন্ত ১৪ জন দেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন। দীর্ঘ ৫৪ বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৩ বছর, বিএনপি ১৩ বছর, জাতীয় পার্টি ৯ বছর, তত্ত¡াবধায়ক সরকার এবং অন্যান্য শাসকরা ৯ বছর দেশ শাসন করেছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি জাতীয় পার্টি ও অন্যান্যরা দীর্ঘকালব্যাপী দেশের ক্ষমতায় থাকলেও নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করেনি। বিগত ক্ষমতাসীন দলগুলো নির্বাচন কমিশন গঠিত করেছিল নিজেদের আজ্ঞাবহ ও অনুগত ব্যক্তি দিয়ে। তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল এক ও অভিন্ন। নিজেদের আজ্ঞাবহ ও নতজানু নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে নিয়ম রক্ষার নির্বাচন করে ক্ষমতার মসনদ আকড়ে থাকা। অতীতে রাজনৈতিক দলগুলোর অধীনে দেশে যত সব নির্বাচন হয়েছে, সবগুলো ছিল প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন। তারা নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করেছে ক্ষমতায় ঠিকে থাকার নিয়াময়ক শক্তি হিসেবে। তাই সেসব নির্বাচন কমিশনও কলঙ্কিত হয়েছিল। বিতর্কিত নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশনের কারণে দেশে বার বার অনির্বাচিত সরকারের উদ্ভব হয়েছিল। অতীতে বিভিন্ন সময়ে দেখেছি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলসমূহ স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনে স্থায়ী আইন প্রণয়নের দাবি জানালেও ক্ষমতাসীন দলের উদাসীনতায় এই আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। সবসময় স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি, মতামত উপেক্ষিত হয়েছে। এমনকি অতীতে দেখেছি আওয়ামী লীগ, বিএনপি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনে বিদেশী দাতা গোষ্ঠীর সহায়তাও চেয়েছিল। “জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম’’ রাজনৈতিক দলগুলোর এ পুরানো উক্তিটি শুনতে শুনতে জনগণ ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার পূর্বে জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার করলেও পরবর্তীতে তারা ক্ষমতায় পরশ পাওয়ার সাথে সাথে সে অঙ্গীকার বেমালুম ভুলে যায়। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় থাকাকালীন যদি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করে যেতো, তবে তাদের স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য এত মাতম করতে হতো না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো সংস্কারের উদ্যেগ গ্রহণ করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ইতিপূর্বে ড. বদিউল আলম মজুমদারকে প্রধান করে চার সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন। সম্প্রতি সরকারের গঠিত সার্চ কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদের ক্ষমতা বলে অবসরপ্রাপ্ত সচিব এএমএম নাসিরউদ্দীনকে দেশের পঞ্চদশ প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অপর চারজনকে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর চাপের কাছে নতি স্বীকার করে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিতে বাধ্য হয়েছে। তারা মনে করছেন, নির্বাচন কমিশন চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয়া কতটুকু যুক্তিসঙ্গত। সংস্কার কাজ চলমান অবস্থায় সরকারের নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয়ার অর্থ কি। সরকার সংস্কারের পূর্বে নির্বাচন কমিশনার যদি নিয়োগ দেয় তাহলে সংস্কারের নামে এত ঢাকঢোল পিটিয়ে লাভ কি হলো। স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে এখনো সাধারণ জনগণ সংশয় প্রকাশ করছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রের কাঠমো সংস্কারের অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতাসীন হয়। তাই জনগণের কাছে এ সরকারের দায়বদ্ধতা রয়েছে। সরকার তাদের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে না পারলে ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হবে।
দেশ গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হলে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের বিকল্প নেই। তাই স্বাধীন, সার্বভৌম ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গড়ার লক্ষ্যে কিছু প্রস্তাব পেশ করা হলো। আশাকরি নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন এসব বিষয়গুলো সুবিবেচনা করলে সুফল বয়ে আনবে। যথাঃ-[১] বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের মধ্য থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও বিভিন্ন পেশার বা দেশের সজ্জন, বিশিষ্ট ও নিরপেক্ষ নাগরিকদের থেকে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ, [২] প্রধান নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের পদমর্যাদা উন্নীতকরণ, [৩] সংবিধানে প্রদত্ত ক্ষমতাবলি সুদৃঢ়ভাবে ধারণ ও বাস্তবায়ন, [৪] গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ সংশোধন, [৫] নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে সচিবালয় গঠন, নির্বাচনকালীন নির্বাচন কমিশনের হাতে নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান, [৬] নির্বাচনকালীন স্বরাষ্ট্র সংস্থাপন মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্তকরণ, [৭] নির্বাচন কমিশনের পছন্দ অনুযায়ী সচিবালয়ের সচিব ও কর্মকর্তা নিয়োগ, [৮] নির্বাচনকালীন বেসামরিক এবং সামরিক প্রশাসনের ওপর সংবিধানে অর্পিত ক্ষমতা শতভাগ প্রয়োগ, [৯] নির্বাচনকালীন আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী হিসেবে সেনাবাহিনীকে অন্তর্ভূক্তকরণ, [১০] নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের নিশ্চয়তা, [১১] জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের সব নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের নিজস্ব কর্মকর্তাদের পদমর্যাদা বৃদ্ধিপূর্বক রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ, [১২] অনিয়ম, কারচুপি ও গোলযোগের কারণে নির্বাচনী কার্যক্রম স্থগিত বা বাতিল করার পূর্ণ ক্ষমতা অর্পণ, [১৩] নির্বাচনী অপরাধে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনী কার্যে নিয়েজিত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের শাস্তির পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান, [১৪] জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রণয়ন নির্বাচন কমিশনের ন্যস্ত, জাতীয় পরিচয়পত্র পরিশুদ্ধ করণ ও ভোটার তালিকা প্রনয়ণ, [১৫] জাতীয় পরিচয়পত্র পরিদর্শনপূর্বক ভোট প্রয়োগের ব্যবস্থা, [১৬] প্রার্থীদের নির্বাচনী হলফনামা সঠিকভাবে যাচাই-বাচাই এবং হলফনামায় অসত্য তথ্য প্রদানেরর জন্য সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল, এমনকি অভিযুক্ত প্রার্থী বিজয়ী হওয়ার পরও নির্বাচনী ফলাফল বাতিল এবং শাস্তির বিধান করা, [১৭] নির্বাচনী ব্যয়ের রিটার্ন অডিট করা, [১৮] নির্বাচন ও প্রার্থীতা বাতিলে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি, [১৯] স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নির্দলীয় ও প্রভাব মুক্তকরণ, [২০] প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয় পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা, [২১] না ভোটের প্রবর্তন, [২২] প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ এবং পাসপোর্টকে অগ্রাধিকার, [২৩] অক্ষম ব্যক্তি ও এলাকার বাইরে বিভিন্ন পেশায় নিয়েজিত কর্মজীবীদের জন্য পোস্টাল ভোটের প্রবর্তন, [২৪] নির্বাচনে পেশিশক্তির প্রভাব বন্ধ, [২৫] দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেতে সংশ্লিষ্ট দলের অন্তত আট/দশ বছরের সদস্যপদ থাকার বাধ্যবাধকতা আরোপ, [২৬] কোন ব্যক্তি একবারের অধিক সংসদ সদস্য নির্বাচিত না হতে বাধ্যতামূলক আইন প্রণয়ন, নির্বাচনী অভিযোগ, মামলাসমূহ দ্রæত নিষ্পত্তিতে আইন প্রণয়ন, [২৭] একই মঞ্চে সব প্রার্থীর প্রচার করার বিধান, [২৮] উন্নত বিশ্বের নির্বাচন কমিশনের ফর্মূলা অনুসরণ, [২৯] নির্বাচনে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা, [৩০] রাজনৈতিক দলের ভোট ও মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধকরণ।
ভোট জনগণের মৌলিক অধিকার। স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে। আমজনতা চায় তাদের মৌলক অধিকার ফিরে আসুক। গণতন্ত্রের ভিত মজবুত হোক। জাতি চায় একটি শক্তিশালী, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। সে নির্বাচন কমিশনের অধীনে সকল রাজনৈতিক দল মেনে নিয়ে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করবে। জাতি আশা করছে ইউনুস সরকার স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনপূর্বক জাতিকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য একটি জাতীয় নির্বাচন উপহার দিবেন।
লেখক : কলামিস্ট, সংগঠক