‘স্বপ্ন’ হারিয়ে বাবাকে খুঁজছে দুই শিশুকন্যা

2

নিজস্ব প্রতিবেদক

অটোরিকশা চালক বাবা মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন (৪৪) প্রতিদিন ভোরে যখন ঘর থেকে বের হতেন, তখন বাবার সঙ্গী হতো তৃতীয় শ্রেণি পড়–য়া মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা সাইফা। বড় মেয়ে আয়েশাকে নিয়ে শাহাদাত যখন ঘর থেকে বের হতেন তখন ছোট মেয়ে সুমাইয়া সিদ্দিকা মাইমুনা বাবার কোলে চড়ে বসতো। কিংবা কোল থেকে নামতোই না। যে বাবাকে ঘিরে ছোট্ট দুই মেয়ের পৃথিবী ছিল, সেই বাবা-ই এখন নেই পৃথিবীর আলোতে। বাবাকে যেদিন আশপাশের লোকজন খাটিয়া করে কবর স্থানের দিকে নিয়ে গেছে, সেদিনও বাবার অবস্থা বুঝেনি অবুঝ দুই শিশু কন্যা।
গত ১১ ডিসেম্বর বাবার মৃত্যুর পর থেকে দুই কন্যা এখনো প্রতীক্ষায় আছে বাবা ফিরবে অটোরিকশা চালিয়ে। হাতে থাকবে হরেক-রকমের খাবার। বাবার প্রতীক্ষায় থাকা দুই শিশু সন্তান এখনো জানে না, তাদের বাবা শাহাদাত চলে গেছেন না ফেরার দেশে। বড় মেয়েকে বাবা আর পৌঁছে দেবেন না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।আদরের ছোট মেয়েকে বুকে জড়িয়ে রাখবেন না।
বাবা ঘিরে দুই কন্যার ‘স্বপ্ন’ ভগ্ন হয়েছে হাটহাজারী রামগড় সড়কের মুহুরিহাট বটতল এলাকায়। সেদিন বিকেলে হাটহাজারী উপজেলার পশ্চিম ধইল ইউনিয়নের আলী রেজা চৌধুরী বাড়ির মৃত আজিজুল হকের ছেলে শাহাদাত হোসেন অটোরিকশা চালাচ্ছিলেন চট্টগ্রাম শহরমুখী। কিন্তু আকস্মিকভাবে অটোরিকশাকে মুখোমুখি ধাক্কা দেয় মিস্টি বিপণন প্রতিষ্ঠান ‘সীজল’ এর খাবার পরিবহনকারী মিনি কভার্ডভ্যান (চট্টমেট্রো-ম-৫১-০৮৪১)। দুর্ঘটনায় চারযাত্রীসহ চালক শাহাদাত আহত হন। পরে স্থানীয়রা আহতদের উদ্ধার করে হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। কিন্তু হাসপাতালের চিকিৎসক শাহাদাতকে মৃত ঘোষণা করেন।
দুর্ঘটনার পর হাইওয়ে পুলিশ এবং হাটহাজারী থানা পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে শাহাদাতের মরদেহ দাফনের জন্য পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে প্রশাসন। কিন্তু দুই কন্যা এসবের কিছুই বুঝতে পারেনি। তারা মায়ের কাছে শুধুই জানতে চাইছে, ‘বাবা কখন ফিরবে?’, ‘বাবা আসছে না কেন?’
দুই কন্যার প্রশ্ন জবাব দিতে পারছেন না মা জান্নাতুল রেহেনা পিংকি। তিনিও সন্তানদের সঙ্গে কাঁদছেন। তিনি স্বামী হারানোর বেদনায় জর্জরিত। তার ওপর সন্তানদের এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে না। অবুঝ দুই সন্তান নিয়ে তিনি পড়েছেন অতল সাগরে। শাহাদাতের স্ত্রী জান্নাতুল রেহেনা পিংকি বলেন, ‘আমার স্বামী শাহাদাত হোসেনের কিছু জমি ছিল। কিন্তু সৎভাইয়েরা সেই জমির ভাগ দেননি শাহাদাতকে। এমনকি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সালিশী রায়ও অমান্য করেছেন সৎভাইয়েরা।’
ফলে জমি থাকার পরও ‘নিঃস্ব’ ছিলেন শাহাদাত। এখন সন্তানদের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার মতো অর্থও নেই জান্নাতুল রেহেনার হাতে। তার ওপর বড় মেয়ের লেখাপড়া ব্যয়। ছোট মেয়ের খাবার ব্যয় সামলানো দূরহৃ হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে অনাহার জীবনের সঙ্গে মিতালী হয়েছে দুই শিশু কন্যার। সম্বলহীন জান্নাতুল রেহেনা এখন দুই সন্তানকে নিয়ে সাগরে ভাসছেন। সেই ভাসমান ব্যবস্থাটুকুও বুঝতে পারছে না। ১০ বছর বয়সী আয়েশার প্রশ্ন, ‘বাবা ফিরছে না কেন?’ আর চার বছর বয়সী মাইমুনার প্রশ্ন, ‘আ-ব্বু- ক..ই?’ দুই কন্যার প্রশ্ন ধরণীর সমীরণে মিশে। কিন্তু উত্তর ভেসে আসে না। কারণ, তাদের বাবা যে হারিয়েছে অসীমের অনন্ত সোপানে..।