‘স্নায়ুবিষ’ টেস্টিং সল্ট

1

বিপ্লব কান্তি নাথ

লবণ​ হলো খাদ্যে ব্যবহৃত এক প্রকারের দানাদার পদার্থ যার মূল উপাদান হলো সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl))। এটি প্রাণীর জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য, কিন্তু অধিকাংশ স্থলজ উদ্ভিদের জন্য বিষবৎ। লবণের স্ফটিক তৈরির এর সাথে জৈব ইউরিয়ারূপে মূত্র ব্যবহার করা হয়। এর লবণাক্ততার জন্য স্বাদকে মৌলিক স্বাদের একটি বলে গণ্য করা হয়। পৃথিবীর সর্বত্র এটি খাদ্য প্রস্তুতিতে ব্যবহার করা হয়। মানুষের খাদ্যে বিভিন্ন ধরনের লবণ ব্যবহার করা হয়। যেমন অপরিশোধিত সৈন্ধব লবণ (sea salt), পরিশোধিত খাবার লবণ, আয়োডিনযুক্ত লবণ, ইত্যাদি। লবণ দেখতে দানাদার, সাদাটে বর্ণের। সমূদ্রের পানি থেকে অথবা খনি থেকে লবণ আহরণ করা হয়। লবণ একটি পানিগ্রাহী পদার্থ, তাই বর্ষাকালে লবণের মধ্যে পানি জমতে থাকে। এই আর্দ্রতা রোধ করার জন্য লবণের সাথে সোডিয়াম অ্যালুমিনোসিলিকেট অথবা ম্যাগনেসিয়াম কার্বনেট যোগ করা হয়।
আমরা প্রতিদিনকার খাবারে কিংবা খাবার টেবিলে যে লবণ ব্যবহার করতে বা দেখে এসেছি সেটিতে থাকে সোডিয়াম ক্লোরাইড। কিন্তু মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট অর্থাৎ টেস্টিং সল্টে সোডিয়াম যেমন আছে, তার সাথে আছে গ্লুটামিক এসিড। লবণের স্বাদ লবণাক্ত হলেও টেস্টিং সল্ট খেলে পাওয়া যায় উমামি অর্থাৎ স্স্বুাদু স্বাদ। এজন্যই আমরা যে খাবারকে অধিক সুস্বাদু বলি সেটি তৈরিতে টেস্টিং সল্ট ব্যবহার করা হয়। টেস্টিং সল্টে সোডিয়ামের পরিমাণ লবণের তুলনায় তুলনামূলকভাবে খুব কম।
স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট healthline উল্লেখ আছে, মূলত আট ধরনের খাবারে টেস্টিং সল্ট ব্যবহার হয়ে থাকে। এগুলো হলো, ফাস্ট ফুড (বিশেষত চাইনিজ খাবার), চিপস এবং স্ন্যাক্স জাতীয় খাবার, মসলার মিশ্রণ, হিমায়িত খাবার, স্যুপ (যেমন টিনজাত স্যুপ), প্রক্রিয়াজাত মাংস (যেমন হটডগ), মসলা(যেমন বারবিকিউ সস, কেচাপ, সয়া সস এবং ইন্সট্যান্ট নুডুলস ইত্যাদি।
টেস্টিং সল্টসমৃদ্ধ খাবার বেশি পরিমাণে খেলে বিভিন্ন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যেমন মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, ঝিমুনি ভাব, শরীরে লাল লাল র‌্যাশ ওঠা, হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, অ্যালার্জি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। এ ছাড়া টেস্টিং সল্টের গøুটামিক অ্যাসিড আমাদের দেহের জন্য একটি অপ্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড। এটি দেহে নিজে থেকেই তৈরি হয়। ফলে আমরা যখন বেশি পরিমাণে টেস্টিং সল্ট দেওয়া খাবার খাই, তখন রক্তে এই গ্লুটামিক অ্যাসিড বেড়ে যায়। এটি রক্তের মাধ্যমে মস্তিষ্কে গিয়ে স্নায়ুতন্ত্রকে উত্তেজিত করে। এর ফলে অস্থিরতা, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
আমাদের দেশে বেশির ভাগ শিশু প্রতিদিন চিপস খেয়ে থাকে। একটু লক্ষ করলেই চিপসপ্রিয় শিশুদের মধ্যে এই লক্ষণগুলো দেখা যাবে। এ ছাড়া মারাত্মক বিষয় হচ্ছে, যদি কোনো গর্ভবতী মা অতিরিক্ত পরিমাণে টেস্টিং সল্টসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করে থাকেন, তাহলে তাঁর গর্ভের সন্তান মানসিক সমস্যা নিয়ে জন্মাতে পারে। কারণ টেস্টিং সল্টের গ্লুটামেট মস্তিষ্কের নিউরনে বিভিন্নভাবে আঘাত করে এর স্বাভাবিকতা নষ্ট করে দেয়।
টেস্টিং সল্ট আমাদের জিহবার স্বাদগ্রন্থিকে উত্তেজিত করে খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি করে। ফলে যারা টেস্টিং সল্টসমৃদ্ধ খাবার খেয়ে থাকে, তাদের অন্য কোনো খাবার ভালো লাগে না। তারা ধীরে ধীরে ফাস্টফুড, চায়নিজ ফুড, চিপস, চিকেন ফ্রাইয়ের মতো উচ্চ ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবার খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে তাদের মধ্যে দেখা দেয় স্থূলতা।
অনেকে টেস্টিং সল্টের ভয়াবহতা না জেনে বাসায় তৈরি করা খাবারেও সেটি ব্যবহার করে থাকেন, যা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে ফেলে পরিবারের সবাইকে। তাই স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টিকারী টেস্টিং সল্টসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া থেকে শিশু, গর্ভবতীসহ সবাইকে বিরত থাকতে হবে।
বাংলাদেশে টেস্টিং সল্ট নামের এই বিষ ক্রমাগতভাবে জনগণের শরীরে মিশে গিয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের সৃষ্টি করছে কিন্তু সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এই বিষয়ে কার্যকর কোন ভ্রুক্ষেপই করছে না। অন্যদিকে, টেস্টিং সল্ট দেশে উৎপাদন ও বিপণন হয় বলে স্বীকার করেছে বিএসটিআই। তাদের বক্তব্য অনুসারে- বিএসটিআই ১৫৪টি পণ্যের দেখভাল করে থাকে। এর মধ্যে টেস্টিং সল্ট আইটেমটি নেই। আর মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য নয়। আইনগতভাবে এটি উৎপাদন ও বিপণন কাজে বাধা দেয়ার এখতিয়ার বিএসটিআইয়ের নেই। এটি আমদানি, উৎপাদন ও বিপণনে বিএসটিআইয়ের কোনো অনুমোদন নিতে হয় না। ফলে বিএসটিআই এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। অর্থাৎ বাংলাদেশে এই টেস্টি সল্ট আমদানি, উৎপাদন ও বিপনন করা হয় সরকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে অর্থাৎ মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট নামে। বিএসটিআই এর মতে, যেহেতু বিএসটিআইএর অনুমোদন নিতে হয়না টেস্টি সল্ট তৈরি করতে- তাই এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নিতে পারেনা বিএসটিআই। আর এর মাধ্যমে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য অধিদপ্তরের সক্রিয়তা ও দায়িত্বশীলতা কতটা নি¤œমানের। যেখানে স্পষ্ট ও প্রকাশ্যে ক্ষতিকর বিষ টেস্টি সল্ট বাজারে বিক্রি হচ্ছে এবং দেশের জনগনের স্বাস্থ্যগত মারাত্মক ক্ষতি করে যাচ্ছে সেখানে শুধুমাত্র আইনের মধ্যে না পড়ায় সরকার থেকে কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছেনা।
বলাবাহুল্য, আমাদের সংবিধানে অনুচ্ছেদ নম্বর ১৫-এ বলা রয়েছে সরকার জনগণের খাদ্য চাহিদা নিশ্চিত করবে এবং ১৮-এ বলা রয়েছে – জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন। কিন্তু সরকার আজ সেখানে ব্যর্থ। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য নীতি-২০০৫-এ বিষাক্ত অথবা ক্ষতিকারক রাসায়নিকযুক্ত খাবার বিক্রি অথবা উৎপাদন বন্ধের জন্য বলা হয়েছে। আমদানি-রপ্তানি নীতি ২০০৬-এ সার্টিফিকেট এবং বিভিন্ন পরীক্ষার কথা বলা হয়েছে। ১৯৫৯ সালের Pure Food Ordinance কে পরির্বতন ও পরিবর্ধন করে যুগোপযোগী নতুন আইন ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ সংসদে পাস হয়েছে। এই আইনে সর্বোচ্চ ৫ বছরের জেল ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু এসবের কোনকিছু প্রয়োগ হচ্ছেনা। টেস্টি সল্টের মতো বিষ বাজারে অহরহ প্রচার ও প্রসার হয়ে নীরব ঘাতকের মতো জনগণের মানবদেহে প্রবেশ করছে।
উল্লেখ্য, জনস্বাস্থ্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরীর জন্য ক্যাম্পেইন করা সরকারের দায়িত্ব-কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। ইতোপূর্বে সরকার এডিস মশা, নিপা ভাইরাস, জিকা ভাইরাস, চিকুনগুনিয়া, পোলিও সম্পর্কে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্পেইন করেছে, সরকারি খরচে জনসচেতনতার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু সরকার এই বিষ সদৃশ টেস্টি সল্টের বিরুদ্ধে কোন কার্যক্রম হাতে নিচ্ছেনা। যা অমানবিক। তাই সরকারের উচিত- অবিলম্বে স্বাস্থ্যে অন্যান্য ক্ষতিকর বিষয়ের এবং টেস্টি সল্ট বাজারে নিষিদ্ধ করা। টেস্টি সল্টের বিরুদ্ধে আলাদাভাবে সরকারি বাজেট বরাদ্দ করা, সতর্কতামূলক প্রচারণা চালানো। অন্যদিকে, যেসব মহল এই টেস্টি সল্ট দেশের মধ্যে উৎপাদন করছে তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা। জনগণের কিডনী, স্নায়ুতন্ত্র, হার্ট, লিভার ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ রক্ষা করা তথা জনস্বাস্থ্য হেফাজত করা।
বিশেজ্ঞদের ভাষ্যমতে, এটি মানবদেহের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর। মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট বা টেস্টিং সল্ট খাবার মুখরোচক বা মজাদার করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃত্রিম স্বাদ বর্ধনকারী উপাদানটির মধ্যে কোনো পুষ্টিমান নেই। এটি বেশি ব্যবহার করলে স্নায়ুতন্ত্রের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। বিজ্ঞানীরা একে ‘স্নায়ুবিষ’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
এফডিএ’র খাদ্য তালিকায় একে সাধারণ নিরাপদ খাদ্য ঘোষণা করা হলেও শর্ত দেওয়া আছে- যে সব খাবারে এটি থাকবে, সেসব খাবারের প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকতে হবে এবং সুনির্দিষ্ট মাত্রার পরিমাণ উল্লেখ থাকতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যে এই কৃত্রিম লবণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’
সামনে শুরু হচ্ছে রমজান মাস, এই মাসে ইফতারির বাহারী ও সুস্বাদু খাবারের স্বাদ বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার ব্যবহার করা হয়ে থাকে ক্ষতিকর টেস্টিং সল্ট।
পুষ্টিবিদদের ভাষ্যমতে টেস্টিং সল্ট আমদানির বিষয়ে সরকারিভাবে এখনও কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়নি। তবে জনস্বাস্থ্যে ক্ষতিকর হলে সেটির ব্যবহার বন্ধ করা সরকারের দায়িত্ব। উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ায আহবান। সাধারণ জনগণ মনে করে যদি বিএসটিআই কে আরও ক্ষমতা দিয়ে বাজার মনিটরিং এর ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে জনগণ এর সুফল পাবে।
লেখক : সাংবাদকর্মী, প্রাবন্ধিক