ডেইজী মউদুদ
সন্ধ্যা সাতটা। নগরীর এক মাত্র পাঁচ তারকা হোটেল রেডিসন ব্লু বে-ভিউর মেজবান হলের গেট ওপেনিং এর অপেক্ষায় সারিবদ্ধ লাইনে কেউ কেউ, কেউবা আবার বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্নভাবে গল্পে গুজবে মশগুল, গেট খোলার সাথে সাথেই সুশৃংখলভাবে সংগীত প্রেমী নারী পুরুষ নির্ধারিত স্ব স্ব আসন গ্রহণ করেন। লাল, নীল হলুদ আর সোনালী বাতির ঝিলিকে দর্শকশ্রোতারা যখন উন্মুখ, ঠিক তখন ই মঞ্চে আসেন অনুষ্ঠানের মূল আয়োজক বিশিষ্ট নারী উদ্যোক্তা মানজুমা মোরশেদ নাদিয়া। স্বাগত বক্তব্যে তিনি সোলস সম্পর্কে আলোকপাত করে চট্টগ্রাম তো বটেই, দেশব্যাপী সোলসের যে জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা তা অত্যন্ত চমতকার ভাবেই তুলে ধরেন। এই আয়োজন কি কারণে বা কেনো করলেন, সে বিষয়ে জানতে চাইলে মানজুমা বলেন, আমি সব সময় একটু গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে ডিফারেন্ট কিছু করার চেষ্টা করি। সেই ভাবনা এবং চিন্তা থেকেই চট্টগ্রামের এই কিংবদন্তী ও জনপ্রিয় ব্যান্ড দল সোলস এর একটি প্রোগ্রাম করার ইচ্ছা পোষন করি। কিছুদিন আগে পার্থ দা র সাথে একটি প্রোগ্রামে কাজ করেছি। তখন ই উনাকে বলি। তিনি বলেন, ঠিক আছে, আমাদের ৫০ বছর পূর্তিতে একটি আয়োজন করা যায়। তবে বেশ ব্যয়বহুল!
আবার পারফেক্ট মিউজিশিয়ান, ইন্সট্রুমেন্ট এর ব্যাপার আছে, সব মিলিয়ে পুরো বিষয়টি বেশ কঠিন। আমি চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করি। তাই আর দেরি না করেই কাজে নেমে গেলাম। মাস্টার কার্ড এর কান্ট্রি ম্যানেজার কামাল সাহেব, রেডিসন ব্লু কর্তৃপক্ষ ছাড়াও অনেকের সহযোগিতা পেয়েছি। সোলস এর প্রাক্তনীরা এসে আমাদের অনুষ্ঠানকে পূর্ণতা দান করেছেন। মিডিয়া পার্টনার ছিল ডেইলী স্টার, এন টিভি এবং দৈনিক আজাদী এদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আসলে সোলস নামটি শুনলেই আমার ৮০’র দশকের কথা মনে পড়ে। চট্টগ্রামের প্রথম এবং অত্যধিক জনপ্রিয় এই ব্যান্ড দল সংগীত জগতে নতুনত্ব আনয়ন করে দ্রæত শ্রোতাদের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। সুর আর বাণী ছাড়াও আধুনিক ইন্সট্রুমেন্ট ব্যাবহার করে গানে যে ভিন্ন আমেজ আর মাত্রা নিয়ে এসেছিলেন তা কালজয়ী তো বটেই, গানের অংগনে এই ব্যান্ড এক কিংবদন্তী হয়ে মানুষের হৃদয়ে টিকে থাকবে যুগে যুগে, কালে কালে।
১৯৭২ সালে মাত্র তিনজন তরুণ বন্ধু সাজেদ, লুলু আর রনি মিলে সাজেদের কাজীর দেউড়ির পৈত্রিক বাসায় এই ব্যান্ডের সূচনা। সাজেদের পিতা প্রখ্যাত সাহিত্যিক মাহবুবুল আলম ব্যান্ডের নাম দেন ‘সুরেলা’। আসলে সাজেদ কে ই বলতে হবে সুরেলার মূল আয়োজক। জনৈক ব্যবসায়ী ওদুদুল ইসলামের (প্রবাসী লিলেটি) আর্থিক সহযোগিতায় ইন্ডিয়া থেকে একটি লাল গিটার এক টু ব্লু কালারের গিটার এবং ড্রাম সেট কিনে আনা হয়। এসব কেনার জন্য ওদুদুল সাহেবের সাথে ইন্ডিয়া যান সাজেদের বড় ভাই বিশিষ্ট সাংবাদিক মইনুল আলম। এর পর উনাদের বাসায় চলতো নিয়মিত প্র্যাকটিস। এসময় ইন্সট্রুমেন্ট এর চাহিদা বেড়ে গেলে আর্থিক সহযোগিতা দেন দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। ধীরে ধীরে গানের লেখকরা, সুরকাররা এবং কণ্ঠশিল্পীরা যুক্ত হলে সুরেলা সোলস নামে আত্মপ্রকাশ করে।
সাজেদ, রনি, আহমেদ নেওয়াজ, শাহেদ, তপন, নকীব, পিলু, আইয়ুব বাচ্চু, নাসিম আলী, মোহাম্মদ আলী এবং পার্থ সহ অনেকেই এই জনপ্রিয় দল সোলস কে একেবারেই পরিপূর্ণতা দান করে জন প্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়। ৫০ বছর নয়, ধরতে গেলে ৫২ বছর ধরে একটি দল টিকে থাকা কি চাট্টিখানি কথা! সোলসের শুরুর দিকের অনেকেই আজ এই ব্যান্ডের সাথে যুক্ত নেই, একমাত্র পার্থ বড়ুয়া নেতৃত্ব দিয়ে সোলস কে এখনো পর্যন্ত জনপ্রিয় রেখেছেন। অনুষ্ঠানে তিনি তাই বার বার অগ্রজদের কথা বলছিলেন। তিনি এই আয়োজন সার্থক করার জন্য আয়োজক মানজুমাকে ধন্যবাদ জানান। পার্থ একাই বেশ কয়েকটি হিট পরিবেশন করেন। গান গুলোর গীতিকাররাও ছিলেন। সোলসের জনপ্রিয় প্রাক্তনী নকীব খান মঞ্চে উঠলে উল্লসিত দর্শক শ্রোতা তাকে শুভেচ্ছা জানান। উনি নিজেই যে আবেগে আপ্লুত সেই দ্যুতি দীপ্যমান তার হাসিতে, চোখে মুখে আর কথামালায়। তিনি এই আয়োজনকে অত্যন্ত সফল আয়োজন হিসেবে উল্লেখ করে আয়োজক, সোলস এবং দর্শক শ্রোতাদের প্রতি ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি শিল্পী ও কবি খালিদ আহসান কে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন। খালিদ আহসানের লেখা গান এবং নকীব খানের সুরে গাওয়া গান নদী এসে পথ, সাগরে মিশে যেতে চায় গানটি পরিবেশন করেন। অনেক গুলু জনপ্রিয় গান পরিবেশন, উপস্থিত প্রাক্তনীদের স্মৃতিচারণে ধীরে রাত বাড়তে থাকে।
নবীন আর প্রবীণ সোলস সদস্যদের কণ্ঠে ‘এই মুখরিত জীবনের চলার পথে’ কোরাস গানের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে এই সুর মূর্ছনার। গান, বাণী আর সুর মূর্ছনার রেশ নিয়েই ডিনারে অংশ নেয় দর্শক আর অতিথিরা। হলের বাইরে আর করিডোরে সোলস এর লোগো দিয়ে সাজানো বিভিন্ন স্পটে চলে প্রাণোচ্ছল দর্শকদের ফটোসুট। সোলসের বর্তমান আর প্রাক্তনীদের সাথেও ছবি তোলার হিড়িক পড়ে। সব মিলিয়ে এই আয়োজনের রেশ সংগীতপ্রেমীদের মনে থাকবে অনেকদিন।
লেখক : সাংবাদিক