সোনালী যুগের সোনার মানুষ বীজগণিতের আদিপিতা আল খোয়ারিজমি

0

এমরান চৌধুরী

মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা একঘাত, দ্বিঘাত বিশিষ্ট সমীকরণের সমাধান করে খুব মজা পায়। এ বিষয়ে যারা খুব একটা দক্ষ নয় তারাও এ দু’শ্রেণির সমীকরণ করতে চেষ্টা করে। কারণ বীজগণিতের এ অধ্যায়টি বেশ ইন্টারেস্টিং। আর যারা সদ্য এসএসসি পাস করে কলেজে পা রেখেছে তাদের অনেকের কাছে এ সমীকরণ এখনো মাথার ভেতরে তরতাজা ফুলের মতো সুবাসিত। বীজগণিত বা ইংরেজিতে যাকে অ্যালজেবরা বলা হয় তাতে একঘাত এবং দ্বিঘাত বিশিষ্ট সমীকরণ আছে। সাধারণত কোনো সমীকরণ সমাধান করে অথবা -এর একটি করে মান পাওয়া যায়। যেগুলো এক ঘাত সমীকরণ নামে পরিচিত। আবার দ্বিঘাত সমীকরণে দুটি মান পাওয়া যায়। এই দুই ধরনের সমীকরণের বিশ্লেষণধর্মী ব্যাখা তুলে ধরে যিনি জগৎব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেন, তিনি হলেন আল খোয়ারিজমি। তাঁর পুরো নাম আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে মুসা আল খোয়ারিজমি। তাঁর পিতার নাম মুসা। মায়ের নাম সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
এককালের সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা বর্তমান রাশিয়ার একটি নদীর নাম আমু দরিয়া। নদীটি আরব সাগরে পতিত হয়েছে। এই নদীর নিকটবর্তী একটি দ্বীপের কাছে যে শহরটি অবস্থিত তার নাম খোয়ারিজম। সেই শহরে আনুমানিক ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন আল খোয়ারিজমি। কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, তিনি উজবেকিস্তানের খিবা অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নামের ভেতরে সে সম্পর্কে কিছু সূত্র রয়েছে। মনে করা হয়, ‘খোয়ারিজমি’ শব্দটি এসেছে ‘খোয়ারিজম’ শব্দ থেকে। খোয়ারিজম শব্দটির অর্থ হলো কাঠের আগুনে রান্না করা মাছ বা মাংস। প্রাচীনকালে উজবেকিস্তানের খিবা প্রদেশের একটি অংশ ছিল খোয়ারিজম। তবে খোয়ারিজমি ঠিক এই অঞ্চলেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন কি না, এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে ইতিহাসবিদেরা একটি বিষয়ে একমত যে, তাঁর পূর্বপুরুষেরা এ প্রদেশে বসবাস করতেন।
আল খোয়ারিজমি তাঁর সময়কালে পাটিগণিত, বীজগণিত, ভূগোল, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যামিতি বিষয়ে প্রভূত অবদান রাখেন। তবে বীজগণিতের জন্যই তিনি সবচেয়ে আলোচিত হন।
এ ক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে বেশী উৎকর্ষতা অর্জন করেন। তার হাতেই বীজ গণিতের এই শাখাটি পরবর্তী সময়ে আরও সমৃদ্ধতর হয়। আজ পর্যন্ত গণিত বিদ্যায় যে উন্নয়ন এবং এর সহায়তায় বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যে উন্নতি ও আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে তার মূলে রয়েছে আল-খোয়ারিজমি’র উদ্ভাবিত গণিত বিষয়ক নীতিমালা।
তাঁর রচিত বই ‘কিতাব আলজিবর ওয়াল মুকাবিলা’। বইটি দ্বাদশ শতাব্দীতে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল, যেখান থেকে ‘ধষমবনৎধ’ নাম এবং শব্দটি এসেছে। বীজগণিত হল নিয়মের একটি সংকলন , যার মাধ্যমে রৈখিক এবং দ্বিঘাত সমীকরণের সমাধান খুঁজে বের করা যায়। তাঁর অ্যালজেবরা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে গণিত জগতে এর উপযোগীতা অনেক গুণ বেড়ে যায় । মধ্যযুগের আর কোন গণিতবিদই গণিত জগতে তার সমান্তরাল কর্ম উপস্থাপন করে যেতে পারেননি। এ কারণে তাঁকে বীজ গণিতের আদি পিতা বা জনক বলা হয়।
সেই সময়ে, ইসলামী বিশ্ব ছিল পান্ডিত্য ও জ্ঞানার্জনের এক শক্তিশালী কেন্দ্র। বাগদাদের গ্রন্থাগারগুলি ছিল গণিত ও বিজ্ঞানের চমকপ্রদ আবিষ্কারের জায়গা।
আল খোয়ারিজমি বাগদাদের একটি বিখ্যাত গ্রন্থাগার ‘হাউস অফ উইজডম’ এর একজন বিশিষ্ট পরিচালক ছিলেন।
তিনি পূর্ববর্তী গ্রীক ও ভারতীয় পন্ডিতদের উল্লেখযোগ্য গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ অনুবাদ ও রূপান্তর করেছিলেন।
পরবর্তী গণিতবিদদের উপর তার প্রভাব ছিল বিশাল। ইউরোপীয় পন্ডিতরা তার গণিতের এমন উপাদানগুলি শিখেছিলেন যা জ্ঞানার্জনের সূচনা করতে সাহায্য করেছিল। গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যায় তার খ্যাতি এতটাই বিশাল যে, চাঁদের একটি বিশিষ্ট গর্তের নামকরণ করা হয়েছে আল খোয়ারিজমির নামে।
পাটিগণিত বিষয়ে তিনি একটি বই রচনা করেন, যা পরে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। খ্রিস্টীয় ছয় শতকে হিন্দুগণিতবিদগণ দশমিক পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। এই পদ্ধতিকে খোয়ারিজমিই প্রথম ইসলামী জগতে নিয়ে আসেন। তার রচিত The Book of Addition and Substraction According to the Hindu Calculation (যোগ বিয়োগের ভারতীয় পদ্ধতি) তারই উদাহরণ। গ্রীক ও ভারতীয় হিন্দু গণিতবিদদের মধ্যে গণিতের যে অসূম্পূর্ণতা ছিল, সে অসম্পূর্ণতা পূরণ করেছিলেন আল-খোয়ারিজমি। তিনি শূণ্য লিখন প্রদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এই শূণ্য ব্যবহার গণিতে এনেছিল এক অসাধারণ বিপ্লব। গণিতের আরেকটি শাখা হলো ত্রিকোণমিতি। সমকোণী ত্রিভুজের তিন কোণ আর বাহু নিয়ে ত্রিকাণমিতির কারবার। আল-খোয়ারিজমি উদ্ভাবন করেন ত্রিকোণমিতির বিস্তারিত উপাত্ত।
তিনি ক্যালকুলাসের উন্নয়ন ঘটিয়ে এর আধুনিকায়ন করেন। তিনি প্রথম বীজগণিতের সমীকরণের জ্যামিতিক সমাধান নির্ণয় করেন। জ্যামিতির ক্ষেত্রে আয়ত,বর্গ, ত্রিভুজ প্রভৃতি জ্যামিতিক ক্ষেত্রগুলোর যে ধারণা দিয়েছিলেন তা হুবহু আজও একই রকম রয়েছে।
আল খোয়ারিজমি জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটি তালিকা প্রণয়ন করেন। তার এই তালিকার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, এতে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপক্রমণিকা সংযোগ করেন। এ বিষয়ে এ উপক্রমণিকাই তার প্রগাঢ় পাÐিত্যের স্বাক্ষর। তিনি দ্বিতীয় শতাব্দীর গ্রীকভাষী বহুবিদ্যাবিশারদ ক্লাউডিয়াস টলেমির ভূগোল সংশোধন করে বিভিন্ন শহর এবং এলাকার দ্রাঘিমাংশ এবং অক্ষাংশ তালিকাভুক্ত করেন। ইউরোপীয়রা এতে বিস্মিত হয়। টলেমির মানচিত্র পর্যন্ত তিনি সংশোধন করেন এবং একটি নতুন মানচিত্র সংযুক্ত করেন। তিনি টলেমির দ্রাঘিমা ও অক্ষরেখা গ্রহণ করেন, সেই সাথে তার সাথে মুসলিম দেশগুলোর বিবরণ পেশ করেন। তিনি পৃথিবীর একটি বাস্তবরূপ তৈরি করেন, যা পৃথিবীর মানচিত্র অঙ্কনে নমুনা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আল খোয়ারিজমিই প্রথম পৃথিবীকে সপ্ত মন্ডলে ভাগ করেন। এই সূত্র ধরেই আবহাওয়ার পরিমন্ডল অনুসারে পৃথিবীকে সাতটি মহাদেশে ভাগ করা হয়।
আল খোয়ারিজমি অ্যাস্ট্রোল্যাব এবং সূর্যঘড়ির মতো যান্ত্রিক যন্ত্র নিয়ে লেখালেখি করেছিলেন। তিনি পৃথিবীর পরিধি নির্ধারণ প্রকল্পে সহায়তা করেন। খলিফা আল-মামুনের জন্য একটি বিশ্ব মানচিত্র তৈরির কাজে ৭০ জন ভূগোলবিদের তত্ত¡াবধান করেন। তিনি অনেক বই লিখেছেন। তার অধিকাংশ বইই ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আবার এখন তাঁর লেখা কোনো বই খুঁজে পাওয়া যায় না। অনুবাদ কর্মের মধ্য দিয়ে এই নতুন বিজ্ঞান পশ্চিমা জগতে প্রবেশের সুযোগ পায়। এর আগে ইউরোপের কাছে বীজগণিত ছিলো একটি অচেনা বিষয়। বীজ গণিতের এই আদি পিতা আল খোয়ারিজমি ইরাকের বাগদাদ শহরে ৮৫০ খ্রিস্টাব্দে ৭০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক