মিঞা জামশেদ উদ্দীন
’৯০ দশক ছিল চট্টগ্রামে ব্যান্ড সংগীতের সোনালী অধ্যায়। অবশ্য এটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সোনালী গিটারের জনক আইয়ুব বাচ্চু। এ বরেণ্য শিল্পীর স্মরণে চট্টগ্রামের প্রবর্তক চত্বরে (মোড়ে) স্থাপিত হয় সেই সোনালী গিটার। গত ১৮ অক্টোবর দেশের খ্যাতিমান এ ব্যান্ড সংগীত শিল্পীর ৭তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়। বিভিন্ন সংগঠন ও সংগীতজ্ঞরা গভীর শ্রদ্ধার সাথে তাঁকে স্মরণ করেন। চট্টগ্রামের মাদার বাড়ি এলাকায় এই দর্শকনন্দিত শিল্পীর জন্ম হয়। ছোটবেলা থেকে অর্থাৎ শিশু-কিশোর বয়স থেকে হেলেদুলে বড় হন প্রিয় শহর চট্টগ্রামে। তাঁর আকস্মিক মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি তাঁর সহপাঠী, সংগীতবোদ্ধা ও ভক্তবৃন্দ। দেশব্যাপী শোকে-মাতনে ভারী হয়ে ওঠে। তবুও চোখের জলে ভাসিয়ে দিয়ে প্রিয় শিল্পীকে চির বিদায় জানাতে হয়।
চট্টগ্রামের আরেক পিয়ানো বাদক জেকব ডায়েস। তিনি ১৯৯০ সালে মেয়েদের নিয়ে একটি ব্যান্ড দল ‘বøু-বার্ড’ গঠন করে হৈচৈ পেলে দেন। প্রবীণ শিল্পী জেকব ডায়েস শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু সম্পর্কে বলেন, খ্যাতির শিহরণ থেকে হঠাৎ ছিঁটকেপড়া। এবং বিদায় নেওয়া। আইয়ুব বাচ্চু, জেমস ও কুমার বিশ্বজিৎ আমার চট্টগ্রামের লালখান বাজারস্থ বাসায় আসতেন। তাদের সাথে সংগীতের নানা বিষয়ে কথা হতো, আজ যেন সবই স্মৃতি। তাঁর বেশ কয়েকটি দর্শক প্রিয়তা পাওয়া গানের মধ্যে- সেই তুমি কেন এত অচেনা, সেই আমি কেন তোমাকে দুঃখ দিলাম / হাসতে দেখো, গাইতে দেখো, অনেক কথায় মুখর আমায় দেখো।
আইয়ুব বাচ্চু সম্পর্কে তাঁর সতীর্থ-বন্ধু গীতিকবি ইমরান ফারুকীর সাথে দীর্ঘ কথোপকথন হয়। তিনি বলেন, আইয়ুব বাচ্চু সংগীত জগতে আমার অন্যতম সতীর্থ-বন্ধু। আমার সাথে তাঁর হৃদ্যতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আইয়ুব বাচ্চু স্পাইডার ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট ছিলেন। এটি তাঁর জীবনে গিটারিস্ট হিসেবে উত্থানের প্রথম ধাপ বলা যায়। এ ব্যান্ড দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জেকব ডায়েস। এ ব্যান্ড দলের পরে আইয়ুব বাচ্চু ‘ফিলিংস ব্যান্ড’ দলের সাথে সম্পৃক্ত হন। এ ব্যান্ড দলটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মানিকছড়ির চাকমা রাজা মঙ্গু ও গুলু। মঙ্গু ও গুলু তাঁরা সহোদর। মঙ্গু বাজাতেন বেস গিটার, আর গুলু বাজাতেন ড্রামস্। তাদের দুই ভাইয়ের পারফরম্যান্স ছিল খুবই অসাধারণ। এবং দর্শক-শ্রোতাদের মাতাতেন। এখন এসব কল্পনা করা যায় না; আইয়ুব বাচ্চু ওই দলের সাথে বছর ক্ষাণেক বাজিয়েছেন। ওইসময় কুমার বিশ্বজিৎ-এর ব্যান্ড দল ‘রিদম ৭৭’ মুখথুপড়ে পড়ে। শেষতক তিনি ফিলিংস ব্যান্ড দলের গায়ক হিসেবে যোগদেন আইয়ুব বাচ্চু সাথে। পুনরায় আইয়ুব বাচ্চু সেখান থেকে বের হয়ে সোলস্-এর লিড গিটারিস্ট হিসেবে যোগদেন। মুলত আইয়ুব বাচ্চু একজন উচ্চ মার্গের গিটারিস্ট ছিলেন। এবং লিড গিটারিস্ট হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ হয়। তিনি সোলস্ যোগদানের ফলে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। সর্বশেষ তিনি নিজেকে খ্যাতির শিহরে একজন ব্যান্ড সংগীত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। এ জনপ্রিয়তায় তাকে রাতারাতি তারকার খ্যাতি এনে দেয়। তখনও তাকে নানা সামাজিক অপ্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হয়। বলতে হয়, চট্টগ্রাম তো অনেকটা রক্ষণশীল ভাবাপন্ন অঞ্চল। এখানে মুক্তমনা সংগীত চর্চা করার সুযোগ ছিল খুবই ক্ষীণ। এরমধ্যে আইয়ুব বাচ্চুর অবস্থান ও বিকাশ হওয়া।
৭০ ও ৮০ দশকেও ওয়েস্টার্ন বাদ্যযন্ত্রের ওস্তাদ বা প্রশিক্ষক এবং মিউজিক স্কুল খুঁজে পাওয়া ছিল দুরূহ। ঘরে ঘরে ইস্টার্ন বা দেশীয় বাদ্যযন্ত্র- হারমনিয়াম, তবলা, নাল, বাঁশি, একতারা, দুতারা, বেহেলা ও সারিন্দ চর্চার প্লাবন ছিল। এসব যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতার মধ্যেও মুড়িয়ে পড়েনি আমাদের দেশীয় গান ও নৃত্যকলা চর্চা। বরাবরই লোকজ ও দেশাত্মবোধক গান ভারতবর্ষকে মাতিয়েছে। অবশ্য একে হালকা ভাবেও দেখার সুযোগ নেই। বড়জোর এসবে তালপাতার মতো অতি সস্তা দেশিয় যন্ত্রপাতি দিয়ে লোকজ সংগীত- জারি-সারি, মারফতি, ভাওয়াইয়া, ভান্ডারি, লালনগীতি, পল্লী গীতি রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি ও আধুনিক বাংলা গানের জন্য যথার্থ বিকাশ হয়। এসব সংগীতে একধরনের নাড়ীর টানও আছে। অবশ্য পরবর্তীতে আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ওয়েস্টার্ন সংগীতের ধারা শুরু হয়। কিন্তু এ ওয়েস্টার্ন বাদ্যযন্ত্র- কিবোর্ড, পিঁয়ানো, অরগ্যান, এর্কোডিয়ান, রিদম, লিড, বেস গিটার, ড্রামস্, কঙ্গোবঙ্গ, স্যাক্সাফোন ও ট্রাম বাজানো ওস্তাদ কিংবা ইনস্টিটিউট-একাডেমি প্রতিষ্ঠা হয়নি। ফলশ্রুতিতে আইয়ুব বাচ্চু নিজেও পতিত হন এ দুরূহ অবস্থায়। এরপরও থেমে থাকেন নি গীটার শেখা। এ ক্ষেত্রে আইয়ুব বাচ্চুর প্রচন্ড ইচ্ছা শক্তিই কাজ করে।
যেকথা বলতে হয়, আইয়ুব বাচ্চু গানের জগতে হাতেখড়ি বা বিকশিত হওয়ার পেছনে যে ব্যান্ড দলটি মুখ্য হয়ে কাজ করে, ব্যান্ড দল সোলস্ এর ভুমিকা সবচেয়ে বেশি। এছাড়া ১৯৮৮ সালে তাঁর একক গানের এ্যালবাম ‘লাল গোলাপ’ বের হলে দেশব্যাপী হৈচৈ পড়ে যায়। এ্যালবাম-কেসেটটি প্রয়োজনা করেন চট্টগ্রামের আমিন স্টোর। এ্যালবামটিতে সর্বমোট ১২টি গান ছিল। সব গানের সুর ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবে ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু নিজেই। ‘লাল গোলাপ’ শিরোনামের গানটিও এ্যালবামের একটি গানের লিরিক। আইয়ুব বাচ্চু এখানে থেমে যাননি। ১৯৯০ সালে পুনরায় এলআরবি নামে আরেকটি নতুন ব্যান্ড দল গঠন করেন। এ ব্যান্ড দল এপার বাংলা ও ওপার বাংলা, সমানভাবে তুমূল জনপ্রিয়তা পায়। তিনি আমৃত্যু এ দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।
বর্তমানে চট্টগ্রামে দুটি ব্যান্ড এসোসিয়েশন সক্রিয় রয়েছে। একটা সিএমবিএ, অপরটি সিবিএফ। সিবিএফ (চট্টগ্রাম ব্যান্ড ফাউন্ডেশন) এর সভাপতি ইমরান ফারুকী। এ এসোসিয়েশনে ৩০টি ব্যান্ড দল রয়েছে- সোলজারস, অফট্যাক, প্রান্তিক, সিটি অব নাইট, ট্রাও ব্যান্ড, গোল্ডেন বয়েজ, রেইনস, মানচিত্র, শংখচিল, তরী, দ্যা রেইন, এসকেপ ব্যান্ড দল প্রমুখ।
কথা হলো, এ ইস্টার্ন বল ওয়েস্টার্ন বল, কোনোটির দিনকাল আজ ভালো যাচ্ছে। অনুষ্ঠানও তেত্রিশ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। বিশেষ করে করোনাকালিন সময়ে শিল্পী ও কলাকৌশলীরা সীমাহীন অর্থকষ্টের মধ্যে পড়তে হয়। এতে করে অধিকাংশ ব্যান্ড দল অস্তিত্বে সংকটে পড়ে। এরমধ্যে অনেক গুলো বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য একেবারে যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি তা বলবো না। তবে যথাযথভাবে সুষম বন্টন হয়নি। যার ফলে অসংখ্য সংগঠন ও সংগীতজ্ঞ সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হন। চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি মাধ্যমে যে বরাদ্দ আসে শিল্পী ও কলাকৌশলীদের জন্য, সেখানেও নয়ছয় হওয়ার অভিযোগ উঠে। জেলা শিল্পকলার নির্বাচনে ব্যাপক স্বজনপ্রীতিরও অভিযোগ ওঠে। নিজেদের পছন্দ মতো ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা। যার ফলে জেলা শিল্পকলা একাডেমির ১১২ জন সদস্য ভোটাধিকার হারায়। এ নিয়ে বাদপ্রতিবাদ কম হয়নি। হাই কোর্টের দ্বারস্থ পর্যন্ত হতে হয়। অবশেষে হাই কোর্টের নির্দেশে নির্বাচনের একদিন আগে ভোটার হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু তড়িঘড়ি করে একদিনের মধ্যে ভোটার হতে গিয়ে অনেকে বাদ পড়ে। ফিও এক লাফে তিন গুণের বেশি করে বসে। এতে করে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেকে ভোটার হতে পারেন নি। চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন শেষ নেই। দুই কি তিন বছরের মেয়াদের ওই কমিটি, টানা ৫ বছর পর্যন্ত ক্ষমতা আঁকড়ে রাখে। এমনকি সদস্যদের নিয়ে বার্ষিক একবারও সাধারণ সভা আহ্বান করা হয় না।
লেখক : মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, কবি ও কলামিস্ট