বাসুদেব খাস্তগীর
সৈয়দ মহিউদ্দিন আমাদের সংগীতাকাশের এক উজ্জ্বল তারকা। এই তারকা অতি সম্প্রতি ঝরে গেলো সুরের আকাশ থেকে। এতদঞ্চলে সংগীত পিপাসু লোকদের কাছে সৈয়দ মহিউদ্দিন অতি পরিচিত একটি নাম। অকৃতদার এই সংগীতপ্রেমীর সারা জীবন কেটেছে সংগীতের পিছনে ছুটতে গিয়ে। সৈয়দ মহিউদ্দিনের বেড়ে ওঠার যে গ্রাম ফটিকছড়ির সুয়াবিল তা আমার নিজের গ্রাম পাঁচপুকুরিয়ারই পাশে। মাঝখানে শুধু একটি নদী। নদীর নাম হালদা। নদীর পূর্ব পারে আমাদের গ্রাম, পশ্চিমে সুয়াবিল। ছেলে বেলায় দেখেছি নদীর দুপারের ছেলেদের মধ্যে দারুণ সখ্যতা। নদীর এপারে দাঁড়ালেই দেখা যেতো ওপারে বসত করা গ্রামের দৃষ্টি নন্দন দৃশ্য। সে সময়ের হালদা নদী এত বড় বিস্তৃত ছিল না। গ্রামের শুষ্ক মৌসুমে আমরা নদীচরে ফুটবল খেলায় মেতে থাকতাম। দুপারের ছেলেরা এসেই খেলায় যোগ দিু। আবার ভরা বর্ষার মৌসুমে যখন দুক‚ল ছাপিয়ে হালদা উত্তপ্ত হয়ে উঠতো নদীর পারে দাঁড়িয়ে ওপারের দৃশ্য আমরা অবলোকন করতাম। কোন দিকে ভেঙে কার সর্বনাশ হচ্ছে। আমাদের বসত বাড়ির একেবারে সোজাসোজি সৈয়দ মহিউদ্দিনের বাড়ি। নদীতে পারাপারের কোনো ব্রিজ ছিল না। (এখন একটি ব্রিজ নির্মাণাধীন)। ওপারের লোকজন নৌকা দিয়ে পার হয়ে আমাদের গ্রামের মধ্য দিয়েই ম‚ল খাগড়াছড়ি সড়ক হয়ে শহরে যাতায়ত করতো। সৈয়দ মহিউদ্দিনের সেই ছেলেবেলা কেটেছে হালদা বিধৌত গ্রামের সবুজ ঘাসের মায়ায়। আমাদের গ্রামের অনেকেরই সাথে তাঁর বেশ ভালো একটা সম্পর্ক ছিল। গান পাগল মানুষটির সাথে আমাদের গ্রামের অনেকের সাথে সম্পর্ক সেই ছেলেবেলা থেকে। তার অন্যতম কারণ ছিল আমাদের গ্রামটা তখন সংগীত ও সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম চারণভ‚মি। পূজা ও নানা উৎসবে গান নাটকে সরব ছিল আমাদের পাঁচপুকুরিয়া গ্রাম। সংগীতের প্রতি অনুরাগেই ছেলেবেলায় তাঁর প্রায়ই আসা যাওয়া ছিল আমাদের গ্রামে। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ মোহনলাল দাশের জন্মস্থানও আমাদের গ্রাম। শেফালী ঘোষের গাওয়া তাঁর লেখা বিখ্যাত ‘ওরে সাম্পানওয়ালা তুই আমার করলি দেওয়ানা’ গানটি তো চট্টগ্রামের গানের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। সেই সময়ে অর্থাৎ স্বাধীনুা পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম বেতারের সংগীত পরিচালক হিসাবে ওস্তাদ মোহনলাল দাশ মধ্যগগনে। সংগীত পাগল সৈয়দ মহিউদ্দিন সেই সূত্রে আমাদের গ্রামে আসতেন বিভিন্ন গ্রামের প্রোগ্রামেও দেখা যেতো। সবচেয়ে বড় ব্যাপার আধ্যাত্মিক ঘরানার মানুষ সৈয়দ মহিউদ্দিন। আমাদের গ্রামের অর্থাৎ হালদার পশ্চিমে সৈয়দ মহিউদ্দিনের বাড়ির একেবারে নিকটে অবস্থিত উপমহাদেশের প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ শ্রী শ্রীমৎ স্বামী গুরুদাস পরমহংসদেবের আশ্রম। সেই আশ্রমে স্বাধীনুার পরবর্তী সময়ে হেম সাধু নামে একজন ব্রহ্মচারী ছিলেন। তিনি ছিলেন সংগীতে পারদর্শী একজন লোক। সৈয়দ মহিউদ্দিনের বাড়ির কাছে বলেই তিনি শৈশবে সংগীতে সেই হেম সাধুর সাহচর্য পেয়েছিলেন বলে নিজেই জীবদ্দশায় জানিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি আরো অনেক গুণী সংগীতজ্ঞের সাহচর্য পান। আর ফটিকছড়ির মাইজভান্ডার তো আছেই। সেখানে তাঁর আসা যাওয়া ছিল। খুব ছোট বেলায় দেখেছি আশপাশের অনেক নবীন সংগীতপিপাসুদের নিয়ে তিনি মাইজভান্ডারের মেলায় যোগ দিতেন। তাঁর গ্রামের বাড়ির একটু অদুরেই হযরত সৈয়দ আবদুস সোবহান শাহ (রা.) এর মাজার শরীফ। প্রতিবছর সেখানে ওরশ অনুষ্ঠিত হয়। আমরা শৈশবে দেখতাম সেখানে রাতে কাওয়ালি গানের আসর বসতো। সৈয়দ মহিউদ্দিন সেখানে শহর থেকে শিল্পী নিয়ে যোগ দিতেন। এখনো সেখানে প্রতিবছর ওরশ হয়। আধ্যাত্মিকতার দিকটি এভাবেই যেন তার মাঝে ধীরে ধীরে স্থান করে নেয়। এরপর সৈয়দ মহিউদ্দিন গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে নিজেকে অন্যভাবে মেলে ধরেন। পরবর্তীকালে গ্রামের সাথে তাঁর একটা দ‚রত্ব লক্ষ করা যায়। গ্রামে তেমন একটা যেতেন না। কিন্তু গ্রামের ফেলে আসা মাটি ও মানুষের নিবিড় ভালোবাসাকে পুঁজি করে নিজেই হয়ে উঠেন একজন কিংবদন্তি। অনেকে আমরা সৈয়দ মহিউদ্দিনকে আঞ্চলিক গান ও মাইজভান্ডারী গানের দিকপাল বলেই জানি। কিন্তু গান রচনার প্রথম দিকে তিনি অনেক চমৎকার আধুনিক গান লিখেছেন। আমি যখন স্কুলে পড়ি আমার বাড়িতে একটা ন্যাশনাল প্যানাসনিক রেডিও ছিল। শৈশবে গ্রাম বাংলার এটি ছিল বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। আমার গান লেখালেখির যে পথচলা তাতে এ রেডিওর ভ‚মিকা অপরিসীম। পড়াশুনার ফাঁকে আধুনিক গানের অনুষ্ঠান, পল্লীগীতি, আঞ্চলিক গানের অনুষ্ঠান কিংবা বিজ্ঞাপন তরঙ্গের অনুষ্ঠান শুনতে বসা একটি নেশার মত ছিল। সে সময় আমাদের ফটিকছড়ির মোহনলাল দাশ, জিকে দত্ত ও সৈয়দ মহিউদ্দিনের লেখা গানগুলো শুনলেই মন আকুল হয়ে উঠতো। সে ভালোলাগা থেকেই আমারও গান লেখার পথের যাত্রা শুরু। সেজন্য আমাদের ফটিকছড়ির এ তিনগুণী মোহনলাল দাশ, জিকে দত্ত ও সৈয়দ মহিউদ্দিনের প্রতি আমি নানাভাবে ঋণী। তখন রেডিওতে প্রায় সময় আধুনিক গানের অনুষ্ঠানে একটি গান বেজে উঠতো, গানটির কথা ছিল ‘জলের অপর নাম জীবন হয়েছে হোক আমার জীবন নাম তুমি।’ সৈয়দ মহিউদ্দিনের লেখা তপন চৌধুরী ও বীণাপানি চক্রবর্তীর দ্বৈতকণ্ঠে এ গানটি খুবই জনপ্রিয় একটি গান ছিল। তখন সময়ের শিল্পী বা শ্রোতারা নিশ্চয়ই স্মরণ করতে পারবেন। সেই মহিউদ্দিনের হাতে আরো অনেক চমৎকার আধুনিক গান সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাঁর শিকড়ের টান, যে টানে তিনি হয়ে উঠে উঠেছেন আঞ্চলিক ও মাইজভান্ডারী গানের একজন কিংবদন্তি। তাঁর গান লেখার ধরন বিষয় বৈচিত্র্য অভিনব। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান রচনায় তিনি একটি নব জাগরণ সৃষ্টি করেছেন। তাঁর রচিত গানগুলোর ওপর চোখ রাখলেই সে বিশেষত্ব চোখে পড়বেই। তাঁর রচিত তেমন কিছু আঞ্চলিক গানের ওপর নজর রাখা যাক। যেমন- অ জেডা ফইরার বাপ/একদিন বুঝিবা জেডা একদিন বুঝিবা, বন্ধু ঘরর কামরা পুরাই দিলা চালানি পাঠাই, মেজ্যান দিয়ে মেজ্যান দিয়ে ঐতারত, সাম্পান মাঝি সাম্পান বায় আগর মতো পেসিঞ্জার ন পায়, আইচ কাইল ঢেঁইর ঘরত কম দেখা যায় ধান, অউডা কঅছে ভাইপুত ক্যেনে বলে ম্যাট্টিক পাশ গল্লি, আঁরা এই সংসারত মিলিমিশি আছি দুয়া জাল, তালাকনামা পাঠাই দিলাম চিঠির ভিতরে, আঁই কারে কইলাম কি তুঁই কি হুনিলা কি, আঁর বউয়রে আঁই হাসাইয়ম আঁই কাঁদাইয়ম, আঁর বাপর বাড়ি কধুরখীল হউরু বাড়ি গুজারা, আসকার ডিঁইর পুকপাড়ে আঁর ভাঙাচোরা ঘর, আহ্ হায় রে গরু টানের গরু গাড়ি, এই পোয়াছা আঁর বরই গাছত তোরা, কিল্লাই গেলি ঠিক ধুইজ্জ্যা ভাঙিবুল্যাই বোলার বাআ, তুঁই বন্ধু আঁর সুখ পিঞ্জরার ভাগ্যুর লটারি, পোয়ার মনু শান্তি নাই শান্তি নাই ভাত পানি ন খার, থগ্যই থগ্যই রে তে আইস্যেল ভালা, বউ আইনুু যার দুলা মিঞা গদুনাত চড়ি, গর্কি তুয়ান বন্যা খরা মহামারি ঘ‚র্ণিঝড়,তারা সাত ভাইউত্তে উগ্যা ভৈন পাতা বালি নাম পাতা বালি’,লি লি লি লি লি আঁয় আঁয় মোয়াপে, বন্ধু ঘরর কামরা পুরাই দিলা চালানি পাঠাই, মন কাচারা মাঝি তোর সাম্পানু উইটতাম নঅ প্রভৃতি। তাঁর রচিত গানগুলোতো শব্দ প্রয়োগের যে খেলা সেটা যে কারো মনকে ছুঁয়ে যায়। খাঁটি চাটগাঁইয়া শব্দের নিখুঁত ব্যবহারে সৈয়দ মহিউদ্দিনের কোনো জুড়ি নেই। এক্ষেত্রে তিনি কখনো কোনো গানে ছাড় দিয়েছেন বলে মনে হয় না। তাঁর গান লেখার মুন্সীয়ানা অনেকেরই প্রেরণার উৎস। আমি আগেই বলেছি তাঁর লেখা আধুনিক গান আমাকে নানাভাবে গান লেখায় তাড়িত করতো। বেতারের গীতিকার হবার অনেক পরে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের শিল্পী মৃদুল কুমার দের অনুপ্রেরণায় আমি কিছু আঞ্চলিক গান লেখা শুরু করেছিলাম। চট্টগ্রাম বেতারে মৃদৃল কুমার দে ও প্রয়াত দীপক আচার্য আমার লেখা বেশ কিছু আঞ্চলিক গান গেয়েছেন। বেতারে গান প্রচারের আগে গানের কপি জমা দিতে হয়। এক সময় জমাকৃত একটি আঞ্চলিক গানের কপি নিয়ে বেতারের সংগীত বিভাগের একজন আমাকে ডেকে বলেছিলেন, আপনার আঞ্চলিক গানে ‘গুরুচন্ডালী’ দোষ আছে। তিনি সম্ভবত চট্টগ্রামেরই লোক ছিলেন। বিষয়টা বোঝাতে তিনি আমাকে একটি শব্দের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন শব্দটি প্রমিত বাংলা শব্দ। ইচ্ছে করলেই শব্দটি খাঁটি চাটগাঁইয়াতে দেয়া যায়। পরে চিন্তা করলাম আসলেই কথাটি ঠিক। কারণ আঞ্চলিক গানে খাঁটি আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগই উত্তম। আমরা যারা প্রমিত বাংলায় লেখালেখির চর্চা করি তাদের মধ্যে বিভিন্ন ঘরানার গানের মধ্যে এ ধরনের শব্দের প্রবেশ অনেক সময় অবচেতন মনে ঢুকে যায়। কিন্তু সৈয়দ মহিউদ্দিন ছিলেন এ ব্যাপারে শতভাগ সচেতন একজন লেখক। তাঁর আধুনিক, আঞ্চলিক কিংবা মাইজভান্ডারী গানের সম্ভার দেখলেই তা সহজেই অনুমেয় হয়। তাঁর প্রতিটি আঞ্চলিক গানে চট্টগ্রামের নিঁখুত আঞ্চলিক শব্দের পাশাপাশি গানের বক্তব্যও থাকতো চমকপ্রদ। গানগুলোর বক্তব্যে হাসি কান্নার পাশাপাশি মানুষের জীবন সংগ্রাম, দরিদ্র নিপীড়িত মানুষের দুঃখ কষ্টসহ অনেক কিছুই উঠে এসেছে জীবন্ত হয়ে। চট্টগ্রামের অনেক শিল্পী তাঁর গান গেয়ে বিখ্যাত হয়েছেন এবং মঞ্চও কাঁপাচ্ছেন। ‘আমার সকল ব্যবসা গুণাগারি যায়-এবার আমি দোকান দেব মাইজভান্ডারের কিনারায়’ তাঁর লেখা এ অসম্ভব জনপ্রিয় এ মাইজভান্ডারী গানটি শোনেন নি এমন লোক খোঁজে পাওয়া যাবে না। এ সময়ের জনপ্রিয় গ্রাম বাংলার শিল্পী শিমুল শীলের গ্রামের বাড়ি ও আমাদের গ্রাম হালদার পাশেই পাঁচপুকুরিয়া। আগেই বলেছি ওপারেই সৈয়দ মহিউদ্দিনের বাড়ি। শিমুল শীলের বাড়ি ছিল একেবারে নদীর ক‚লেই। শিমুল শীলের সেই পুরানো বাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু নদীর দুপারের বিভক্তি গ্রাম বাংলার এ জনপদের দুজনকে ভাগ করতে পারে নি। সৈয়দ মহিউদ্দিন ও শিমুল শীলের সম্পর্ক গুরু শিষ্যের। সেই বীজ রোপিত হয়েছিলো হালদা বিধৌত গ্রামের কাদামাটির নির্ভেজাল পথ ধরে। যতটুকু জানি বাংলাদেশে গীতিকার নির্বাচনের অডিশন বোর্ডে অনেক খ্যাতিমান শিক্ষাবিদের পাশাপাশি সৈয়দ মহিউদ্দিনও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন অনেকবার। অনেক সময় বেতারে আমার সাথে তাঁর দেখা হতো, কথা হতো। পথে কখনো কখনো দেখা হলে বিনয়প‚র্ণ কথায় মুগ্ধ হতাম। আমি অনেক অনুজপ্রতিম হলেও তাঁর মধ্যে নিজেকে বড় করে দেখার প্রবণতা কখনো লক্ষ করি নি। আমার বাবার সাথে ভালো পরিচয়ও ছিলো। কথা প্রসঙ্গে একদিন শিমুল শীলকে আমি বলেছিলাম তাঁকে নিয়ে একটি লেখা লিখবো এবং শিমুলসহ একদিন দেখতে যাবো। এ কথাটা শিমুল শীল তাঁকে বলেছে বলে আমাকে বলেছিলো। লেখাটা তৈরি করে তাঁকে দেখাতেও নাকি বলেছিলেন। কিন্তু আর হলো না। আমার নানা ব্যস্ততার কারণে তা আর হয়ে ওঠে নি। এই অপারগতা আমাকে দগ্ধ করে। আমাদের চট্টগ্রামের শিল্পী সংস্কৃতি জগতের অনেকেই তাঁর পাশে ছিলেন জীবনের শেষ সময়ে। এটা আমাদের গর্বিত করে। সৈয়দ মহিউদ্দিন আমাদের সংগীতকে শুধুই দিয়েই যাবার একজন কালজয়ী মানুষ। তাঁর রাষ্ট্রীয় মুল্যায়ন সময়ের দাবি।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বি এম সি ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম
প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও শিশুসাহিত্যিক