জুলাই-অগাস্ট আন্দোলনের সময় দমন-পীড়নে জড়িত না হতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাই কমিশনার ফলকার টুর্ক। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সতর্ক করা হয়েছিল, যদি তারা দমন-পীড়নে জড়িত হয়, তাহলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হবে। আসলে আমরা সেনাবাহিনীকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলাম যে, তারা এর সঙ্গে জড়িত হওয়ার মানে হলো, তারা আর সেনাদল পাঠানো দেশ হিসেবে থাকবে না।”
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা বাড়তে থাকলে শেখ হাসিনার সরকার ১৯ জুলাই কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। এরমধ্যেই আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
পরে সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে, বিক্ষোভ ও সহিংসতা বাড়তে থাকে। মাসব্যাপী সেই আন্দোলন এক পর্যায়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। পরে ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের মধ্যে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। খবর বিডিনিউজ’র
শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনাবসানের সেই দিন প্রবেশ পথগুলো দিয়ে হাজার হাজার মানুষ ঢাকার উদ্দেশে রওনা করে। সকালের দিকে সেনাবাহিনী তাদেরকে ফেরানোর চেষ্টা চালালেও এক পর্যায়ে ঢাকায় ঢোকার পথ করে দেয়।
জনস্রোত সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে পৌঁছে যাওয়ার মধ্যে বিকালে সেনা প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ঘোষণা দেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন।
সরকার পতন আন্দোলনের সময়গুলোতে কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগ জায়গায় বলপ্রয়োগ করেনি সেনাবাহিনী। এর মধ্যে আন্দোলনের সময়টাতে সেনাবাহিনী কর্তৃক ইউএন-লোগো সম্বলিত আরমার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) এবং হেলিকপ্টার ব্যবহারের প্রতিবাদ জানায় জাতিসংঘ।
সরকার পতনের পর দেশজুড়ে থানায় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। আক্রমণের শিকার হতে থাকেন পুলিশ সদস্যরা। আগুন দেওয়া হয় থানা ও পুলিশের স্থাপনায়। লুট করা হয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ।
আন্দোলনের মধ্যে মানুষের ব্যাপক সেই ক্ষোভের সময় পুলিশের বেশির ভাগ সদস্য কাজে ফেরেননি। পরে কর্মবিরতিতে যায় পুলিশ। তাদের অনুপস্থিতিতে দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটে।
সরকার পতনের তিন দিন পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গহণ করে। নতুন সরকারের সময় কারফিউ না থাকলেও দেশজুড়ে সেনা মোতায়েন থাকে। পুলিশের অনুপস্থিতিতে শুরুর দিকে থানায় থানায় দায়িত্ব পালন করেন সেনা সদস্যরা।
এরপর গত ১৭ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীর কমিশন পাওয়া কর্মকর্তাদের সারাদেশে দুই মাসের জন্য ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয় অন্তর্র্বতী সরকার। এরপর নৌ এবং বিমানবাহিনী কর্মকর্তাদেরও একই ক্ষমতা দেওয়া হয়।
আন্দোলনের সময় সেনাবাহিনীর ইউএন-লোগো সম্বলিত আরমার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) এবং হেলিকপ্টার ব্যবহারের প্রতিবাদ জানিয়ে ছিল জাতিসংঘ।
আন্দোলনের সময় সেনাবাহিনীর ইউএন-লোগো সম্বলিত আরমার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) এবং হেলিকপ্টার ব্যবহারের প্রতিবাদ জানিয়ে ছিল জাতিসংঘ।
দ্বিতীয় দফায় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা এখনও মাঠেই আছে; অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যৌথ অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি বিভিন্ন বিশৃঙ্খলা ঠেকানোর কাজে সাড়া দিচ্ছে তারা।
গত বুধবার বিবিসি হার্ডটক অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কার্যক্রম এবং চ্যালেঞ্জ বিষয়ে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কমিশনের ভালো কাজের উদাহরণ হিসাবে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ টানেন ফলকার টুর্ক।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনসহ মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে বিভিন্ন দেশ যে ‘গুরুত্ব দেয় না’, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল তাকে।
উত্তরে জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান বলেন, “আমি আপনাকে একটা উদাহরণ দিতে পারি, যেখানে এটাকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করা হয়েছে। আমি আপনাকে বাংলাদেশের উদাহরণ দিব। জুলাই-অগাস্টে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক বিক্ষোভ সেখানে হয়েছে। শেখ হাসিনার অধীনের পূর্ববর্তী সরকারের সঙ্গে যথেষ্ট রকম (বাজে) অভিজ্ঞতা তারা পেয়েছে, সেখানে ব্যাপক দমন-পীড়নের ঘটনা ঘটছিল। তখন তাদের জন্য বড় আশা ছিল আমাদের কথা, আমার কথা এবং যেটা আমরা করতে পেরেছি এবং আমরা পরিস্থিতির উপরে আলো ফেলতে পেরেছি।”
এরপর সেনাবাহিনীকে হুঁশিয়ারি দেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “ফলশ্রুতিতে, প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূস যখন ক্ষমতা গ্রহণ করলেন তখন আমরা পরিবর্তনটা দেখলাম। পরিস্থিতির ওপর আলো ফেলার উদ্দেশ্যে তিনি আমাকে তথ্যানুসন্ধানী দল পাঠাতে বললেন। তদন্ত করতে বললেন এবং আমরা করলাম। এটা আসলে অনেক সহায়তা করেছে। গত বছর আমি বাংলাদেশে গিয়েছি। একটা ভূমিকা নেওয়ায় এবং তাদের জন্য কথা বলায়, তাদেরকে সমর্থন জানানোয় তারা আমাদের প্রতি ছিল কৃতজ্ঞ।”
ফলকার টুর্ক যে তথ্যানুসন্ধান মিশনের কথা বলছেন, গত সেপ্টেম্বরে এক মাস সেটির কার্যক্রম চলেছিল বাংলাদেশে। ইউনূস সরকারের আমন্ত্রণে আসা ওই মিশনের নেতৃত্ব দেন জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান ররি মুনগোভেন।