সেই নিষিদ্ধ কবিতার কবি মোহাম্মদ রফিক

37

সৈয়দ জেরিন

কবি মোহাম্মদ রফিকের মহাপ্রয়াণ। ৬ আগস্ট রোববার রাত ১০টার দিকে বরিশাল থেকে ঢাকা ফেরার পথে তার মৃত্যু হয়। ষাটের দশক থেকে প্রতিবাদ, দ্রোহ আর প্রেমের কবিতায় নিজস্বতা তৈরি করেছেন মোহাম্মদ রফিক। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে। ‘খোলা কবিতা’ নামে দীর্ঘ এক কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সঞ্চার করেন। তখন কবিতা লিখে এরশাদও আলোচনায়। পত্রিকার প্রথম পাতায় সামরিক শাসকের কবিতা নিয়ে যখন চলছিল আলোচনা, তখন বাংলাদেশে গোপনে হাত থেকে হাতে বিক্রি হচ্ছিল এক নিষিদ্ধ কবিতা।
‘খোলা কবিতা’ নামে সেই কবিতা কেউ প্রকাশ করতে সাহস করেনি তখন। যার কবির নাম মোহাম্মদ রফিক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন তিনি তখন। নিষিদ্ধ কবিতাটির কয়েকটি পংক্তি এ রকম, ‘সব শালা কবি হবে, পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে উড়বেই, দাঁতাল শুয়োর এসে রাজাসনে বসবেই’।
পুরো কবিতাটি ছিল অনেক দীর্ঘ, প্রায় ১৬ পৃষ্ঠা। এটি গোপনে ছাপানো হয় এক ছাপাখানায়। নিউজপ্রিন্টে এক ফর্মায় ছাপানো সেই কবিতা গোপনে বিলি করেন মোহাম্মদ রফিকের ছাত্রছাত্রীরা। হাতে হাতে সেই কবিতা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।
কীভাবে রচিত হয়েছিল সেই কবিতা, সেই কাহিনী ২০১৯ সালে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছিলেন মোহাম্মদ রফিক। তখন যিনি এখন ঢাকায় অবসর জীবনযাপন করছেন।
কবি বলেন, ‘কবিতাটি আমি লিখেছিলাম জুন মাসের এক রাতে, এক বসাতেই। আমার মনে একটা প্রচন্ড ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, মনে হচ্ছিল একজন ভুঁইফোড় জেনারেল এসে আমাদের কবিতার অপমান করছে’।
তিনি বলেন, ‘এটা শুধু এরশাদকে নিয়ে লেখা কবিতা নয়। এরশাদের মার্শাল ল জারি আমার কাছে একটা ঘটনা। কিন্তু একজন লোক, যে কোনদিন লেখালেখির মধ্যে ছিল না, ভূঁইফোড়-সে আজ সামরিক শাসন জারির বদৌলতে কবিখ্যাতি অর্জন করবে, এটা তো মেনে নেয়া যায় না’।
মোহাম্মদ রফিক ছিলেন ষাটের দশকে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। এ জন্য জেলও খেটেছেন। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের মধ্যে তিনি পাকিস্তানি আমলের সামরিক শাসনের ছায়া দেখতে পেয়েছিলেন। তার কবিতায় তিনি এর প্রতিবাদ জানালেন।
নিষিদ্ধ ‘খোলা কবিতা’ তখন নানাভাবে কপি হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। টনক নড়লো নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর। একদিন মোহাম্মদ রফিকের ডাক পড়লো সাভারে সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের দপ্তরে।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সেখানে তিনজন সেনা কর্মকর্তার মুখোমুখি আমি। তাদের প্রথম প্রশ্ন, এটা কি আপনার লেখা। আমি বললাম হ্যাঁ, আমার লেখা। আমি তাদের বললাম, আমি আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর দেব, কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর দেব না। সেটা হচ্ছে, এটি কে ছেপে দিয়েছে। কারণ আমি তাকে বিপদে ফেলতে চাই না’। এর কিছুদিন পর মোহাম্মদ রফিকের নামে হুলিয়া জারি হয়। তাকে কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকতে হয়।
কবি মোহাম্মাদ রফিক
গত ৬ আগস্ট সকালে গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের চিতলীতে অবস্থানকালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে প্রথমে বাগেরহাট এবং পরে বরিশালে নেওয়া হয়। বরিশালের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে বিভিন্ন পরীক্ষার পর বেশ কিছু শারীরিক জটিলতা ধরা পড়লে চিকিৎসকরা তাকে ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দেন। এদিন সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যরা কবিকে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় রওনা হন। একপর্যায়ে পথেই তিনি মারা যান। দৈনিক পূর্বদেশের সাহিত্য বিভাগে কবির মৃত প্রয়াণে গভীর শোকাহত, মর্মাহত। আমরা কবির বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছিÑ বি.স
(জন্ম ২৩ অক্টোবর ১৯৪৩, মৃত্যু ৬ আগস্ট ২০২৩)