নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
তৎকালীন আওয়ামী লীগের ১৩জন এমপি সম্মুখ যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তারা সেনা কর্মকর্তাদের ন্যায় মুক্তিযুদ্ধে তাদের গ্রুপকে কমান্ড করেন। এই ১৩ জন এমপি সি-ইন-সি স্পেশাল ট্রেনিং নেন। চট্টগ্রামে তিন জন এমপি সি-ইন-সি স্পেশাল ফোর্সের সদস্য ছিলেন। তারা হলেন – মির্জা আবু মনসুর, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও ডা. মান্নান। তারা জোনাল কমান্ডার ছিলেন। সাতকানিয়ার এমএনএ বিএলএফে যোগ দিয়েছিলেন, তিনি অপারেশন ঈগলের একজন কলাম কমান্ডার ছিলেন। সুলতান আহমদ কুসুমপুরী এসব কিছু ছিলেন না, তবে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেনাবাহিনীতে ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর নিয়ে একটি নিয়মিত বাহিনী গঠন করেন এবং সেই বাহিনী নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বহু সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান অন্য সকল এমপি থেকে ভিন্ন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি যে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের ইতিহাস সৃষ্টি করেন তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর দক্ষিণ হস্ত ছিলেন হাবিলদার আবু ইসলাম। তাঁকে তিনি কোম্পানি কমান্ডার নিয়োগ করেছিলেন।
সুলতান আহমদ কুসুমপুরীর জন্ম ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি পটিয়া থানার গোরনখাইন গ্রামে। তাঁর পিতার নাম কলিম উল্লাহ মুন্সী। তিনি চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের একজন বিশিষ্ট নেতা, এম এ আজিজের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী এবং ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হয়ে এমপিএ নির্বাচিত হন। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সৈনিক ছিলেন। ’৭১-এর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সুলতান আহমদ কুসুমপুরী যুদ্ধে যোগদান করেন এবং বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআরের সৈনিকদের নিয়ে নিয়মিত বাহিনীর একটি দল গঠন করে ধোপাছড়ি থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত যুদ্ধ করতে করতে ডিমাগিরি পৌঁছেন। তাঁকে ভারতীয় এসএসএফের প্রধান জেনারেল উবান তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে যুদ্ধজয়ী সুলতান আহমদ কুসুমপুরী বীরদর্পে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন।
সুলতান আহমদ কুসুমপুরী ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে রেজিমেন্ট ২৪৩-আরআইএ হাবিলদার ক্লার্ক হিসেবে যোগদান করেন। রেজিমেন্ট নং-ছিল-১৬৯৯৬৭। দীর্ঘ ৬ বছর তিনি ভারত এবং বার্মার বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। এ সময় এম.এ আজিজ (পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) তাঁকে পটিয়া থানার ন্যাশনাল গার্ডের কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দান করেন। শেখ মোজাফফর আহমদ (পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি) ছিলেন ন্যাশনাল গার্ডের সালারে জিলা বা জেলা কমান্ডার।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশভাগের এক বছর পর তিনি একটি পাকিস্তানি শিপিং কোম্পানিতে সুপারভাইজারের চাকরি নেন। পরবর্তীকালে পদোন্নতি পেয়ে ম্যানেজার হন। ম্যানেজার থাকা অবস্থায় তাঁকে চট্টগ্রাম-ঢাকা-খুলনা অফিসে কাজ করতে হয়। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করে নিজে ব্যবসা আরম্ভ করেন।
১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন ঢাকায় নতুন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ গঠিত হলে তিনি জন্মলগ্ন থেকেই উক্ত দলে যোগদান করেন। রাজনৈতিক জীবনে তিনি বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের লোক ছিলেন। তাঁর বাড়ি কুসুমপুরা ইউনিয়নে জানার পর থেকে বঙ্গবন্ধু তাঁকে আদর করে কুসুমপুরী বলে ডাকতেন। সেই থেকে তিনি কুসুমপুরী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন।
‘৬০-এর দশকের স্বাধীনতাপন্থী ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে অনেকে এমন অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম.এ আজিজ এবং তাঁর সহকর্মী এম.এ হান্নান, আবদুল্লাহ-আল-হারুন, এ, কে, এম আবদুল মান্নান, সুলতান আহমদ কুসুমপুরী এবং চাচা খালেকের অবদান সবচেয়ে বেশি। এম.এ আজিজ সর্বপ্রথম এক দফা অর্থাৎ স্বাধীনতার কথা প্রকাশ্যে উচ্চারণ করেছিলেন। স্বাধীনতার জন্য তাঁর সমস্ত কর্মকান্ডকে সফল করে তুলতে উপর্যুক্ত সহকর্মীরাই সবচেয়ে বেশি তৎপর ছিলেন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারি লালদীঘি ময়দানে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা করার জন্য জনসভা আয়োজনে মুখ্য ভ‚মিকা রেখেছিলেন উল্লেখিত নেতৃবৃন্দ। ছয় দফাকে বানচাল করার জন্য পিডিএম আট দফা দিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করলে সেই ষড়যন্ত্র বানচাল করার জন্য চট্টগ্রাম থেকে প্রায় হাজার খানেক আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মী ঢাকায় নিয়ে গিয়ে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন ঘেরাও করে ছয় দফাকে বাঁচিয়ে ছিলেন এম. এ. আজিজ এবং তাঁর উক্ত সহকর্মীরা।
’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সংসদ অধিবেশন আহবান এবং বিজয়ী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে টালবাহানা শুরু করে। আওয়ামী লীগের চাপে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ সংসদ অধিবেশন করেও ১ মার্চ এক আকস্মিক ঘোষণায় সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে বাংলার জনগণ রাজপথে নেমে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ১০ লাখ মানুষের জনসভায় অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলে সারা দেশে পাকিস্তানি প্রশাসনের সাথে বাঙালিরা অসহযোগ শুরু করেন। পূর্ব পাকিস্তান রাতারাতি বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়। পাকিস্তানি প্রশাসন অচল হয়ে পড়ে, আওয়ামী লীগের নির্দেশে দেশ পরিচালিত হতে থাকে। জনাব কুসুমপুরী পটিয়া তথা চট্টগ্রামে অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, তাঁর আহবানে দেশব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধের দামামা শুনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক কুসুমপুরী সাহেবের রক্ত নেচে উঠে। তিনি তাঁর সামরিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে প্রথমে পটিয়া গিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করে তাদেরকে ট্রেনিং দিয়ে যুদ্ধের জন্য তৈরি করতে থাকেন। পরে তিনি দোহাজারীর ধোপাছড়িতে গিয়ে তাঁর ঘাঁটি তৈরি করেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআরের অনেক সৈনিক যোগ দেন। বিডিআর, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ট্রেনিং প্রাপ্ত সিপাহীদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করেন। তাঁর বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ৪৯৫ জন। কানাইমাদারী নিবাসী বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার আবু ইসলাম তাঁর গ্রুপ নিয়ে ধোপাছড়িতে সুলতান আহমদ কুসুমপুরীর বাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি ছিলেন কুসুমপুরীর গ্রুপের কোম্পানি কমান্ডার।
এরপরে শুরু হয় যুদ্ধ; ধোপাছড়ি, মাইয়নি, মলা, ছোটহরিণা, বালুছড়ি, লেয়উছড়ি, লালমাটিয়া সহ অনেক জায়গায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন করেন তাঁরা। সর্বশেষ নোয়াপুতং বৌদ্ধ মন্দিরে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে তাঁর বাহিনীর সরাসরি যুদ্ধ হয়। যুদ্ধ করতে করতে বিভিন্ন এলাকা মুক্ত করে তিনি চট্টগ্রামে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করেন। স্বাধীনতার পর তিনি সমগ্র পটিয়ার রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে যুদ্ধ বিধ্বস্ত মানুষের মধ্যে যথাযথভাবে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন। তিনি কিছুদিন শহরে বন্দর মাঝিরঘাট এলাকায়ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন।
হাবিলদার আবু মোহাম্মদ ইসলাম একজন অসমসাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন। সেনাবাহিনীতে তিনি বক্সার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে তিনি বাড়িতে ছুটিতে ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কথা শুনে তিনি আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ফিরে যাননি। তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধেও তিনি কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন এবং অসাধারণ শৌর্যবীর্য ও বীরত্বের উদাহরণ সৃষ্টি করে খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর বাড়ি সাবেক পটিয়া ও বর্তমানে চন্দনাইশ থানার কানাইমাদারী গ্রামে। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম হামিদ হোসেন।
হাবিলদার আবু ইসলাম ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৮ অক্টোবর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন। জিয়াউর রহমান (পরে জেনারেল ও রাষ্ট্রপতি) ছিলেন তাঁর কোম্পানি কমান্ডার। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে তিনি যশোর ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন। তখন তিনি হাবিলদার, তাঁর নম্বর ৩৯৩৩২০০। খেলাধূলার জন্য তাঁদেরকে বছরে ৩ মাস ছুটি দেয়া হত। ১৩ ফেব্রুয়ারি আবু মোহাম্মদ ইসলাম ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে এবং তাঁদের এলাকায় ছাত্র-যুবকদের অসহযোগ আন্দোলন করতে দেখে তাঁর বুঝতে অসুবিধা হয়নি, দেশে একটি মহাসংগ্রাম শুরু হতে যাচ্ছে। পাকিস্তান আর টিকবে না, পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন হয়ে যাবে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানি আর্মিতে আর ফিরে যাবেন না। তাঁর দেশের মানুষ যে সংগ্রাম করছে, আবু মোহাম্মদ ইসলামও সেই সংগ্রামের সাথে যুক্ত হয়ে তাদের সাথে কাজ করবেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তানিদের গণহত্যার খবর পেলেন, ইপিআর ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপর হামলা এবং হাজার হাজার বাঙালি সৈনিককে মেরে ফেলার খবর শুনে মনটা যেমন বেদানায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল তাঁর, তেমনি প্রচÐরূপে অস্থির হয়ে উঠলেন তিনি। তাঁর ভাইদের যারা হত্যা করেছে তাদের ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্য তাঁর ভেতর আগুন জ্বলতে লাগলো। বরকল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর পুত্র শাহাজাহান ইসলামাবাদীর নেতৃত্বে এলাকার ছাত্র যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্যোগের কথা শুনলেন। ইতিমধ্যে বিমান বাহিনীর সার্জেন্ট বরিশাল নিবাসী মহি আলম জনতা ব্যাংকের আবু তাহেরের সাথে বরকল আসার খবর পেলেন তিনি। এক রাতে শাহজাহান ইসলামাবাদী, সার্জেন্ট আলম ও মোজাহের তাঁর বাড়িতে আসলেন। তারা তাঁর কাছে অস্ত্র আছে কিনা জিজ্ঞেস করেন। আবু মোহাম্মদ ইসলাম ইতিপূর্বে বৈলতলীর মোহাম্মদ সৈয়দের একটা কাজ করে দিয়ে একটি রাইফেল ও একবক্স গুলি পেয়েছিলেন, সে কথা তাদেরকে বললেন। শাহজাহান ইসলামাবাদী বললেন তাঁর সাথে মুরিদুল আলম (শহীদ), মাসুদ ফরিদুল আলম, মোজাফরুল ইসলাম, আকতার উদ্দিন আহমদ, সৈয়দ আবুল খায়ের, ডা. গোলাম মাওলা, ফেরদৌস ইসলাম খান, আহমদর রহমান প্রমুখ আছে। তিনি বললেন আমি মুক্তিযুদ্ধ করতে চাই, তাই আপনাদের সাথে কাজ করতে আমার কোন আপত্তি নেই। হাবিলদার আবু তাঁর গ্রুপ নিয়ে তাদের সাথে যোগ দিলেন। তাঁর গ্রুপে ছিলেন প্রাক্তন সেনা সদস্য মোহাম্মদ আবুল কাশেম, সেনা সদস্য আবদুল জব্বার, মোহাম্মদ আইয়ুব, নুরুল ইসলাম, ইসহাক মিয়া, আবদুল জাফর মোহাম্মদ আলী। চূড়ামণির শাহ সাহেবের বাড়ির দক্ষিণ পূর্বে প্রাইমারি স্কুলে একটি রাজাকার ক্যাম্প ছিলো, সেটি তিনি প্রথম অপারেশন করলেন। প্রথমে স্কুল দখল করে রাজাকারদের কাছ থেকে ৭টি রাইফেল উদ্ধার করেন। এরপর শাহ সাহেবের বাড়িতে আক্রমণ করেন। তাঁর সাথে এই অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন ইপিআর-এর মোহাম্মদ আইয়ুব (আমার ভাই), জব্বার, আবুল কাশেম। অপারেশন শেষে তাঁরা কাঞ্চনা ঘোষদের বাড়িতে আশ্রয় নেন।
এসএসসি পরীক্ষার সময় আসলো। হানাদার বাহিনী চাইলো এসএসসি পরীক্ষা হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের সিদ্ধান্ত এসএসসি পরীক্ষা হতে দেয়া যাবেনা। কেননা পরীক্ষা নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলে প্রমাণিত হবে দেশে সুস্থ পরিস্থিতি বিরাজ করছে, মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে না। হাবিলদার আবুর কাছাকাছি ছিলো সাতকানিয়া কলেজের পরীক্ষা কেন্দ্র। তিনি পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে প্রফেসর খাইরুল বশরকে গুলি করেন, তার গায়ে গুলি লাগেনি, গুলিবিদ্ধ হয় তার ভাই। তাঁরা কলেজের দক্ষিণে পুকুরপাড়ে পজিশন নিয়েছিলেন। তাঁর সাথে ছিলো বিএলএফ -এর আনোয়ার গ্রুপের অজিত ও রণজিত; তাদেরকে নিয়ে আবু চাইনিজ স্টেনগান দিয়ে গুলি করেন, পরীক্ষা বানচাল হয়ে গেল।
বিএলএফ-এর গ্রুপটা জুলাইয়ের দিকে ভারত থেকে বরকল আসে। এই গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন নুরুল আনোয়ার। তাঁর বাড়ি রশিদাবাদ, তাঁর বন্ধু এম এ জাফরও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আনোয়ার তাঁর গ্রুপ নিয়ে প্রথমে তাঁর ও জাফরের বাড়িতে আসে, পরে বরকল আসে। এই গ্রুপের সদস্য ছিলেন ইদ্রিস আনোয়ারী, অজিত, নাসিরুদ্দিন চৌধুরী (পরবর্তীকালে সাংবাদিক ও লেখক), রণজিত; আরও দু’জন ছিলেন, কিন্তু তাঁদের নাম আবুর মনে নেই। নাসির আবুর বাড়িতেও দু-একদিন ছিলেন, সেখানে গফুর নামে একজন ছিলেন।
সাতকানিয়া থেকে অপারেশন শেষে বরকল ফিরে আসলে সার্জেন্ট আলম হাবিলদার আবুকে বলেন একটা কাজ আছে। শাহজাহান ইসলামাবাদী বললেন আবুকে আবার সাতকানিয়া যেতে হবে। আলম বললেন, না আবু যেতে পারবে না, তার অন্য কাজ আছে। সেই কাজ হলো আনোয়ারা থানা অপারেশন।
২২ সেপ্টেম্বর রাতের শেষ প্রহরে, আনুমানিক ভোর ৫টায় আনোয়ারা থানা আক্রমণ করা হয়। সমস্ত পরিকল্পনা সার্জেন্ট আলমের, সার্বক্ষণিক কমান্ডেও ছিলেন তিনি। অপারেশন কমান্ডার হাবিলদার আবু। অপারেশনের পূর্বে থানার চারপাশের অবস্থান, মুক্তিযোদ্ধারা কোথায় পজিশন নিতে পারেন, প্রয়োজনে উইথড্র করতে পারেন, থানার পুলিশদের ডিউটি আহার ও বিশ্রামের সময় সমস্ত কিছু রেকি করে জেনে নেওয়া হয়। পটিয়ার গ্রুপ কমান্ডার মহসিন খানের কাছ থেকে এসএলআর ও এল.এম.জি আনা হয়। আক্রমণে অংশ নিয়েছিলেন সুবেদার আবদুল লতিফ, সুবেদার সিরাজ, হাবিবুর রহমান (বর্তমানে চেয়ারম্যান- বরকল ইউনিয়ন), ফেরদৌস ইসলাম খান, আহমদর রহমান, মজহারুল ইসলাম, আবদুল লতিফ, মোহাম্মদ কাশেম, বিএলএফ এর আনোয়ার গ্রুপের নাসির (নাসিরুদ্দিন চৌধুরী, সাংবাদিক), জব্বার, সোলায়মান, মালেক, মোহাম্মদ, ইসলাম খান, শাইর মোহাম্মদ, আলমগীর-১, আলমগীর-২, দুদু মিয়াসহ আরো অনেকে, যাদের নাম সাক্ষাতকার প্রদানের সময় হাবিলদার আবু মনে করতে পারেননি, সেজন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনদিকে পজিশন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা থানা আক্রমণ করেন। থানার দক্ষিণ-পূর্বে বর্তমানে যেখানে মিষ্টির দোকান আছে, সেখানে পজিশন নিয়েছিলেন হাবিলদার আবু ও সুবেদার লতিফ, পূর্ব কোণে সুবেদার সিরাজ ও হাবিবুর রহমান, উত্তর কোণে পুকুরের পশ্চিম পাড়ে রেজিস্ট্রি অফিসের সামনে বর্তমানে যেখানে পূবালী ব্যাংকের অফিস আছে, সেখানে ফেরদৌস, আহমদর রহমান এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা পজিশন নিয়েছিলেন। তাদের ফায়ার পাওয়ার ইত্যাদি ভালোমত খোঁজ-খবর নিয়ে, রেকি করে তবেই অপারেশনের পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। অপারেশনের পূর্বে মুক্তিযোদ্ধারা তৈলারদ্বীপে কমান্ডার সুবেদার আবদুল লতিফের বাড়িসহ বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে অবস্থান নেন। তাদের কাছে এলএমজি, এফএমসি, এসএমজি, থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও গ্রেনেড ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা যখন ফায়ার শুরু করেন, তখন ওসি ও দুজন পুলিশ (তারা থানায় ছিলো) ছাড়া অন্যরা ব্যারাকে ছিলো। মুক্তিযোদ্ধারা ব্যারাককে টার্গেট করে আক্রমণ পরিচালনা করেন। ফলে তাদের হতাহত হয় বেশি। প্রায় ২৩/২৪ জন পুলিশ মারা যায়, আর কিছু লাফিয়ে পুকুরে পড়ে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়। এই অপারেশনে হাবিলদার আবুর বাম হাতে গুলি লাগে। ১১ জন পুলিশ বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে তাদের দলে যোগ দেয়। থানা শিক্ষা কর্মকর্তা এয়াকুবকে মুক্তিযোদ্ধারা ঘরে নিয়ে যান এবং তাকে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করতে বলেন। সার্কেল অফিসারের (সিও) মেয়ে তাঁর হাতের ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করে দেয় এবং ওষুধ দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা নৌকা করে মৌলভী বাজারে চলে আসেন, হাবিলদার আবুর সাথে একজন সিপাহী ছিলো। অন্যরা বাঁশখালীর পুকুরিয়ার পাহাড়ে চলে যায়।
এক রাজাকার কমান্ডার, তার নাম আবদুল হাকিম আনোয়ারায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। বাড়ি ছিলো ওষখাইন। সে মানুষের ঘরবাড়িতে হানা দিয়ে লুটপাট চালাত, মারধর করতো। সংখ্যালঘুদের ওপর তার অত্যাচারের মাত্রা ছিল বেশি। মা বোনদের ওপর নির্যাতন করতো, বাড়িঘরে তল্লাশি চালিয়ে সোনাদানা নগদ টাকা-পয়সা যা পেতো, লুট করে নিতো, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিতো। পাকিস্তানি সৈন্যদের ডেকে এনে হত্যাকান্ড চালাতে প্ররোচিত করতো। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে সে এত কুখ্যাতি অর্জন, করেছিলো যে, স্থানীয় দালালরা তাকে টিক্কা খান খেতাব দিয়েছিল। এমনি পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নিলেন তথাকথিত টিক্কা খানকে খতম করে রাজাকারদের মনোবল ভেঙ্গে দিতে হবে। খতম পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব বর্তায় হাবিলদার আবুর ওপর। তিনি একটি গ্রুপ নিয়ে একদিন টিক্কা খানের বাড়ি ঘেরাও করেন। কৌশলগত অবস্থানের দিক থেকে তার বাড়িটি বেশ ভাল অবস্থানেই ছিল। অপারেশনের রাতে টিক্কা খানের বাড়ির কাছাকাছি একটি হিন্দু বাড়িতে আবু তার গ্রুপ নিয়ে আশ্রয় নেন। পরদিন বরকল খাল দিয়ে নৌকা নিয়ে লক্ষ্যস্থলের নিকট পাড়ে ওঠে তিনদিক দিয়ে হাকিমের বাড়ি ঘেরাও করলেন। খোলা জায়গা হওয়ায় হাকিম তাদের দেখতে পায় এবং আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নেয়। আবু তাঁকে সারেন্ডার করার নির্দেশ দিলে সে আবুকে লক্ষ্য করে পর পর তিন রাউন্ড রিভলভারের গুলি ছোঁড়ে। হাবিলদার আবু একটি গাছের আড়ালে পজিশন নিয়েছিলেন বলে রক্ষা পান। পরে আবদুল হাকিম পুকুরে নেমে ডুব দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। গুলি করলে কখনো সে ডুব দিয়ে সরে যায়, আবার কখনো সাঁতরে অন্যদিকে চলে যায়। এক সময় সে নেতিয়ে পড়ে এবং তাঁদের গুলিতে তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়। এই অপারেশনে আরো দু’তিনজন রাজাকার মারা যায়। টিক্কা খানের অপারেশনে হাবিলদার আবুর সাথে তাঁর গ্রুপের সেনাবাহিনীর দু’তিনজন সদস্য এবং বিএলএফের নাসিরুদ্দিন চৌধুরী ছিলেন। (ক্রমশ)
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক