জিএম মামুনুর রশিদ
বাংলাদেশের ইসলামী পরমন্ডলে যাঁরা এক বিশেষ স্থান অধিকার করেছেন, তাঁদের মধ্যে হযরত অধ্যক্ষ আল্লামা আহমদ হাসান (রহ.) অন্যতম। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম জেলার হালিশহর দরবার শরীফের প্রখ্যাত খলিফা এবং বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সুফি সাধক। হযরতুলহাজ্ব আল্লামা অধ্যক্ষ আহমদ হাসান (রহ.) শুধু চট্টগ্রামের নয়, বরং গোটা বাংলাদেশের ইসলামী সমাজে একটি আলোকবর্তিকা হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল ঈমান ও তাওহীদের জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নিবেদিত।
হযরত অধ্যক্ষ আল্লামা আহমদ হাসান (রহ.) ১৯০৬ সালে চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা উপজেলার ৩নং রায়পুর ইউনিয়নে উত্তর পরুয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল আছলত খাঁ এবং মাতার নাম আমেনা বেগম। তিনি একটি অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, যা তাঁর জীবনে ধর্মীয় চেতনা ও মরমী সাধনার গঠনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
শিক্ষা জীবন: হযরত আল্লামা আহমদ হাসান (রহ.) ছোটবেলায় তাঁর মায়ের কাছে প্রথম শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর তিনি চট্টগ্রামের প্রখ্যাত সুফি আলেম আল্লামা সৈয়দ আফাজ উদ্দিন শাহ (রহ.) (‘বুড়া হুজুর’ নামে পরিচিত) থেকে গভীর তরিকত ও সুফিবাদের শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর সান্নিধ্যে আসার পর, তিনি ইসলামের মরমী দিকগুলিতে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেন এবং নিজের জীবনে তা অনুসরণ করতে শুরু করেন। আল্লামা আহমদ হাসান (রহ.) পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় গমন করেন। সেখানে তিনি ইসলামিক ফিকহ, তাফসির, হাদিস ও তরিকত সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। ভারতের দেওবন্দের পবিত্র মাটিতে তাঁর পড়াশোনার পরিধি আরো বিস্তৃত হয় এবং তিনি জ্ঞানী ও পন্ডিত আলেম হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।
শিক্ষকতা ও কর্মজীবন: হযরত আল্লামা আহমদ হাসান (রহ.) একজন জ্ঞানী শিক্ষকও ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম ওয়াজেদিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন এবং পরে আনোয়ারার চুন্নাপাড়া মনিরুল ইসলাম ফাযিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত নিবিড় এবং তিনি শিক্ষার্থীদের মাঝে ইসলামের সঠিক জ্ঞান ও সুন্নতী জীবনযাত্রা গড়ে তোলার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। এছাড়া, তিনি দীর্ঘ ৪৭ বছর ধরে পশ্চিম বরৈয়া জামে মসজিদে খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর খুতবাগুলো ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং এতে জনগণের ধর্মীয় জীবনে গভীর প্রভাব পড়ত। তিনি ঈমান, তাওহীদ, পরহেজগারি, এবং সুন্নাতী জীবনযাপনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন।
খেলাফত : হালিশহরের প্রাণপুরুষ, আধ্যাত্মিক সম্রাট, পীরে কামেল, শাহসূফী হযরত হাফেজ মনির উদ্দিন নুরুল্লাহ্(রহঃ)’র হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন পরবর্তী আল্লামা আহমদ হাসান (রহঃ)’কে খেলাফত দেয়। একই সাথে খেলাফত দেওয়া হয় কুতুবদিয়া দরবার শরীফের প্রাণপুরুষ আবদুল মালেক আল কুতুবী, আল্লামা মুছা মুজাদ্দেদী সহ আরো অনেককে।
সুফিবাদ ও মরমীবাদ : হযরত অধ্যক্ষ আল্লামা আহমদ হাসান (রহ.) ছিলেন একজন বড়ই কামেল সুফি সাধক এবং মরমী আলেম। তিনি শুধু শাস্ত্রীয় শিক্ষা অর্জন করেননি, বরং তাঁর অন্তর্গত আত্মিক উন্নতির জন্য তাঁর জীবন ছিল সেরা উদাহরণ। তিনি ইসলামের সুফিবাদ ও মরমীবাদকে তাঁর জীবনে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তাঁর সুফি শিক্ষা ও সাধনা ছিল এক আধ্যাত্মিক পথ, যা মানবজীবনকে সত্য, শান্তি, এবং দয়া ও মায়ার দিকে পরিচালিত করে। তিনি হাজার হাজার মুরিদ তৈরি করেছেন, যারা তাঁর প্রতি অবিচল বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন। তিনি শিক্ষাদানের পাশাপাশি আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণেও নিয়োজিত ছিলেন, তাঁর মুরিদদের মধ্যে অনেকেই আজও তাঁর শিক্ষার অনুসরণ করেন।
কেরামত ও মাহাত্ম্য : হযরত আল্লামা আহমদ হাসান (রহ.) ছিলেন একজন মহান কামেল পীর। তাঁর অসংখ্য কেরামত লোকমুখে শোনা যায়। বহু মানুষ তাঁর রহমত ও দোয়ার বরকতে বিপদ থেকে মুক্তি পেয়েছেন এবং তাঁদের জীবনে শান্তি ও কল্যাণ এসেছে। তাঁর কেরামতী ক্ষমতা ছিল তাঁর গভীর তরিকত চর্চা এবং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও ভরসার ফলস্বরূপ।
মাজার শরীফ ও তার অনুসারী: হযরত আল্লামা আহমদ হাসান (রহ.) ইন্তেকাল করার পর, আনোয়ারার মাজার শরীফে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর মাজারে প্রতি বছর ওরশ শরীফ অনুষ্ঠিত হয়। এই ওরশে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মানুষ উপস্থিত হন এবং দোয়া মাহফিল ও শিরকাত করে তাঁদের দোয়া গ্রহণ করেন। এই সময়ে হাজার হাজার ভক্ত তাঁর মাজার শরীফে গিয়ে তাঁর রহমত ও আশীর্বাদ লাভের চেষ্টা করেন। তাঁর মাজারে গিয়ে যেকোনো ব্যক্তি যেন হৃদয়ের গহীনে শান্তি ও নূর লাভ করেন, সেই লক্ষ্যেই এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তার মাজার শরীফের আশেপাশে মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যেখানে তাঁর অনুসারীরা ইসলামের শুদ্ধ শিক্ষা ও সুফিবাদের অনুশীলন করেন।
ইন্তেকাল ও শেষ বিদায় : হযরত অধ্যক্ষ আল্লামা আহমদ হাসান (রহ.) ২০১১ সালের ১১ ফেব্রæয়ারি শুক্রবার সকালে ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে চট্টগ্রামসহ পুরো দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। তিনি দীর্ঘ ১০৫ বছর বয়সে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেন। তাঁর জানাজার নামাজে লাখ লাখ জনতা উপস্থিত হন। প্রথম জানাজা পড়ান তাঁর বড় শাহজাদা মাওলানা ছালেহ আহমদ, দ্বিতীয় জানাজা ছোট শাহজাদা মাওলানা হাফেজ মুহাম্মদ নুরুচ্ছাফা, এবং তৃতীয় জানাজা মাওলানা বদিউর রহমান পড়ান।
আমার পরম সৌভাগ্য হুজুরের ইন্তেকালের পরে তাঁর লাশ বহনকরা খাটিয়া নিজে বহন করে জানাজার মাঠ ও কবরস্থান পর্যন্ত নিতে পেয়েছিলাম।
হযরত অধ্যক্ষ আল্লামা আহমদ হাসান (রহ.) ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক শিক্ষক, একজন গুণী আলেম, এবং একজন সুফি সাধক যাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল মানুষকে ইসলামের সঠিক পথ দেখানো। তাঁর জীবন ছিল অক্ষয় দৃষ্টান্ত, যা প্রমাণ করে যে ইসলামের সঠিক শিক্ষা ও পরহেজগারী জীবনের মাধ্যমেই মানুষ আধ্যাত্মিক শান্তি ও সুখ লাভ করতে পারে। তিনি আমাদের মাঝে জীবিত রয়েছেন তাঁর অমূল্য শিক্ষা, কর্ম এবং রহমতের মাধ্যমে।
লেখক : প্রধান নির্বাহী, জুঁইফুল, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম