সুদ

316

আবদুল হাই

আল্লাহ্পাক ব্যবসাকে বৈধ করেছেন, সুদকে করেছেন নিষিদ্ধ। সুরা রুম, আয়াত নং ৩৯, আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মানুষ! ধন সম্পত্তি বৃদ্ধির জন্য তোমরা যে সুধী বিনিয়োগ করো, আল্লাহর কাছে তা বৃদ্ধি পায় না। কিন্তু আল্লাহর সন্তোষ্টি লাভের জন্য শুদ্ধচিত্তে যা দান করো, তা-ই বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
সুরা বাকারার ২৭৫ নং আয়াতে বর্ণিত আছে, যারা সুদ (রিবা) খায় তাদের অবস্থা হচ্ছে শয়তানের স্পর্শে সহজাত বিচার বুদ্ধি লোপ পাওয়া ব্যক্তির মতো। এজন্যেই তারা বলে ব্যবসাতো সুদের মতোই, অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন সুদকে হারাম করেছেন। কিন্তু এ বিধান জানার পরও কি সুদ খেতে থাকবে, জাহান্নাম হবে তাদের নিবাস সুদী অর্থ আল্লাহর রহমত থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। আল্লাহ তাদের অপছন্দ করেন।
সুদকে মুনাফা বললেই তা হালাল (বৈধ) হয়ে যায়না মুসা(আ.) তার উম্মতের জন্য সুধকে হারাম ও তিরস্কারযোগ্য অপরাধরূপে সাব্যস্ত করেছেন। মধ্যযুগে খ্রিস্টান ধর্মযাজক গণসুদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। সুদ গ্রহন ধর্মীয় অনাচার রূপে নিন্দনীয় ছিলো। কার্লমার্কস ও তার অনুগামীরা ও সুদ গ্রহণ করাকে অপদ্রব্য হরণের শামিল বলে গন্য করেছেন। প্রাচীন ব্যবিলনীয় হামুরাবি আইনে ও সুদের ব্যাপারে নিষেধ আরোপ ছিলো। তারপর ও পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সুদের যৌক্তিকতা স্বীকার করা হয়।
কোরআন ও সুন্নাহ ইসলামি আইনে সুদকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে বর্ণনা করে একে হারাম ঘোষণা করেছে। ইসলাম পূর্ব তথা আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগে অনুৎপাদনশীল ঋণের উপর ধার্যকৃত সুদকে হারাম ঘোষণা করা হয়।
বিশ্বমানবতার সর্বোত্তম বন্ধু হযরত মোহাম্মদ (স.) ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণে ঘোষণা করেন আজ হতে সুদ রহিত করা হলে। আমি আমার বংশের আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের প্রাপ্য সুদ সর্বপ্রথম বাতিল ঘোষণা করলাম। সুদের ভয়াবহ পরিণতির ব্যাপারে মহানবীর ৪০টির ও অধিক হাদিস আছে। সুদের গ্রহণকারী ও সুদ প্রদানকারী, সুদের সাক্ষ্যদানকারী সুদের লেখকদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত(বুখারীও মুসলিম) সুদকে আরবিতে Riba বলা হয় হিব্রুভাষায় Ribbit, স্প্যানিশ ভাষায় Usura, গ্রিক ভাষায় Tokos ঊর্দূও বাংলায় সুদ, ইংরেজিতে Usury বা Interest এবং ফ্রান্স ভাষায় Usure বলা হয়। এক দেশের সংগত সুদের হার অন্যদেশের জন্য জুলুম হিসেবে প্রত্যাখ্যাত। ১৯২০ সালের দিকে অনেক সমবায় সমিতি ১২% থেকে ১৫% হারে সুদ নির্ধারণ করতো এ হার নিয়ন্ত্রণ করার ব্যপারে কোন নিয়ন্ত্রক সংস্থা ছিলোনা। আজকের দিনে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক সিঙ্গেল ডিজেটে সুদের হার নির্ধারণের ঘোষণা আসলে যা অনুসরণে সরকারি ব্যাংকুলোতে বাধ্যবাধকতা থাকলেও বেসরকারি ব্যাংক এ নিয়ে অনুসৃত হতে দেখা যায় না। কোন কোন বেসরকারি ব্যাংক ১১% থেকে ১৩.৫০% সুদের হার নির্ধারণ করে থাকে। ব্যাংকের সুদের হার ৯% হউক বা ১১.৫০% যা হউক না কেন, তবে চক্রবৃদ্ধি সুদের নিয়ম ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের পথে অন্তরায়। উচ্চ সুদের হার ব্যবসায়ের অধঃপতনের মূল। যাকিনা মুনাফার হারকে সংকুচিত ও নিঃশেষ করেদেয়। ক্রমে সুদের লাগাম টানতে টানতে কারবার ও শিল্প প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে পড়ে। ব্যবসায়িক মুনাফা সংকুচিত এবং অত্যাধিক ঝুঁকির কারণে সুদ প্রাপ্যতার নিশ্চয়তার লোভে অনেকে, ব্যবসা পরিত্যাগ করে সুদে টাকা খাটিয়ে অলস ও অকর্মন্য জীবনযাপনে অভ্যস্থ হয়ে ওঠে। আসল টাকা এখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং ঝুঁকিহীন। Thus interest induce the capital holder to be more and more logy. The whole burden lieg on the borrower. He has to pay the principal amount of loan+interest of using money to his lender. All risk lies on the shoulder. অর্থাৎ এভাবে একজন পূঁজির মালিক অলসে পরিণত হয়। ঋণগ্রহীতাই সমস্ত ভার বহন করে। তাকে মূলটাকা + সুদের টাকা ধার প্রদানকারীকে অর্থব্যবহারের জন্য প্রদান করতে হয়। সমস্তঝুঁকি তার স্কন্দে। ব্যবসাতে লাভ অনিশ্চিত হলেও সুদ পরিশোধের বিষয়টা নিশ্চিত। এক কালে কাবুলিওয়ালা সুদখোর এদেশে সাধারণ লোকদের কাছে সুদে টাকা লাগাতো সকালে এসে ঘরের দুয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো গ্রাহকদের বলতো হ্যাম সুদ মাংতার আসলতো নেহিমাংগা ইয়ে ভাই, দরওয়াজা খুলিয়ে। তড়িৎ গতিতে সুদে ঋণ প্রাপ্তির মূল আঁকড়া হচ্ছে কতিপয় জুয়েলাড়ি দোকান। ঐ দোকানে স্বর্ণ বেচাবিক্রির চাইতে স্বর্ণালংকার বন্ধক নিয়ে মাস ভিত্তিতে হাজারে ৩০ টাকা সুদে নগদ অর্থ সরবরাহ করার হয়। অর্থাৎ বার্ষিক শতকরা সুদ ৩৬%। এতে উচ্চ গ্রাহকরা স্বর্ণ বন্ধক রাখে, নির্দিষ্ট মেয়াদে কিন্তু মেয়াদী এ বন্ধকীর স্বর্ণমূল্য অর্ধেকের চাইতে কম ধরে ঋণের অর্থ যোগান দেওয়া হয়। মেয়াদপূর্তির পর অনেক সময়ে সুদাসলে প্রাপ্তি দ্বিগুণ হয়ে গেলে তা প্রাপ্তি পরিশোধে অনাদায়ের কারণে স্বর্ণ হাতছাড়া হয়ে পড়ে।
ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে গৃহিত ঋণ দ্বারা ঋণ গ্রহিতার উপকার হোক বা নাহোক, ব্যবসা চলুক বা না চলুক, লাভ হউক আর তাতে ঋণদাতার কিছুই আসে যায়না। ঋণ গ্রহিতা সুদ পরিশোধে বাদ্য লগ্নীকারীর লাভ উদ্যোক্তার ঝুঁকি বা লাভের বিষয়টা বাদ দিয়ে সমস্ত ঝুঁকি বা লোকসান এক পক্ষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া অযৌক্তিক। সুতরাং ব্যক্তি বা কোন প্রতিষ্ঠানকে শিল্প বাণিজ্যে অংশগ্রহণের জন্য ঋণ দিলে লাভ লোকসানের আনুপাতিক অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। মনেকরি ব্যাংক কোন ক্ষুদ্রায়তন ব্যবসায়ীকে ৩ বছর মেয়াদী একটা ৩ লক্ষ টাকা অর্থায়ন করেছে তার প্রতিমাসে দেয় কিস্তির পরিমাণ (১৩% সুদ সমেত) ১০,৫০০ টাকা, অর্থাৎ ৩৬ কিস্তিতে গ্রাহককে (১০,৫০০ * ৩৬)= ৩,৭৮,০০০ টাকা পরিশোধ করতে হবে। (৩,৭৮,০০০-৩,০০.০০)=৭৮০০০ টাকা ঋণ গ্রহীতার ব্যবসা বা উৎপাদনের খরচের সংগে যুক্ত হচ্ছে। বিলম্বে ঋণ পরিশোধে কারণে যদি কোন পেনাল্টি হয় তাও গ্রাহককে পরিশোধ করতে হয়। তাও খরচের বা উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়। এরপর আবগারীশুল্ক, ভ্যাট, আয়কর ব্যয়, শ্রমিক কর্মচারীর বেতন। এসবকিছু ঝুঁকি ব্যবসায়ী বা উৎপাদন প্রতিষ্ঠানকেই বহন করার পর মুনাফা বা লোকসানের ঝুঁক্ িঅর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সুদ মুচ্ছিমেয় কিছু লোকের হাতে সম্পদকে পুঞ্জীভূত করতে প্রদান অস্ত্র হিসেবে কাজ করে। ঋণ থেকে পাওয়া অতিরিক্ত অর্থের কোন কাউন্টার ভ্যালুনেই। অথচ ব্যবসা করে মুনাফা অর্জন করতে গেলে ঝুঁকি, দায়, কাজ, প্রচেষ্টার মতো কাউন্টারভ্যালু থাকে। অর্থনীতিবিদ কেইন্স বলেন, অর্থের নিজস্ব উৎপাদনশীলতা নেই। উৎপাদনের উপকরণ হচ্ছে ল্যান্ড, লেবার, ক্যাপিট্যাল, অরগেনাইজেশন। অর্থাৎ ভূমি, শ্রমিক মূলধন, এবং ব্যবস্থাপনা। উৎপাদন প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজন অর্থ। এ অর্থ যোগানদাতা সুদের বিনিময়ে অর্থায়ন করে থাকে। জেমস রবার্টসন বলেন, The role of interest is to supply money from those who have less by those who have more. সুদের ভূমিকা হচ্ছে অর্থ যাদের স্বল্প তাদেরকে অর্থের যোগান দেওয়া অর্থাৎ যাদের আছে, যাদের নেই এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য প্রবল করে তোলে। এটাই হচ্ছে পুঁজিবাধী সমাজ ব্যবস্থার মুখ্য উদ্দেশ্য। এভাবে ধনী আরো ধনী, গরিব আরো গরিব হচ্ছে। বিশ্বের ৬০% সম্পদের মালিক মাত্র ২০% ধনী। সামস্টিক অর্থনীতিতে (Macro Economics) অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে সম্পদের সুষম বন্টন আবশ্যক। উচ্চ সুদের হারে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন অসম্ভব ব্যাপার। সুদের হার যতই বৃদ্ধি পাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ততই কম হবে। সুদের হার যতই কমবে অর্থনৈতিক প্রসৃদ্ধি ততই বৃদ্ধি পাবে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা মূলত সুদনির্ভর। অতএব উচ্চতর সুদের হার বিদ্যমান রেখে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন সুদূর পরাহত। ব্যাপারটা অনুধাবন করে প্রধানমন্ত্রী সিঙ্গেল ডিজিট সুদের হার প্রবর্তনের ঘোষণা দেন। অর্থাৎ এক অংকের সুদের হার। যা সর্বোচ্চ অংক ৯% হার, দেশে ব্যাংকের সংখ্যা ৬০টি তৎমধ্যে সরকারি ব্যাংক হাতেগুনা মাত্র কয়েকটা। সরকারি কয়েকটা ব্যাংক ৯% সুদের হারে অর্থায়ন করলেও বেসরকারি ব্যাংক তা মানতে নারাজ। তাদের প্রচলিত সুদের হার ১১.৫০% বা এর অধিক। ব্যাংকে যারা আমানতকারী বিশেষকরে স্থানীয় আমানতের ওপর সুদের হার ন্যূনতম হওয়ায় এসব আমানতকারীগণ ডিপোজিট পেনসন স্কীমের দিকে ঝুঁকে পড়েছে পক্ষান্তরে অর্থের চাহিদা বেশি সে অনুপাতে যোগান কম। এদিকে খেলাপী ঋণ অন্যদিকে অর্থের চাহিদা বৃদ্ধি এবং আমানতকারীরা ব্যাংক অর্থজমা প্রদানে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াতে তারল্য সংকটের মুখোমুখি। যোগানকৃত অর্থ ৬০টি ব্যাংকে বন্টিত হয় তবে অংকটা সন্তোষজনক নয়। বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকের চাইতেও উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র হচ্ছে ক্যাপিট্যাল মার্কেট বা পুঁজিবাজার তাও আমরা দীর্ঘদিন হাতের গ্রীবে ধরে রাখতে পারলাম না। এ সর্বনাশটা আমরা আমাদের নিজ হাতে করেছি।