সীতাকুন্ডের পাহাড়ে চাষাবাদে ১০ হাজার কৃষকের জীবিকা

2

জাহেদুল আনোয়ার চৌধুরী, সীতাকুন্ড

বংশ পরম্পরায় প্রায় ৫০ বছর ধরে কৃষিকাজ করা হচ্ছে সীতাকুন্ডের বিভিন্ন পাহাড়ে। বর্তমানে পাহাড়ে কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন অন্তত ১০ হাজার কৃষক। তারা জানান, সমতলে বাপ-দাদার কোন জমি নেই, তাই পাহাড়ে কৃষিকাজ করছেন তারা।
জানা গেছে, সীতাকুন্ড পৌরসভা ও কয়েকটি ইউনিয়নের পাহাড়ে কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন অন্তত ১০ হাজার কৃষক। বিশেষ করে ছোট দারোগারহাট, নূনাছড়া, বটতল, ভূইয়াপাড়া, চৌধুরীপাড়া, বাড়বকুন্ড, বাঁশবাড়িয়া, কুমিরা, সোনাইছড়ি ও ভাটিয়ারীর কিছু এলাকায় বিস্তীর্ণ পাহাড়জুড়ে নানা জাতের ফল ও সবজির আবাদ করে আসছেন কৃষকরা। প্রায় ৫০ বছর আগে থেকে পাহাড়ে কৃষিকাজের সাথে জড়িত এসব এলাকার কৃষকরা। তবে পৌরসভার চৌধুরী পাড়া ও ভূইয়া পাড়ার পাহাড়ে সবচেয়ে অধিক সংখ্যক কৃষক সবজিসহ নানা রকম ফসলের চাষ করছেন।
চৌধুরী পাড়ার শেষ প্রান্তে সমতল থেকে পাহাড়ি পথে কিছুদূর এগোলেই একটি ছড়া পাওয়া যায়। সেই ছড়া দিয়ে প্রায় ১ কিলোমিটার পথ এগোলে সারি সারি পাহাড় জুড়ে চোখে পড়ে সজনে বাগান। শত শত একরজুড়ে ছড়িয়ে আছে এ বাগানের মোহনীয় সৌন্দর্য।
এছাড়া কয়েক হাজার একর পাহাড়জুড়ে পেঁপে, করলা, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, শসা ইত্যাদির ক্ষেত রয়েছে। কৃষকরা এ সবের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউ সবজি সংগ্রহ করছেন, কেউ গাছে ওষুধ প্রয়োগ করছেন, আবার কেউবা কাঁধে সবজির ভার নিয়ে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা দুর্গম পথ বেয়ে নেমে আসছেন সবজি বিক্রি করতে।
খোরশেদ আলম, সাইদুল ইসলাম, জহুরুল আলম, ইউসুফ, নুরুল আলম, নুরুল হুদা, জনি, নাজিম উদ্দিন ও জসিম উদ্দিন নামে কয়েকজন কৃষক বলেন, আমাদের নিজেদের কোন ভূমি না থাকায়, আমরা পাহাড়ে কৃষিকাজ করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকি। প্রায় ৫০ বছর আগে থেকে বাবা-দাদারা পাহাড়ের ঝোঁপ-ঝাড় পরিষ্কার করে ফসলের চাষ করে আসছেন। যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চলমান।
পাহাড়ে চাষের সুবিধা হল বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত বৃষ্টি অথবা বন্যায় এখানকার ক্ষেতের কোন সমস্যা হয় না। তবে এখানে চাষাবাদের একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হল বানরের উপদ্রব। ঝাঁকে ঝাঁকে বানরের পাল এসে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে। বানর বেশিরভাগ সময় ভোরে সূর্যের আলো ফোটার সাথে সাথে এবং সন্ধ্যায় অন্ধকার নামার ঠিক আগ মুহূর্তে আসে। এরা বিভিন্ন সবজি খেয়ে থাকে। তবে খাওয়ার চেয়েও নষ্ট করে বেশি।
এছাড়া পাহাড়ে সার, বীজ বহন করা ও সবজি নামানো অনেক কষ্টসাধ্য। বিশেষ করে গরমের সময় আমাদের ভিষণ কষ্ট হয়। এছাড়া বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢালু পথ বেয়ে সবজির ভার নিয়ে নিচে নেমে আসা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। তবুও পবিবারের ভরণ-পোষণের জন্য নিজেদের কোন জমি না থাকায় বাধ্য হয়ে গহীন পাহাড়ে আমরা চাষাবাদ করে থাকি।
বর্তমানে পাহাড়ে উৎপাদিত পণ্য দিয়েই চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলাসহ দেশের অনেক বাজারের সবজির চাহিদা মিটানো হচ্ছে। পাইকাররা এসব সবজি ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক বাজারে পাঠাচ্ছেন। বন্যা পরবর্তীতে অধিকাংশ সবজি ক্ষেতে নষ্ট হওয়ায় পাহাড়ে উৎপাদিত সবজিই এখন মানুষের চাহিদা মিটাচ্ছে। তবে এখন সবজির মৌসুম শেষ পর্যায়ে। কিছুদিন পরেই সজনে চাষ করা হবে। এসব বাগান থেকে হাজার হাজার টন সজনে ডাঁটা সংগ্রহ করা হয়। এসব ডাঁটার বেশিরভাগ রাজধানী ঢাকার কারওয়ান বাজারের পাইকারদের পাঠানো হয়।
সীতাকুন্ড পৌরসভার চৌধুরীপাড়া পাহাড়ি কৃষক সুরক্ষা কমিটির সভাপতি ইফতেখার উদ্দিন বলেন, কৃষকরা হল সমাজের প্রাণ। তারা কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাদের একটাই কাজ সরকার থেকে বিনামূল্যে সার, কীটনাশক ও সঠিক বীজ নিয়ে তারা সঠিকভাবে কৃষিকাজ করে ফসল উৎপাদন করেন।
তিনি বলেন বাজারে যেসব ফসলের বীজ বিক্রি হয় তার মধ্যে অনেকগুলো ভেজাল। এসব বীজ অনেক ক্ষেত্রে অংকুরিত হয় না। অনেক ক্ষেত্রে অংকুরিত হলেও ভাল ফলন আসে না। এছাড়া বিভিন্ন এনজিও থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে কৃষকরা চাষাবাদ করে থাকে। ফলে সারাবছর কষ্টের পর যে টাকা আয় করে তার বেশিরভাগ এনজিওকে দিয়ে দিতে হয়। তাই সরকার সুদের হার শতকরা ২ থেকে ৩ এর কোটায় নিয়ে আসলে কৃষকরা ফসল বিক্রি করে কিছুটা স্বাবলম্বী হতো।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. হাবিবুল্লাহ বলেন, পাহাড়ে কৃষিকাজ কৃষকদের জন্য কষ্টসাধ্য। তারপরও বর্ষাকালে পাহাড়ের কৃষিতে কৃষকরা লাভবান হন। কারণ সে সময় সমতলে বৃষ্টি ও বন্যা ইত্যাদি কারণে বেশিরভাগ সবজির ক্ষেত নষ্ট হয়ে যায়। তাই পাহাড় বা উঁচু স্থানের ক্ষেতগুলা এ সময় অক্ষত থাকে। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের দামও তলনামূলক বেশি থাকে। কৃষকদের জন্য সরকারের থেকে যে বরাদ্দ থাকে তা খুবই অপ্রতুল। তারপরও আমরা চেষ্টা করি কৃষকদের প্রাপ্য সুবিধা দেওয়ার। সরকার এবং বিভিন্ন ব্যাংক ও এনজিওদের প্রতি (যারা কৃষকদের নিয়ে কাজ করে) আমাদের সুপারিশ থাকে, যত কম সুদে ঋণ দেওয়া যায় এবং এসব ঋণ যাতে প্রকৃত কৃষকরা পান।