সিলেট-আখাউড়া ১৭৮ কি.মি. রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ

1

নিজস্ব প্রতিবেদক

আখাউড়া-সিলেট সেকশনের ১৭৮ কিলোমিটার রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ। রেলওয়ে দেশের সকল রেলপথ ডুয়েল গেজ করার পরিকল্পনা করলেও এই রুটটিতে এখনো মিটারগেজে ট্রেন চলছে। মাঝেমধ্যে মেরামত করেই রেলপথটি সচল রাখা হয়েছে। এতে ঝুঁকিমুক্ত না হওয়ায় প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা ও শিডিউল বিপর্যয়। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রাম থেকে সিলেটগামী উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন ও বগি লাইনচ্যুত হলে সারাদেশের সাথে সিলেটের রেল যোগাযোগ তিনঘন্টা বন্ধ থাকে। এতে সিলেটের কয়েক হাজার যাত্রীকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বর্তমানে ঢাকা-সিলেট ও চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে সাত জোড়া আন্তঃনগর ও মেইল ট্রেন চলাচল করে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. তানভিরুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, ‘আখাউড়া-সিলেট সেকশনে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা করা আছে। এই রুটে যে প্রকল্পটি হওয়ার কথা ছিল সেটি হয়নি। তবে মাঝেমধ্যে মেরামত করেই রুটটি চালু রাখা হয়েছে। নানা সমস্যা থাকলেও সেগুলো বড় ধরনের কিছু না’।
প্রকল্পটি সম্পর্কে জানা যায়, ২০১৬ সালে আখাউড়া-সিলেট সেকশনের মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েলগেজ লাইনে উন্নীতকরণে উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০১৯ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন হয়। প্রথমদিকে ১৬ হাজার ১০৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে চীনের অর্থায়নে জিটুজি পদ্ধতিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা থাকলেও ব্যয় কমানোর কারণে সেটি আর হয়নি। পরে বিগত সরকার গত বছরের মার্চ মাসে প্রকল্পটি বাতিল করে। যদিও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি বাতিলের পেছনের কারণ অনুসন্ধানের নির্দেশনা দিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, প্রকল্পটি নিয়ে আপত্তি তুলে পরিকল্পনা কমিশন। আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত ডুয়েলগেজ লাইন হলে ট্রেন চলাচলের হার বাড়বে না। এ রুটে ডাবল লাইন এবং ডুয়েলগেজ নির্মাণ করা হলে এ প্রকল্প থেকে সুবিধা পাওয়া যাবে। অন্যথায় সরকারের এ বিশাল বিনিয়োগে জনগণের তেমন কোনো সুবিধা হবে না- এমন তথ্য তুলে ধরে প্রকল্পটির ব্যয় কমানো হয়েছিল। প্রকল্পে ১৬ হাজার ১০৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হলেও পরবর্তীতে নির্মাণব্যয় নির্ধারণ করা হয় ১২ হাজার ৭৫০ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে মাটির কাজে ৩৪৬ কোটি ২৮ লাখ, ট্র্যাকের কাজে ১৯২ কোটি ৫৭ লাখ, সিগন্যাল ও টেলিকম খাতে ২১ কোটি ৬১ লাখ, সেতু ও কালভার্ট খাতে ১৪৬ কোটি ৪৬ লাখ, স্টেশন ও বিল্ডিং খাতে ২০ কোটি ৩৩ লাখ এবং প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট খাতে ১ হাজার ৩৮২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয় কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছিল। ঠিকাদার নিয়োগের পর ব্যয় কমানোয় চীনা প্রতিষ্ঠান সিআরবিসি কাজ করতে রাজি হয়নি।
রেলওয়ে প্রকৌশলীরা জানান, সিলেট-আখাউড়া সেকশনের ১৭৮ কিলোমিটার রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ। এই পথে ছোট-বড় ২৫০ সেতু প্রায় ৬০-৭০ বছর আগে নির্মিত। সেতুগুলোর অধিকাংশই জরাজীর্ণ। অনেক জায়গায় রেললাইনে নানা ত্রæটি রয়েছে। কোথাও পাথর উঠে গেছে, সিøপার ভেঙেছে কিংবা ক্লিপ হারিয়ে গেছে। এ কারণে আখাউড়া-সিলেট সেকশনে প্রায়সময় ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। এই রুটে একটি ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়লেই পুরো রুটটি বিকল হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া-আসা করা সকল ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় ঘটে। মাঝেমধ্যে সীমিত আকারে রেলপথ মেরামত করা হয়।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, আখাউড়া-সিলেট রেললাইনের অবস্থা এখন এতোই শোচনীয় যে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম থেকে আমদানিকৃত তিন হাজার সিরিজের ইঞ্জিনগুলো এই রুটে চালানো যায় না। কোরিয়া থেকে আমদানিকৃত ইঞ্জিনগুলো উচ্চগতির। নড়বড়ে, পাথরবিহীন রেললাইনে উচ্চগতির ও অধিক ওজনের এই ইঞ্জিনগুলো চলতে পারে না। তাই নতুন ইঞ্জিনগুলো আখাউড়া-সিলেট রুটে চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়নি।
সিলেটের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ রয়েছে। দু’টি রেলপথের সাধারণ অংশ আখাউড়া-সিলেট সিঙ্গেল লাইন মিটার গেজ রেলপথ। আখাউড়া-সিলেট রেলপথের এই অংশটি আখাউড়া-কুলাউড়া-শাহবাজপুর-মহিষাধন (করিমগঞ্জ, ভারত) রেলপথের অংশ হিসেবে ১৮৯৬ সালে তৈরি হয়। আর কুলাউড়া-সিলেট রেলপথটি ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃক তৈরি করা হয়। আখাউড়া-সিলেট রেলপথের মোট দৈর্ঘ্য ১৭৭ দশমিক ৬০ কিলোমিটার। বর্তমানে ঢাকা-সিলেট রুটে সুরমা ও জালালাবাদ এক্সপ্রেস নামে দুই জোড়া মেইল ট্রেন, ঢাকা-সিলেট রুটে কালনী এক্সপ্রেস, উপবন এক্সপ্রেস ও পারাবত এক্সপ্রেস তিন জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন এবং চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ও উদয়ন এক্সপ্রেস নামে দুই জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে।