জসিম উদ্দিন মনছুরি
অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার জন্য প্রতিটি দেশে জেল-হাজত বা কারাগার রয়েছে। দেশের আভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে অপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে কারাগারে আটকে রেখে শাস্তির আওতায় আনা হয়। শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে জেল-হাজত বা কারাগারের বিকল্প নেই। অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য রয়েছে কিশোর সংশোধনাগার। ন্যায়নীতি বজায় রেখে বিচারের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা হয়। এটা সম্পূর্ণ বিধিসম্মত। কিন্তু এমন কিছু কারাগার রয়েছে যেগুলোর নাম শুনলে গা শিউরে উঠে। আগে শোনা যেত গুয়ানতানামো বে কারাগারের কথা। এই কারাগারে নির্যাতনের কথা ও জুলুম নির্যাতনের নির্মমতার ভয়াবহ চিত্র পৃথিবীব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকায় অপরাধীদের স্বাধীনভাবে নিরপেক্ষ বিচারের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। তবে সা¤প্রতিক সময়ে দুই দেশের স্বৈরাচারী সরকারের পতন হলে ভয়াবহ নির্যাতন ও মানবতা লঙ্ঘনের অপরাধ চোখের সামনে আসতে থাকে। আগে আসা যাক সিরিয়ার স্বৈরাচারী শাসক বাসার আল আসাদের কথায়। তিনি হাফিজ আল আসাদের পুত্র। তারা বাবা ও ছেলে মিলে ৫০ বছরেরও অধিক স্বৈরাচারের মাধ্যমে দেশকে শাসন করেছে। বিরোধী মতকে দমনের জন্য তারা বাপ বেটা মিলে নির্যাতনের এমন কোন দিক নেই করেননি। বিরোধীদেরকে কণ্ঠ রুদ্ধ করতে সহজপন্থা ছিলো খুন, গুম ও গুপ্তহত্যা। তাদের বিশেষ বাহিনী দ্বারা বিরোধীদের দমনে ও নির্যাতনের নিষ্ঠুরতম অধ্যায় রচনা করে গেছেন। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে তাদেরকে গুম করে সিদনায়া কারাগারে নিক্ষেপ করা হতো। সিদনায়া কারাগার ছিলো সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের অভ্যন্তরে। সাম্প্রতিক সময়ে স্বৈরাচারী বাসার আল আসাদ বিরোধীদের প্রবল প্রতিরোধে পতন হলে একে একে উঠে আসতে থাকে বসার আল আসাদের নির্মম ভয়াবহতার করুন চিত্র। এমন কি সিদনায়া কারাগারে ৪৩ বছরের অধিক সময় অনেকে বন্দি ছিলো। ২৩ বছর আগে হাফিজ আল আসাদ মৃত্যুবরণ করে অথচ অনেক বন্দি জানতোই না হাফিজ আল আসাদের মৃত্যুর খবর। এক ব্যক্তিকে হাফিজ আল আসাদ কারাগারের রুদ্ধ করে রেখেছিলো। তিনি মুক্ত হওয়ার পর হাফেজ আল আসাদের ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরেন। এমনকি নিরীহ নারী-পুরুষদের বন্দি রেখে ইতিহাসের নির্মমতার জঘন্য অধ্যায় রচনা করে গেছেন হাফিজ আল আসাদ ও বাসার আল আসাদ। অষ্টাদশী একজন নারীকে হাফেজ আল আসাদ কারাগারে রুদ্ধ করে রেখেছিলো। তার সাথে শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম নির্যাতনের কাহিনী প্রকাশ হয়েছে। ওই নারী কারাগারে অনেকগুলি সন্তানের জন্ম দিলেও তিনি জানেন না সন্তানের পিতা কারা। বাসার আল আসাদের পতন হলে সিদনায়া কারাগারের ভয়াবহতা পৃথিবীর মানুষের সামনে উন্মোচিত হয়। এটা মূলত কারাগার হলেও সুড়ঙ্গের মতো করে এর নিচতলায় পৃথিবীর আলো বাতাস ছাড়া একটি গোপন শেল রয়েছে।যেই শেলের মধ্যে নিয়মিত নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হতো। দীর্ঘ ৫০ বছর পর সিরিয়ার মানুষ বাবা ছেলে দুই স্বৈরাচারীর কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে। বাসার আল আসাদ নিজেকে রক্ষার জন্য রাশিয়ায় পলায়ন করে। তাকে মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্য হয়তো অচিরেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচারের আওতায় আনা হতে পারে। এবার আসা যাক বাংলাদেশের কথায়। বাংলাদেশের মানুষও দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের নির্মম নির্যাতন সহ্য করার পর স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের কাছ থেকে মুক্তি লাভ করেছে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পলায়ন করতে বাধ্য হয়। কথিত আছে ভারতের মদদে শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলো। ভোট বিহীন নির্বাচন আয়োজন করে পুনরায় ক্ষমতা গ্রহণ ছিলো তার কথিত গণতন্ত্রের প্রতিচ্ছবি। ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রখার জন্য তিনি জনগণের উপর এমন কোন নির্যাতন নাই করেননি। বিরোধী মতকে দমনের জন্যও নিরীহ জনগণকে তার রক্ষীবাহিনী ও পুলিশ বাহিনী দিয়ে ধরে এনে আয়নাঘর নামক গোপন আস্তানায় রাখা হতো। গুম ও খুন ছিলো তার নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। যারা প্রতিবাদী হয়ে রাস্তায় নেমেছে তাদেরকে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী নাম দিয়ে রাতের অন্ধকারে তুলে এনে আয়নাঘরে নিক্ষিপ্ত করা হতো। চলতো এসব নিরীহদের উপর অমানবিক নির্যাতন। অনেককে আয়নাঘর থেকে আর ফিরে আসতে দেখা যায়নি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য নিজের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার জন্য শেখ হাসিনা নিজের মতো করে আইন তৈরি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সৃষ্টি করে অনেক নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। এমনকি তার একটি কমন ডায়লগ ছিলো জঙ্গি। জঙ্গি দমনের নামে অনেক নিরীহ মানুষকে প্রকাশ্য দিবালোকে কিংবা রাতের অন্ধকারে ক্রসফায়ারের নাম দিয়ে সাজানো বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করেছে। শেখ হাসিনার পতনের পর অনেক সত্য উদঘাটন হতে শুরু করেছে। জাহাজবাড়ির চাঞ্চল্যকর ৯ জন যুবককে হত্যা করার নিষ্ঠুর কাহিনী জঙ্গি নাটকের মাধ্যমে করা হয়েছিলো। তার মূল রহস্য আমার দেশ পত্রিকার মাধ্যমে সবার সামনে উন্মোচিত হয়। সরকারের সাজানো নাটকে বলা হয়েছিলো জঙ্গিরা গ্রেনেড ও বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে নিহত হয়। কিন্তু আমার দেশের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে ঘটনার মূল রহস্য। তখন সরকার বলেছিলো নয়জন যুবক জাহাজ বাড়িতে অবস্থান নিয়ে চারটি পিস্তল দিয়ে সারারাত পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি ছুড়ে। ঘটনাস্থলেই আটজন মারা যায়। এটা অবিশ্বাস্য হলেও পুলিশের একতরফা বয়ান জনগণকে মানতে বাধ্য করা হয়েছিলো। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতন হলে এরকম আরো অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করে।গুমের মধ্যে চাঞ্চল্যকর ছিলো সিলেটের সাবেক এমপি ইলিয়াস আলীকে গুম করার ঘটনা। গুপ্ত হত্যার মাধ্যমে তাকে হয়তো হত্যা করা হয়েছে।তার লাশটি পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। বিএনপি’র আরেকজন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদকে ভারতে ফেলে আসা হলে সেখান থেকে স্বৈরাচারী সরকারের পতন হলে তিনি দেশে ফিরে আসেন। ব্রিগেডিয়ার আমান আজমি ও মীর কাসেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আরমান স্বৈরাচারী সরকারের পতন হলে জীর্ণশীর্ণ শরীরে মুক্ত হয়ে আয়না ঘর থেকে ফিরে আসে। হাসিনা সরকারের অন্যতম প্রধান ডায়লগ ছিলো জঙ্গিদের এই বাংলায় স্থান নাই। দেখা গেছে পুলিশ বিরোধী মতকে দমনের জন্যও জঙ্গি নাটক সাজিয়ে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে জঙ্গি বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। খুন ও গুমের গোপন শেল ছিলো আয়নাঘর নামক শাস্তির নির্মম স্থান।
আয়নাঘরে বন্দিদের চোখ, হাত বেঁধে তাদের মাথা নিচের দিকে দিয়ে পা উপরে বেঁধে রেখে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হতো। এসব ভয়াবহ চিত্র উঠে আসতে শুরু করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে তিন স্বৈরাচারীর ইতিহাস মানবতার কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে ঘৃণিত হয়ে থাকবে আজন্ম। হাফিজ আল আসাদ ও বসার আল আসাদ এবং স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা নিজেদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য দেশের নিরীহ জনগণকে হত্যার জন্য যে গোপন শেল তৈরি করেছিলো তা ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে পৃথিবীতে ঘৃণার ইতিহাস হয়ে থাকবে। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের জনগণ স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে । দুই দেশের প্রেক্ষাপট একই রকম হলেও বাংলাদেশের ভয়াবহতার চিত্র কিছুটা ভিন্ন। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদ পলায়ন করলেও তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা কেউ পলায়নি। তাদের সাথে মুক্তিকামীরা একসাথে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছেন । কিন্তু বাংলাদেশের স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা পলায়ন করার সাথে সাথেই তার সাথে তার মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্যসহ নেতাকর্মীরাও পার্শ্ববর্তী দেশ সহ বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন ও পলায়ন করে রয়েছে। সীমাহীন দুর্নীতি ,আত্মসাৎ ,অর্থপাচার, খুন ও গুমের ইতিহাসের ভয়ংকর দিনগুলি পার করেছে বাংলাদেশের জনগণ। কারো জান-মালের নিরাপত্তা ছিলো না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা সংবাদপত্রের কোন স্বাধীনতা ছিলো না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করার সুযোগ ছিলো না। কোন পোস্টে লাইক কমেন্ট করলেও তাকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভয় দেখিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখার নির্মমতা কঠিনতর ছিলো। এমনকি সরকারের সমালোচনা করা কোন পোস্টে লাইক কমেন্ট করলেই তাকে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নাম দিয়ে গুম করা হতো। বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছিলো। দেশে যদি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বিচার ব্যবস্থা না থাকে তাহলে সেই দেশের জনগণ কখনও স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য শক্তিশালী প্রচার মাধ্যম। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অনস্বীকার্য। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বিগত ১৭ বছর যাবৎ স্বাধীন কোন গণমাধ্যম ছিলো না। সরকারের তরফ থেকে বলে দেয়া কথা সংবাদপত্রে প্রচার করা হতো। এর ব্যত্যয় ঘটলে তাদের লাইসেন্স কেড়ে নিয়ে সংবাদপত্র কিংবা টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়া হতো। যার প্রমাণ আমার দেশ পত্রিকা, দিগন্ত টিভি, ও ইসলামিক টিভি। গণমাধ্যমের উপর কঠোরতা আরোপ করায় বস্তুনিষ্ঠ নিরপেক্ষ সংবাদ পাওয়ার কোন সুযোগ ছিলো না। যদিও সা¤প্রতিক সময়ে আমার দেশ পত্রিকা অবমুক্ত হলে পুরাতন অনেক অপ্রকাশিত সংবাদ জনসমক্ষে আসতে শুরু করেছে। আশা করি এবার আমার দেশ পত্রিকার পথ ধরে অন্যান্য গণমাধ্যমগুলিও সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে সাহসিকতার পরিচয় দিবে। নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ গণমাধ্যম না থাকলে দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। সত্য উন্মোচিত না হলে সরকার স্বৈরাচারী হয় এবং বিরোধীদের কণ্ঠ রুদ্ধ করে ক্ষমতাকে যে কোনো কিছুর বিনিময়ে আঁকড়ে রাখতে সচেষ্ট হয় । বাংলাদেশের সাবেক স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের মদদে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকে।
গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে জনগণের ভোটাধিকারকে হরণ করা হয়েছে। অহরহ মিথ্যা মামলা দিয়ে বিরোধী মতকে দমন করার নিষ্ঠুরতা অবলম্বন করা হয়েছে। গণতন্ত্রের নাম দিয়ে আওয়ামী সরকার মূলত বাকশাল কায়েমের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলো। সংবিধানে মনগড়া সংশোধনী এনে এবং বিচারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে গণমাধ্যমের উপর কঠোরতা আরোপ করে নিজের অপকর্মকে ঢাকার চেষ্টা করেছে প্রতিনিয়ত। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন হলে দেশের জনগণের মধ্যে একটি আবহ ও আমেজ সৃষ্টি হয়। এবার জনগণ আশা করছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনরায় ফিরে পাবে। অন্তর্র্বতীকালীন সরকার প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করে এবং জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর থাকবে বলে জনগণের দৃঢ় বিশ্বাস। পৃথিবীর সবার প্রত্যাশা বাসার আল আসাদের জুলুম নির্যাতনের গোপন শেল সিদনায়া কারাগার ও বাংলাদেশের নিষ্ঠুরতম নির্যাতনের আয়নাঘর যেন আর কখনো পৃথিবীর সামনে না আসে কিংবা এরকম ঘরের অস্তিত্ব যেন সারা জীবনের জন্য বিলীন হয়ে যায়। ফলে মানুষ শান্তিতে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিজেদের মত প্রকাশ করে স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারবে বলে পৃথিবীর জনগণের প্রত্যাশা।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক