সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ দিনভর যাত্রীদের ভোগান্তি

2

নিজস্ব প্রতিবেদক

রেলের প্রচলিত কোড ও বিধি বিধানের আলোকে রানিং এলাউন্সসহ পেনশন ও আনুতোষিকের দাবিতে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করছে রানিং স্টাফরা। এতে গত সোমবার মধ্যরাত (১২টা ১ মিনিট) থেকে সারাদেশে বন্ধ হয়ে গেছে ট্রেন চলাচল। গতকাল দুপুর পর্যন্ত চট্টগ্রাম রেল স্টেশন থেকে ছয়টি ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়েছে। ট্রেন চলাচল বন্ধের কারণে চট্টগ্রাম রেল স্টেশনসহ প্রতিটি রেল স্টেশনই কার্যত অচল ছিল। যে কারণে যাত্রী দুর্ভোগ ছিল বেশি। দুর্ভোগ কমাতে রেলওয়ের পক্ষ থেকে বিকল্প পরিবহন হিসেবে বিআরটিসি বাসের ব্যবস্থা করা হলেও অনেকেই টিকিট রিফান্ড করে অন্য পরিবহনে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
চট্টগ্রাম রেল স্টেশন সূত্র জানায়, রানিং স্টাফদের কর্মবিরতির কারণে সকাল থেকে কোনো ট্রেন ছাড়েনি। সকাল ১১টা পর্যন্ত সিডিউল অনুযায়ী ছয়টি আন্তঃনগর ট্রেন ছাড়া সম্ভব হয়নি। ঢাকাগামী চট্টলা এক্সপ্রেস, সুবর্ণ এক্সপ্রেস ও কর্ণফুলী কমিউটার, দুপুরে মহানগর গোধূলি ও মহানগর এক্সপ্রেসের যাত্রা বাতিল করা হয়। এ ছাড়া সিলেটগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস এবং কক্সবাজারগামী কক্সবাজার এক্সপ্রেস ও কক্সবাজার ঈদ স্পেশাল ট্রেনও চলাচল করেনি। এসব ট্রেনের যেসব যাত্রী কাউন্টার থেকে টিকেট নিয়েছিলেন তাদের টিকেট ফেরত নেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন আন্তঃনগর, মেইল ও লোকাল মিলে ২৭ জোড়া ট্রেনে প্রায় ১২ হাজার যাত্রী যাওয়া-আসা করে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক এ বি এম কামরুজ্জামান বলেন, ‘রেলওয়ের পক্ষ থেকে যাত্রীদের ভোগান্তি কমাতে বিকল্প হিসেবে বিআরটিসির বাসের মাধ্যমে সেবা দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া যাত্রী চাইলে টিকিট রিফান্ডের সুযোগ আছে। যারা কাউন্টার থেকে টিকিট নিয়েছেন তারা কাউন্টারে টিকিট ফেরত দিয়ে টাকা ফেরত নিতে পারবেন। আর যারা অনলাইনে টিকিট নিয়েছেন তারা অনলাইনে রিফান্ড রিকোয়েস্ট দিয়ে টাকা ফেরত নিতে পারবেন।’
গতকাল বিকাল ৪টার দিকে চট্টগ্রাম বিআরটিসি বাস ডিপোর ম্যানেজার জুলফিকার আলী পূর্বদেশকে বলেন, ‘কর্মবিরতি চলার কারণে বিআরটিসি বাস দিয়ে রেলের যাত্রী গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এতে ভোগান্তি অনেক কমেছে। প্রাথমিকভাবে যাত্রীদের দুর্ভোগ কমাতে বিআরটিসির ১৫টি বাস প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। এ পর্যন্ত সাতটি বাস বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেছে। সন্ধ্যা ৬টার দিকে দুটি ডাবল ডেকার বাস ১২০জন করে যাত্রী নিয়ে চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। সিলেটের যাত্রীর চাপ থাকায় সেখানেও দুটি বাস যাবে। ধাপে ধাপে চাহিদা অনুসারে বাস দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে এডিসি (শিক্ষা) সাথে কথা বলে স্কুল বাসগুলোও রেলের যাত্রী পরিবহনে পাঠানো হবে।’
মহানগর এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বাস যাত্রায় যানজটে পড়লে ভোগান্তি পোহাতে হয়। যে কারণে ট্রেন যাত্রা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কর্মবিরতিতে ট্রেন না চলার কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এখন একেখান গিয়ে বাসে করেই যাবো। বিআরটিসি বাস দিলেও এ বাসেও যেতে কষ্ট পেতে হবে।’
স্টেশনে যাত্রার জন্য জড়ো হওয়া কয়েকজন যাত্রী অভিযোগ করেন, স্টেশনে যাত্রীর চাপ বাড়তে থাকলেও কোনরকম ঘোষণা না দেয়ায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। স্টেশন ম্যানেজারের কক্ষে গেলেও কাউকে পাওয়া যায়নি। চেয়ার ছেড়ে ম্যানেজার গাঁ ঢাকা দিয়েছে। পরে কয়েকজন যাত্রী হট্টগোল করলে মাইকে ঘোষণা দেয়া হয়। এরপর অর্থ ফেরত নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। অনেকেই ফেরত নিয়েছে। অনেকেই ট্রেন টিকেটের দামে বিআরটিসি বাসেই গন্তব্যে গেছেন।
গতকাল সিজিপিওয়াই পথকে সারাদেশে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। হালিশহরের সিজিপিওয়াই স্টেশন থেকে গত সোমবার রাত ২টায় এবং মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টায় ও বেলা ২টায় কনটেইনারবাহী ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। আর সকাল সাড়ে ৯টায় একটি তেলবাহী ট্রেন ছাড়ার সময়সূচি ছিল। সিজিপিওয়াইর স্টেশন মাস্টার আবদুল মালেক সাংবাদিকদের বলেন, গত সোমবার রাত আটটায় গম নিয়ে একটি ট্রেন ছেড়ে গেছে। এরপর মঙ্গলবার চারটি ট্রেন যাওয়ার কথা থাকলেও রানিং স্টাফদের কর্মসূচির কারণে স্টেশনে ইঞ্জিন না আসায় ট্রেন চালানো সম্ভব হয়নি।
রেলওয়ের রানিং স্টাফ বলতে ট্রেনের চালক, সহকারী চালক, গার্ড ও টিকিট পরিদর্শকদের (টিটিই) বোঝানো হয়। রানিং স্টাফরা ১৬০ বছর ধরে মাইলেজ সুবিধা পাচ্ছিলেন। অর্থাৎ দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি কাজ করলে বেসিকের (মূল বেতন) হিসেবে বাড়তি অর্থ পেতেন। এ ছাড়া অবসরের পর বেসিকের সঙ্গে এর ৭৫ শতাংশ অর্থ যোগ করে অবসরকালীন অর্থের হিসাব হতো। তবে ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর এই সুবিধা সীমিত করে অর্থ মন্ত্রণালয়।
১৬০ বছরেরও বেশি সময় যাবত রানিং কর্মচারীদের রানিং এলাউন্স যা মূল বেতনের অংশ, তা যোগ করে পেনশন নির্ধারণের বিধান ছিল। অথচ গত সরকারের আমলে নিজেদের দুর্নীতি ও অর্থ অপচয় ঢাকতে অর্থ মন্ত্রণালয় ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর এক পত্রে রেলওয়ের রানিং স্টাফদের রানিং এলাউন্স কিছু ক্ষেত্রে রহিত ও কিছু ক্ষেত্রে খর্ব করে। যা রেলের কোড ও বিধি বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। রানিং স্টাফদের আন্দোলনের মুখে ২০২২ সালের ২৪জানুয়ারি রেলওয়ে সংস্থাপন কোডের বিধান অনুযায়ী রানিং এলাউন্স প্রদানের সিদ্ধান্ত দেয়। কিন্তু রানিং এলাউন্স যোগ করে পেনশন ও আনুতোষিক প্রদানে অসম্মতি জ্ঞাপন করে অর্থ মন্ত্রণালয়। ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল আবারও অনাপত্তি দিলে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে আন্দোলনে নামে রানিং স্টাফরা। পরবর্তীতে আদেশ প্রত্যাহার করে রানিং এলাউন্স যোগ করে পেনশন ও আনুতোষিক প্রদান করার কথা থাকলেও আগের অসম্মতি প্রত্যাহার হয়নি মর্মে জটিলতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। লিখিতভাবে কোন পত্র জারি না করায় রানিং স্টাফরা হতাশায় ভুগছেন। সর্বশেষ গত ৩১ অক্টোবর ও ৯ ডিসেম্বর দুই দফা সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রæতি দিলেও তা বাস্তবায়ন করেনি। পরবর্তী ৩০দিনের মধ্যে এই জটিলতা নিরসন করার কথা বললেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। যে কারণে পুনরায় আন্দোলনে নামে বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদ।
গতকাল সকাল থেকে পাহাড়তলি লোকোশেডের সামনে কর্মবিরতি সফল করতে সমাবেশ করে রানিং স্টাফরা। সমাবেশ থেকে পার্ট অফ পে রানি এলাউন্স যোগ করে পেনশন ও আনুতোষিক প্রদানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সকল অসম্মতি প্রত্যাহার এবং নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত রানিং স্টাফদের নিয়োগপত্রের বৈষম্যমূলক ১২ ও ১৩নং শর্ত বাতিল করে রেলওয়ে কোড ও বিধি বিধানের আলোকে আদেশ জারি দাবি জানানো হয়।
রেলওয়ে রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদ চট্টগ্রাম বিভাগের আহব্বায়ক মো. মজিবুর রহমান ভুঁইয়া পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমরা সরকারকে বারবার তাগাদা দেয়ার পরেও আমাদের কথা কর্ণপাত করেনি। যে কারণে পূর্ব ঘোষিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু হয়েছে। সারাদেশের মতো চট্টগ্রামের কোন ট্রেন স্টেশন ছেড়ে যায়নি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা কর্মবিরতি অব্যাহত রাখবো। সরকার দাবি মেনে প্রজ্ঞাপন দিলেই মুহূর্তেই কর্মসূচি প্রত্যাহার হবে।’