৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে কিছু উগ্রবাদী ও রাজনৈতিক সুবিধাভোগী মহল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা ও লুটপাট করেছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। ওই সময় বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশের ৪৮টি জেলার ২৭৮টি স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর এসব হামলা চালানো হয়। এমন প্রেক্ষাপটে অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৮ আগস্ট সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জাতীয় উপাসনালয় রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শন করেন। তিনি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আশ্বস্ত করেন, তাঁরা অবশ্যই ন্যায়বিচার পাবেন। তিনি তাঁর সরকারের ওপর আস্থা রাখতে এবং সহযোগিতা করতে বলেন। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস বলেন, গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাই তাঁর সরকারের মূল লক্ষ্য। তবে ওই সময় দলমত নির্বিশেষে এমনকি ধর্মীয় সঙ্গঠনগুলোকেও মন্দির পাহারা দিতে দেখা গেছে। এরপর দূর্গাপুজোয় যেন কোন রকম অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা না ঘটে সেই দিকে সজাগ দৃষ্টি রেখেছিল আইন-শঙ্খলা বাহিনী। তবে বিপর্যয়টা ঘটেছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি অংশের এক ধর্মীয় নেতার গ্রেফতারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠে চট্টগ্রাম। এতে একজন আইনজীবির হত্যার ঘটনাও ঘটে। এঘটনা শুধু চট্টগ্রাম নয়, পুরো বাংলাদেশের মানুষ হতবিহব্বল হয়ে পড়ে। পাশের দেশ ভারতেও এর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে আমরা দেখছি। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান সংকট থেকে উত্তরণে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন। পরপর দু’দিন ঐক্য ও সম্প্রীতি সুদৃঢ়করণে রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় নেতাদের সাথে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। বৈঠকে বেশ কিছু রাষ্ট্রচিন্তক ও সুফি ঘরণার লোকও ছিল। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ‘সম্প্রীতির এ বাংলাদেশে সকলে মিলে এক পরিবারের মতই থাকব’ এমনটি প্রত্যাশা ব্যক্ত করে ধর্মীয় নেতাদের সংখ্যালঘু ইস্যুতে প্রকৃত সত্য ও তাৎক্ষণিক সমাধান প্রত্যাশা করেন। তিনি দেশের অব্যাহত সম্প্রীতি আরো সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। আমরা বরাবরই দেখে আসছি, দেশে বড় কোনো পরিবর্তনের পর কিছু ধর্মান্ধ ও সুযোগসন্ধানী মানুষ সনাতন সম্প্রদায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমনটা দেখা গিয়েছিল ২০০১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নির্বাচনের আগে পরেও। দেশব্যাপী হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর তখনো এরা হিংস্র হায়েনার মতো হামলা চালিয়েছিল। হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগসহ সব অপরাধই তখন করা হয়েছিল। ১৪ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার কাছে হিন্দু সম্প্রদায়ের জ্যেষ্ঠ নেতারা সব হামলারই বিচার দাবি করেন।
তাঁরা স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫৩ বছরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর যেসব অত্যাচার, নির্যাতন ও বৈষম্যের ঘটনা ঘটেছে, সেসবের বিচারে একটি কমিশন গঠনের দাবি জানান। এ সময় ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বড় রকমের একটা বিভেদের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। এমন বাংলাদেশ আমরা গড়তে চাচ্ছি, যেটা একটা পরিবার, এটাই হচ্ছে মূল জিনিস। এই পরিবারের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা, বিভেদ করার প্রশ্নই আসে না। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশি। তখন ’ জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সহিংস সব কর্মকান্ডের পূর্ণ, স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্তের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যেকোনো মূল্যে সাম্প্রদায়িক শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে। তাঁদের মতে, অতীতে সা¤প্রদায়িক শান্তি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বলেই মৌলবাদী ও সুযোগসন্ধানীরা বারবার সংখ্যালঘুদের ওপর এমন হামলা পরিচালনার সাহস পায়। শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক নয়, অতীতে বৌদ্ধসহ অন্যান্য ধর্ম ও মতের লোকজনের ওপর অনেক ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কোনোটিরই যথাযথ বিচার সম্পন্ন হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর সংঘটিত সাম্প্রতিক হামলার প্রতিটি ঘটনার সঠিক তদন্ত হতে হবে এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, ও জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বসবাস করে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সম্পদ, যা দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি শুধু সামাজিক স্থিতিশীলতা ও শান্তির জন্যই নয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। যখন একটি সমাজে সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রে বসবাস করতে পারে, তখন সেখানকার সামগ্রিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ একে অপরের কাছ থেকে শিখতে পারে এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বিনিময় ঘটে, যা সমাজকে আরও বৈচিত্র্যময় ও সৃজনশীল করে তোলে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে হলে শুধু সরকার ও নাগরিকদের উদ্যোগই যথেষ্ট নয়, গণমাধ্যমের ভূমিকাও এখানে অপরিহার্য। গণমাধ্যমের দায়িত্ব হলো প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা প্রচার করা। যখনই কোনো সাম্প্রদায়িক সমস্যা দেখা দেয়, তখন গণমাধ্যমের ইতিবাচক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা সমাজকে শান্ত ও স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে। বাংলাদেশের সংবিধান ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। এখানে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ নানা ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে। তবে কখনো কখনো কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এই স¤প্রীতি বিনষ্ট করার চেষ্টা করে। তারা বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা হানাহানির সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সবসময় এই ধরনের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে এবং সম্প্রীতির বন্ধনকে আরও দৃঢ় করেছে। বাংলাদেশ সরকারও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকার বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নেও সমান গুরুত্ব দেয়, যা সকল ধর্মের মানুষের জন্য একটি নিরাপদ ও সম্মানজনক পরিবেশ নিশ্চিত করে।