ঢাকা প্রতিনিধি
জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় প্রথমবারের মতো ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টাসহ ১৩ জনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে। গতকাল সোমবার সকাল ১০টার দিকে অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের হাজির করা হয়। এদিকে রিমান্ডে থাকায় সাবেক মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাককে হাজির করা হয়নি।
ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, আজ (সোমবার) ১৪ জনকে হাজির করার কথা ছিল। সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক রিমান্ডে থাকায় ১৩ জনকে হাজির করা হয়েছে। তাকে পরবর্তীতে হাজির করা হবে।
গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাদের তোলা হয়েছে, তারা হলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ফারুক খান, ডা. দীপু মনি, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, জুনাইদ আহমেদ পলক, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, কামাল আহমেদ মজুমদার, গোলাম দস্তগীর গাজী, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর আলম। তারা সবাই আগে থেকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল গতকাল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একমাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলেছে। পাশাপাশি ট্রাইব্যুনালে হাজির করা সাবেক মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে গণহত্যার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছে ।
ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন, বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। গত ১৭ অক্টোবর শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল।
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আদালতকে বলেন, প্রাথমিক তদন্তে জুলাই আগস্টে ‘নিপীড়নের পটভূমি’ পাওয়া গেছে। তদন্ত শেষ করার জন্য দুই মাস সময় প্রয়োজন। পরে ট্রাইব্যুনাল এক মাস সময় দিয়ে ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। তাজুল ইসলাম তখন বলেন, এর মধ্যেই তারা তদন্ত শেষ করতে পারবেন বলে আশা করছেন।
শুনানির শুরুতে তাজুল ইসলাম আদালতে বলেন, আসামিপক্ষে সিনিয়র অ্যাডভোকেট এহসানুল হক সমাজী শুনানি করতে এসেছেন। তবে তিনি রাষ্ট্রীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে বসতে যাচ্ছেন বলে জেনেছি। দুয়েকদিনের দিনের মধ্যে হয়ত সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করবেন। তাই তিনি আসামিপক্ষে শুনানি করলে এটা হবে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’। তাজুল ইসলাম এ সময় এহসানুল হক সমাজীকে আসামিপক্ষে শুনানি না করতে অনুরোধ জানান।
এরপর এহসানুল হক সমাজী আদালতকে বলেন, আমি এখনও ফরমাল কোনো লেটার পাইনি। ফরমাল লেটার পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না। এছাড়া যে পদে আমাকে নির্বাচিত করা হবে, সেটা আমি গ্রহণ করি কি না তাও ভাববার বিষয়।
অ্যাডভোকেট সমাজী কোন আসামির পক্ষে এসেছেন আদালত জানতে চাইলে তিনি পাঁচ জন আসামির নাম বলেন। এরপর তিনি শুনানি না করে আরেক আইনজীবীকে দায়িত্ব দেন। পরে প্রসিকিউশনের আবেদনে ওই ১৩ জনকে আনুষ্ঠানিকভাবে গণহত্যার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।
শুনানি শেষে প্রধান কৌঁসুলি মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, শুধু জুলাই-আগস্ট মাসেই নয়, বিগত সরকার ক্ষমতায় আসার পরই গুম-খুন ও হত্যার বীভৎসতা সৃষ্টি করে। হিটলারের সময়ের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের মত ক্যাম্প তৈরি করে তাতে নিষ্ঠুরভাবে বন্দিদের নির্যাতন করা হয়েছে। তারা শুধু গণহত্যাই করেনি, নির্যাতনের যত রকম পন্থা রয়েছে সবই বাস্তবায়ন করেছে, যা হিটলারের নাৎসি বাহিনীর কথা মনে করিয়ে দেয়।
তাজুল ইসলাম বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ করে চিরদিন ক্ষমতায় থাকা যায় না, বিচারের মুখোমুখি হতে হয়, তা আজকের দিনের এক বড় শিক্ষা।
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুবনাল গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এখন ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের চালানো দমন পীড়নকে ‘গণহত্যা’ বিবেচনা করে এ আদালতে বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
গত ৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যে সারা দেশে ‘গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের’ অর্ধশতাধিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন অফিসে জমা পড়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এবং আরেক মামলায় তার পরিবারের সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতাসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল।
যাদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল পরোয়ানা জারি করেছে, তাদের মধ্যে শেখ হাসিনা ছাড়াও তার বোন শেখ রেহানা, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই সাবেক এমপি শেখ ফজলুল করিম সেলিম, তার দুই ভাতিজা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপস, যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ রয়েছেন।