সাফল্যের গৌরব গাঁথায় বোয়ালখালীর তিন জয়িতা

86

‘জয়িতা অন্বেষণ বাংলাদেশ’ শীর্ষক কর্মসুচির আওতায় সরকারের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায় ৫টি ক্যাটাগরিতে যাচাই বাছাইয়ে তিনজন শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন।
বাপ্পী দেওয়ানজী : জন্মগতভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধি উপজেলার কধুরখীল গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া বাপ্পী দেওয়ানজী। তার একটি হাত অক্ষম। তারপরও সকল বাঁধা অতিক্রম করে এইচএসসি পাশ করার পর পারিবারিকভাবে রতন দেওয়ানজীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়েতে তার বাবা সাধ্যমত আসবাবপত্র ও নগদ টাকা প্রদান করেন। বিয়ের দুই বছর পর্যন্ত ভালভাবে সংসার করে দুই সন্তানের মা হন তিনি। দুই বছর পর বাপ্পী দেওয়ানজী তার স্বামীর আসল রূপ দেখতে পান। যৌতুকের জন্য শুরু করে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। তারপরও দুই ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিরবে সব অত্যাচার সহ্য করে সংসার টিকিয়ে রাখতে পারেননি বাপ্পী দেওয়ানজী। ২০০৭ সালে তাকে ফেলে স্বামী পালিয়ে যায়।
পরে সে স্বামীর নির্যাতনের হাত থেকে বেঁচে গেলেও পড়ে যায় আর্থিক সংকটে। প্রথমে তার বাবা আর্থিক সহযোগীতা করলেও পরে বাবার অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাও বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকে তিনি অধম্য ইচ্ছা শক্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ে প্রতিবন্ধি সংস্থা থেকে সেলাইয়ের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
বর্তমানে সেলাইয়ের কাজ করে তার দুই সন্তানকে নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। তার বড় ছেলে অষ্টম শ্রেণিতে ও ছোট ছেলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। বর্তমানে সে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে।
পারভিন আকতার : ৮ বছর বয়সে বাবা মারা যায় পৌরসভার পশ্চিম গোমদন্ডী এলাকার মেয়ে পারভিনের। মা ও ছোট দুই বোনকে নিয়ে বে-কায়দায় পড়েন পারভিন। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারে আয় করার মতো কোন লোক ছিলো না। এ অবস্থায় মাকে নিয়ে শীতলপাটি ও নকশী কাঁথা তৈরী করে বাজারে বিক্রি করে খেয়ে না খেয়ে কোন রকমে জীবন চলতো। তখন প্রাথমিকের পাঠ চুকিয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে পারভীন।
এভাবে চলার পর ১৯৯২ সালে উপজেলা আনসার ভিডি পি এর মাধ্যমে গ্রাম প্রতিরক্ষা দল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সেলাই কাজ শুরু করে পারভীন। একই সাথে অন্যদেরও সেলাই প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। ধীরে ধীরে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে আসে সংসারে। এর মধ্যে ছোট দুই বোনকে এইচএসসি পাশ করতে সাহায্য করে পারভীন। ১৯৯৩ সালে আনসার ভিডিপি ইউনিয়ন দলনেত্রী হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। সাথে সাথে যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে শীতল পাটি, নকশী কাঁথা, মোড়া ইত্যদি তৈরীর প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তিতে যুব উন্নয়ন থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বাঁশ, বেত ও সেলাই কাজে বিনিয়োগ করে আর্থিকভাবে লাভবান হন তিনি। ১৯৯৪ সালে গ্রামের অসহায় মহিলাদের নিয়ে আনসার ভিডিপি মহিলা সমিতি গঠন করেন। বর্তমানে একহাজার নারী সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন সামাজিক কাজে সহায়তা করে যাচ্ছেন পারভীন। ১৯৯৫ সালে একজন টেইলার মাস্টারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্বামীর অনুপ্রেরণায় নব উদ্যমে এগিয়ে চলতে থাকেন।


১৯৯৭ সালে ইউ এন ডিপি’র প্রো-এ্যাকটিভ গভর্নমেন্ট অব রুরাল ইয়ুথ ইন পার্টিসিপেটরি ডেভেলেপমেন্ট প্রকল্পে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ সালে পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন পল্লীজীবিকায়ন প্রকল্প এর মাধ্যমে পশ্চিম গোমদন্ডী খলিফা পাড়া মহিলা বিত্তহীন সমবায় সমিতি গঠন করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঋণ সঞ্চয় করে ৩৫ জন মহিলাকে স্বাবলম্বি করতে সক্ষম হন। বিআরডিবির আওতাধীন উপজেলা বিত্তহীন কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির সদস্যদের প্রত্যক্ষভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে ১৫ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে সমাজের অবহেলিত নারীদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একটি আর্থসামাজিক সংস্থা গড়ে তুলতে কাজ করে চলেছেন পারভীন আকতার।
রাবেয়া বেগম : রাবেয়া বেগমের দুই কন্যা সন্তান রেখে স্বামী মারা যায় ২০০৮ সালে। সন্তানদের নিয়ে অর্ধাহারে অনাহারে দিনাতিপাত করতে থাকেন স্বামীহারা রাবেয়া। তিনি বোয়ালখালীর কধুরখীল ইউনিয়নের অধিবাসী। মানুষের কাছে হাতপাতা লজ্জাজনক তাই নিজে কিছু করার কথা ভাবতে থাকেন তিনি। প্রথমে হাঁস মুরগী পালন ও শীতল পাটি বানানো শুরু করে। এতে ভালোই চলছিলো রাবেয়ার সংসার। কিন্তু রাবেয়া চিন্তা করেন ব্যাবসা কিভাবে আরো বাড়ানো যায়। তাই কাপড়ের ব্যাবসা শুরু করেন। এলাকায় কাপড় বিক্রি করতে গেলে তাকে নিয়ে এলাকার লোকজন বাজে মন্থব্য শুরু করেন। কারো কথা তোয়াক্ক না করে আপন উদ্যেমে কাপড়ের ব্যাবসা নিয়ে এগিয়ে যান তিনি। হয়েছেন অথনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী।


রাবেয়া বেগমের দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে বি এ দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যায়নরত ও ছোট মেয়ে সপ্তম শ্রেনিতে পড়ছেন। উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা এস এম জিন্নাত সুলতানা বলেন, প্রতিবছর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ কার্যক্রম পরিচালনা করে। তারই ধারাবাহিকতায় উপজেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয় বোয়ালখালী চট্টগ্রাম চেষ্টা করেছে, তৃণমুল পর্যায় থেকে উঠে আসা সফল মহিলাদের সাফল্য সবার সামনে নিয়ে আসতে। যাতে করে পিছিয়ে পড়া মহিলারা জীবন সংগ্রামে ঘুরে দাঁড়িয়ে, জীবনে সফল হন।