চট্টগ্রামের সর্বত্র করোনা ভাইরাস আতংক বিরাজ করছে। শুধু শহর নয়, গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে এ আতংক। কারো সাধারণ সর্দি-কাশি বা জ্বর হলেও লোকজন ভীত হয়ে পড়ছেন। রাস্তাঘাটে মানুষজন কমে গেছে। যানবাহন চলাচলও সীমিত হয়ে গেছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে আইসোলেসন ও হোম কোয়ারেন্টিন। চট্টগ্রামে একদিনে ৬০ জনসহ পুরো বিভাগে ৯৪১ জনকে হোমে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। কোয়ারেন্টিন অমান্য করায় ৬ প্রবাসীকে জরিমানা করা হয়েছে। এদিকে করোনা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, চিড়িয়াখানাসহ সকল বিনোদন কেন্দ্র।
জানা গেছে, চট্টগ্রামে এখনো করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয়নি। তারপরও আতংক বিরাজ করছে। শাহ আমানত বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্যানার বসানো হলেও সমুদ্র বন্দরে পরীক্ষা করা হচ্ছে হ্যান্ডহেল্ড থার্মোমিটারের মাধ্যমে। গত সপ্তাহে থার্মাল স্ক্যানার বসানোর কথা থাকলেও তা বসানো হয়নি।
সিভিল সার্জন সূত্রে জানা গেছে, বিদেশফেরত সকলকে হোম কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক। কেউ তা অমান্য করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। সর্দি, কাশি, জ্বর হলে তাকে আইসোলেসনে নেয়া হবে। এ পর্যন্ত বিদেশ ফেরত ২৯ জনকে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। ইতালি, চীন, ইরান, ফ্রান্স, জার্মান থেকে ফিরলে আইসোলেসনে রাখা হবে। কেউ পালাতে চাইলে বা আইসোলেসনে যেতে না চাইলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি জানান, চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ফৌজদারহাট বিআইটিআইডি হাসপাতালে ৫০ বেড, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের আইসিইউ সহ পুরো ৩০ বেড, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ১০০ বেড, রেলওয়ে হাসপাতালে ৫০ বেড, বন্দর ও সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত হাসপাতালগুলোতে ১০টি করে সহ মোট ৩৫০টি বেড আইসোলেসন হিসেবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়াও উপজেলা পর্যায়ে রাউজান, হাটহাহাজারী, ফটিকছড়ি, আনোয়ারা, সীতাকুন্ড ও বোয়ালখালী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রতিটিতে ১০টি করে বেড প্রস্তুত রাখা হয়েছে। অন্যান্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ৫টি করে বেড প্রস্তুত রাখা হয়েছে আইসোলেসন হিসেবে।
জানা গেছে, হোম কোয়ারেন্টাইন হিসেবে কয়েকটি স্কুল ও হোটেলকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। হালিশহর পিএইচ আমিন একাডেমি ও চান্দগাঁও সিডিএ গার্লস স্কুল এন্ড কলেজকে হোম কোয়ারেন্টাইন হিসেবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়াও দু’টি হোটেলও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে স্টেশন রোডের হোটেল সৈকত ও চকবাজারের ওয়েস্টার্ন পার্ক।
সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি জানান, আতংকের কোন কারণ নেই। করোনা সনাক্ত কীট ও সরঞ্জামি মজুদ রয়েছে। বিদেশ ফেরতদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে তেমন সমস্যা হবে না।
বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের তথ্য মতে, চট্টগ্রাম বিভাগে এ পর্যন্ত ৯৪১ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। তন্মধ্যে চট্টগ্রামে ৯১ জন, কক্সবাজারে ২ জন, রাঙামাটিতে ১০ জন, খাগড়াছড়িতে ১২ জন, নোয়াখালীতে ৭৪ জন, ফেনীতে ৫৪ জন, কুমিল্লায় ৩১২ জন, লক্ষীপুরে ২১৪ জন, চাঁদপুরে ১৫৮ জন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ১৪ জন। তবে বান্দরবানে কেউ হোম কোয়ারেন্টাইনে নেই।
চট্টগ্রামে গতকাল বুধবার একদিনেই ৬০ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। এরমধ্যে ওমরাহ হজ পালন করে ফেরা ৫৬ জন রয়েছেন। বাকি ৪ জন ইতালি ফেরত।
বন্ধ বিনোদন কেন্দ্রসমূহ :
চট্টগ্রামে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, চিড়িয়াখানাসহ সকল বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। করোনা সতর্কতার অংশ হিসেবে বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে সবধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সিএমপি। গতকাল বুধবার দুপুরে সিএমপির পক্ষ থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
সিএমপি কমিশনার মো. মাহাবুবুর রহমান বলেন, সরকার করোনা ভাইরাসের কারণে সতর্কতার অংশ হিসেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ বাড়িতে থাকার নির্দেশনা দিয়েছে।
তিনি বলেন, উদ্ভূদ পরিস্থিতিতে সবাই যেখানে বাড়িতে সতর্কতার সঙ্গে থাকবেন, সেখানে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে ভিড় করছেন। তাই পুলিশের পক্ষ থেকে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে সবধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
সিএমপির নিষেধাজ্ঞা জারির পর পতেঙ্গা সৈকতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বুধবার সকাল থেকে সৈকতে আসা লোকজনকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উৎপল বড়ুয়া। পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত পতেঙ্গা সৈকতে সবধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ থাকবে বলে জানান তিনি।
এছাড়া কর্ণফুলী শিশু পার্ক, জাম্বুরী পার্ক, চিড়িয়াখানাও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। করোনা ঝুঁকি এড়াতে স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী এমন নির্দেশনা বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সদীপ কুমার দাশ বলেন, সিএমপি কমিশনার মাহবুবুর রহমানের নির্দেশনায় বুধবার থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ করা হয়েছে নগরীর পর্যটনস্পট জাম্বুরী পার্ক ও কর্ণফুলী শিশু পার্ক।
লিফলেট বিতরণ :
নগরীর নিউমার্কেট, জহুর মার্কেট, জলসা মার্কেট ও আশপাশের এলাকায় মানুষের মাঝে ‘নোভেল করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে করণীয়’ বিষয়ক লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। গতকাল বুধবার সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বিভাগীয় কমিশনার এ বি এম আজাদ ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন এসব জনসমাগম এলাকায় লিফলেট বিতরণ করেন। লিফলেট বিতরণকালে বিভাগীয় কমিশনার এ বি এম আজাদ বলেন, ইতালি, যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য দেশ থেকে চট্টগ্রামে আসা বাংলাদেশী লোকজনের মধ্যে এ পর্যন্ত একজনেরও করোনা ভাইরাস সনাক্ত হয়নি। তবে বিদেশযাত্রীরা এখানকার বিমানবন্দরে নামার পর থার্মাল স্ক্যানার, হেলথ থার্মার ও হ্যান্ডহেল্ড মিটার দিয়ে পরীক্ষা করার পর তাদের মধ্যে জ্বর, সর্দি, কাশি, হাঁচি বা করোনার লক্ষণ দেখা দিলে তাদের ১৪ দিনের জন্য সরাসরি নিরাপদ হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়ে দিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে। কেউ হোম কোয়ারেন্টাইন অমান্য করলে তাদের জন্য মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জেল-জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন বলেন, করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে হলে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার বিকল্প নেই। সাবান ও পানি দিয়ে ঘনঘন পুরো হাত ধোয়ার পাশাপাশি অ্যালকোহলমুক্ত স্যানিটাইজার দিয়ে তালুসহ হাত পরিস্কার রাখতে হবে। হাঁচি বা কাশি দেওয়ার সময় হাতের কনুইয়ের ভাঁজে বা টিস্যু দিয়ে নাক ঢাকতে হবে। ব্যবহৃত টিস্যুটি দ্রুত বন্ধ বিনে ফেলে স্যানিটাইজার বা সাবান ও পানি দিয়ে হাত পরিস্কার করতে হবে। পরিচিত বা অপরিচিত ব্যক্তির সাথে হাত মেলানো বা আলিঙ্গন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অপরিস্কার হাত দিয়ে চোখ, নাক, ও মুখ স্পর্শ করা যাবে না। এসব বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার জন্য লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে।
জরিমানা আদায় :
হোম কোয়ারেন্টিন অমান্য করে প্রকাশ্যে চলাফেরা করায় ৬ প্রবাসীকে ৫৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। গতকাল বুধবার বিকেলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেনের নির্দেশে পটিয়া, হাটহাজারী, রাউজান, আনোয়ারা, লোহাগাড়া ও নগরীর ষোলশহরে পৃথক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, হোম কোয়ারেন্টিন অমান্য করে প্রকাশ্যে চলাফেরা করার দায়ে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রুহুল আমীন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে শারজাহ্ ফেরত প্রবাসী সাজ্জাদ হোসেনকে ১০ হাজার টাকা, পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা জাহান উপমা আবুধাবী ফেরত প্রবাসী আজিম উদ্দিনকে ১০ হাজার টাকা, আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ যোবায়ের হোসেন দুবাই ফেরত প্রবাসী মুহাম্মদ ইদ্রিছকে ১০ হাজার টাকা, রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জোনায়েদ আহমদ সোহাগ ওমান ফেরত প্রবাসী মিঠুন চক্রবর্তীকে ১০ হাজার টাকা, লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তৌছিফ আহমেদ ওমান ফেরত প্রবাসী আবুল হোসেনকে ৫ হাজার টাকা এবং নগরীর কাট্টলী সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. তৌহিদুল ইসলাম ষোলশহর ২নং গেট এলাকার দুবাই ফেরত প্রবাসী মো. আজিজকে ১০ হাজার টাকা সহ সর্বমোট ৫৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন। একই সাথে তাদের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা হয়। এছাড়া করোনার কারণে নিষিদ্ধ সময়ে কোচিং ব্যবসা পরিচালনার দায়ে নগরীর ৩ কোচিং সেন্টারকে ১ হাজার টাকা করে ৩ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. আবু হাসান সিদ্দিক ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
প্রতিরোধ কমিটি গঠন :
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনকে সভাপতি করে ১০ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগ প্রেরিত আদেশের আলোকে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল বুধবার চসিকের টাইগারপাস কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে কমিটি গঠন বিষয়ে যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। কমিটিতে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. হাসান শাহরিয়ার, সিভিল সার্জন ডা. সেখ মো. ফজলে রাব্বি, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বি. জেনারেল মো. হুমায়ুন কবির, চসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. সেলিম আকতার চৌধুরী, চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এ উপলক্ষে আয়োজিত সভায় মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে গঠিত কমিটি জাতীয় কমিটির নির্দেশনা বাস্তবায়ন, সচেতনতা সৃষ্টি, প্রয়োজনে কোয়ারেন্টাইনসহ প্রয়োজনীয় আর্থিক ও লজিস্টিক সহায়তার বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া, করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত যে কোনো তথ্য পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাসহ জাতীয় কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবে। করোনা ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হতে হবে। আমরা জনসচেতনতায় লিফলেট বিতরণসহ নানামুখী প্রচারণা চালাচ্ছি।
হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিদের আত্মসচেতন হয়ে সরকারি নির্দেশনা মেনে চলার জন্য মেয়র অনুরোধ জানান।