মো. হুমায়ুন করিম চৌধুরী
মৌলভী হাফিজুর রহমান বি এ বি টি একজন কিংবদন্তি শিক্ষাবিদ, আধ্যাত্মিক সাধক ও ব্রিটিশ পাক আমলের তদানীন্তন সরকার বিবেচনায় পাক ভারতো উপমহাদেশের একজন দেশ বরেণ্য প্রধান শিক্ষক।
ব্রিটিশ ভারত সময়ে উত্তর চট্টগ্রাম এমনিতেই রতœগর্ভা জনপদ। শিক্ষা দীক্ষা, জ্ঞান বিজ্ঞান সাহিত্য সৃজনশীলতা সর্বোপরি রাষ্ট্র ও সমাজ সংস্কারক কালজয়ী নানান ব্যক্তিত্ব তাদের মেধা প্রজ্ঞায় উনাদের হার না মানা ব্যক্তিত্ব সাফল্য জৌলুশে এই জনপদে কিংবদন্তিতুল্য মানুষ গুলো ব্যাপকভাবে পদচারণা করেছেন।
উনাদের সেই সমকক্ষতায় হযরত মৌলভী হাফিজুর রহমান (রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহী) অন্যতম।
উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে রাউজানের মোহাম্মদপুর ছায়া সুনিবিড় এক গ্রামীণ সমাজে সম্ভ্রান্ত পরিবারে এক মহিয়সী মাতার ঘর আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা হতে সুতীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী মানুষটি একাডেমিক লাইফের প্রতিটি পর্যায়ে নিখুঁত প্রতিভা, মেধা আর জ্ঞান যশের সাক্ষর রেখেছিলেন।
শৈশবের কোন এক দিনে বাবার সাথে আধ্যাত্মিকতার প্রাণকেন্দ্র মাইজভাÐার দরবার শরীফে গমন করেন কোন এক মান-মানসে। সেইসময় সেখানে হযরত গাউসুল আজম মাইজভান্ডারি বাবা ভান্ডারি গোলামুর রহমান কেবলা (কাদ্দাসাল্লাহু সিররাহুল আযিয) জাহেরি হায়াতে বর্তমান ছিলেন, যাঁকে ইউসুফে সানী বলা হয়।অর্থাৎ; নবী হযরত ইউসুফ (আলাইহীস সালাম)”র মতো তিনি সুন্দর ছিলেন। আল্লাহর এই মহান অলী নিজের পবিত্র শরীর মোবারক একটি চাঁদর দিয়ে ঢেকে রাখতেন, দর্শনার্থীদের সাক্ষাত দিতেন।যখন আমার নানাজান ওনার আব্বার সাথে দরবার শরীফে যান তখন বাবা ভান্ডারি হুজুর নিজের চাঁদর শরীফ তুলে আমার নানাজানের দিয়ে তাকিয়ে মুছকি হেসে ওনার হাতে থাকা লাঠি মোবারক দিয়ে নানার কপালে লাগান এবং দোয়া করেন। এরপর ওনার ভিতর একটি অন্যরকম আধ্যাত্মিক আবহ ধারন করতে থাকেন এবং ব্যক্তিগত জীবন চরিতে পরিবর্তন চলে আসে। আজকের দিনেও মহান ফকিহ আলেম ওলামারা এই রহানী সম্পর্ক নানান ভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন, বস্তুত এই কাজটি সম্পাদন করার মাধ্যমে বাবা ভান্ডারি এই শিশু প্রাণটির দিকে রহমত দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। এই শিশুটি যে বড় হয়ে বড় দরবেশ হবেন তা বাবা ভান্ডারি দেখতে পেয়েছিলেন। আল্লাহর অলীরা মহান আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা বলে মানুষের ভবিষ্যত দেখতে পান। বাবা ভান্ডারি এই শিশুটির দিকে আধ্যাত্মিকতার তাওয়াজ্জুহ বখশিশ করেন।
আমরা শরীয়তায়নার মসনদী মাহাবুব তথা হযরত গাউসে মাইজভান্ডারি বাবা ভান্ডারি (কাদ্দাসাল্লাহু সিররাহুল আযিয)’র সেই ঘটনা। মূলত: বাবা ভান্ডারি হুজুর সেই দিন আমার নানুজীকে কামালিয়াতের মর্যাদায় পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ; বাবা ভান্ডারি হুজুর সেই উঁচু মর্তবাসম্পন্ন অলী ছিলেন যে,পুরো পৃথিবীকে যদি চার ভাগ করা হয়।তৎমধ্যে একটি অঞ্চল তথা পৃথিবীর পূর্ব অঞ্চলের আধ্যাত্মিক সম্রাট ছিলেন ওনারা।ওনি কারো দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকালে তিনি অলীয়ে কামেলে পরিণত হতেন।আমার নানা সেই সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। আরেকবার, রাউজানের গহিরায় তাশরিফ নিয়ে আসেন এই উপমহাদেশের প্রখ্যাত অলী আল্লাহ,আউলাদে রাসূল (সা.), জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার প্রতিষ্ঠাতা, হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি (রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহী)। মা ফাতেমা (রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহা)’র বাগানের এই নূরাণী সন্তানকে দেখতে,কুতুবুল আউলিয়ার সান্নিধ্য পেতে আমার নানাজান সুদূর মোহাম্মদপুর হতে গহিরায় আসেন। যথারীতি সালাম ও কুশল বিনিময় শেষে যখন হযরতের জন্য তাবাররুকাত পরিবেশন করা হয়। তখন আমার নানাকে শাহেনশাহে সিরিকোটি হুজুরের পাশেই বসানো হয়। আলাপচারিতার ফাঁকে সিরিকোটি হুজুর নিজের পাত হতে এক টুকরো মাংস ছিঁড়ে আমার নানাকে খেতে দেন।ইংরেজিতে একটি কথা আছে- “ডায়মন্ড কাটস্ ডায়মন্ড”। অর্থাৎ; রতনে রতন চিনে।একজন প্রকৃত অলী আরেকজন প্রকৃত অলীকে চিনেন ও মহব্বত করেন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে মূলত: সিরিকোটি হুজুর আমার নানার দিকে রহমতের ফয়েজ বখশিশ করেন। ইংরেজি শিক্ষিত হবার কারণে নিজের বুযুর্গীয়ত বা কামালিয়াতকে খুব গোপন করে চলতেন। আধ্যাত্মিকতাকে লুকিয়ে রাখতেন। প্রকাশ হতে দিতেন না।এটাই প্রকৃত অলীআল্লাহদের বৈশিষ্ট্য।ওনারা নিজেদের গোপন রাখতে পছন্দ করেন।সমসাময়িক আউলিয়ায়ে কেরামগণের সাথে ছিল ওনার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। যেমন- মাইজভান্ডার দরবার শরীফের হযরত দেলাওয়ার হোসাইন মাইজভান্ডারি (রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহী),হযরত আবদুচ্ছালাম ইছাপুরী (রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহী), রাঙ্গুনিয়ার বেতাগীর হযরত হাফেজ বজলুর রহমান বেতাগী (রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহী), রাউজান হাজিপাড়া হযরত বড় মাওলানা সাহেব হুজুর (রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহী),সৈয়দ কালিমুল্লাহ শাহ (রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহী), হযরত আবদুল লজলিল মিয়া (রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহী), লোহাগাড়ার হযরত পেঠান শাহ (রহঃ) অনেক সাধক মহাপুরুষ দের অপার্থিব সান্নিধ্যে নিজেকে আপনলোকে সমৃদ্ধ করেছেন।
মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে যুদ্ধ দিনের ভয়াবহতায় সময় নানুপুর তথা বাংলাদেশের অন্যতম যুদ্ধ শরনার্থী শিবিরে মহান সাধক মৌলভী হাফিজুর রহমান বি এ বি টি সাহেবের আধ্যাত্মিকতা আর সময়োচিত কর্ম সংগঠনের মাধমে এতদ অঞ্চলের মানুষকে নিরাপদ রেখেছিলেন এবং নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন তা আজ এই অঞ্চলের মানুষের কাছে ব্যাপক ভাবে সমাদৃত ও অগ্রগণ্য। জীবন দশায় ইংরেজি বাংলা ব্যাকরণ বই প্রকাশ করেন যাতে পিছিয়ে পরা এই জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক কল্যান হয়। উনার বাংলা ইংরেজী, আরবী ফার্সী তে গল্প কবিতা, হামদ নাত, কছিদা নিজ জৌলুশে সাহিত্য সম্ভারে সমাদৃত। মহান ব্যাক্তিত্ব মৌলভী হাফিজুর রহমান বি এ বি টি সাহেব চির-স্মরণীয় হয়ে থাকুক এই লোকালয়ে। সরকার আর রাষ্ট্র চিন্তকদের কাছে একমাত্র আরজ মহান মৌলভী হাফিজুর রহমান বি এ বি টি একজন কিংবদন্তি শিক্ষাবিদ, আধ্যাত্মিক সাধক হিসেবে কীর্তি স্মারককে রাষ্ট্রীয় ভাবে মূল্যায়ন করা হউক।
লেখক: কলাম লেখক ও
সম্পাদক দিব্যলোকের মহাযাত্রী