সাতকানিয়ায় কমেছে পানি ভেসে উঠছে ক্ষতচিহ্ন

32

দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় বন্যার ভয়াবহতা কমেছে। অনেক এলাকা থেকে নেমে গেছে বন্যার পানি। বন্যার পানি কমে যাওয়ায় ঘর ছেড়ে অন্যত্রে আশ্রয় নেয়া লোকজন ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। তবে অধিকাংশ গ্রামীণ সড়কে খানাখন্দের সৃষ্টি হওয়ায় ঘরমুখো মানুষগুলো পড়েছেন দারুণ দুর্ভোগে, যান চলাচলে ঘটছে বিঘœ। অনেক এলাকায় যানবাহন চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারি হিসেবে এখনো উপজেলায় অর্ধেকেরও কম সংখ্যক মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কেরাণীহাট-বান্দরবান সড়কের বাজালিয়া অংশে বিদ্যমান কোমর সমান পানি কমতে থাকায় টানা আট দিন পর সচল হয়েছে পার্বত্য জেলা বান্দরবানে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে টানা কয়েকদিন ধরে চলামান ত্রাণ তৎপরতা গতকাল মঙ্গলবারও অব্যাহত ছিল। সরেজমিনে পরির্দশনকালে দেখা যায়, বাজালিয়া-পুুরানগড় সড়কের বাজালিয়া মোটর স্টেশনে অন্ততঃ ৩০ ফুট সড়ক বন্যার পানির স্রোতে বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। সড়কে ভারি যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। কালিয়াইশ ইউনিয়নের বিওসির মোড় থেকে মাস্টারহাট পর্যন্ত সড়কের বেশ কয়েকটি স্থানে সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল বিশাল গর্ত। এসব গর্তের কারণে যানবাহন চলাচলতো দূরের কথা, সাধারণ মানুষের যাতায়াতই কষ্টকর। ছদাহা ইউনিয়নের দস্তিদারহাট-মিঠাদিঘী সড়কে হাঙ্গরখালের পানির স্রোতে কালভার্ট ভেঙে গিয়ে এ সড়কেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
পুরানগড় ইউনিয়নে বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে সবজি চাষীদের। শুধুমাত্র এ ইউনিয়নে অন্ততঃ ১২’শ একর জমির সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। এ ইউনিয়নে উৎপাদিত সবজি পুরো চট্টগ্রামে সরবরাহ হয়। পুরানগড় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আ ফ ম মাহবুবুল হক সিকদার জানান, প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় সবজি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ অন্ততঃ ৩০ কোটি টাকা। একই ইউনিয়নের সুয়ালক খালের সেতুর একটি অংশ ধসে যাওয়ায় এ সড়কে যান চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে বলে তিনি জানান।
বাজালিয়া ইউনিয়নের চৌধুরীর পাড়ায় বন্যার পানির স্রোতে বিলীন হয়ে যাওয়া বসতঘরের মালিকদের সাথে কথা বলে তাদের বসতঘরের ব্যবস্থাসহ সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন সাতকানিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোবারক হোসেন। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে আমরা বন্যার শুরু থেকে এ পর্যন্ত বন্যার্ত মানুষের মাঝে শুকনো ও রান্না করা খাবার, নগদ টাকা ও চাউল বিতরণ করেছি।
গত ৮ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ভারি বর্ষণের ফলে সাতকানিয়ার কেওচিয়া, ঢেমশা, পশ্চিম ঢেমশা, বাজালিয়া, পুরানগড়, ধর্মপুর, কালিয়াইশ, খাগরিয়া, নলুয়া, আমিলাইশ, কাঞ্চনা, এওচিয়া, চরতী, সাতকানিয়া পৌরসভার বিভিন্ন এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়। পানি উঠে সাতকানিয়া উপজেলা পরিষদ, সাতকানিয়া আদালত, সাতকানিয়া থানা, সাতকানিয়া কলেজ, সাতকানিয়া আদর্শ মহিলা কলেজ, জাফর আহমদ চৌধুরী ডিগ্রী কলেজ, বাজালিয়া অলি আহমদ বীর বিক্রম ডিগ্রী কলেজসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ৪ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত পানি উঠে যায়। উপজেলার সবচেয়ে উঁচু এলাকা হিসেবে পরিচিত কেরাণীহাটও এই বন্যা থেকে রেহাই পায়নি।
তবে গত রবিবার রাত থেকে পানি কমতে শুরু করে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (মঙ্গলবার রাত ৯ টা) সময়ে কেরাণীহাট থেকে দস্তিদার হাট পর্যন্ত সড়ক থেকে বন্যার পানি নেমে গেছে। সড়কের আশেপাশে উঁচু এলাকা থেকে পানি কমলেও নিচু এলাকার লক্ষাধিক মানুষ এখনো পানি বন্দি রয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ তৎপরতা
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে সরকারিভাবে প্রশাসন ছিল তৎপর। নিয়মিত ত্রাণ বিতরণ, প্রয়োজনীয় খাদ্য ও অর্থ সহায়তা ছিল চোখে পড়ার মতো। গতকালও এ তৎপরতা অব্যাহত ছিল। এর মধ্যে চরতী, আমিলাইষসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে ত্রাণ বিতরণ করেছেন সংসদ সদস্য প্রফেসর ড. আবু রেজা মোহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী। এছাড়াও কেওচিয়া, বাজালিয়া, ঢেমশাসহ আরো বেশ কিছু ইউনিয়নে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে চাউলসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ বিতরণ করেছেন সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোবারক হোসেন। বাজালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের তাপস চেয়ারম্যান সরকারি ত্রাণ ছাড়াও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বন্যার্তদের সার্বিক সহযোগিতা করেছেন, তৎপর ছিলেন নজরদারিতেও। এই সড়কে আটকে পড়াদের জন্য নৌকার ব্যবস্থা করেছেন। চরতী, আমিলাইষ, নলুয়া এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করেছেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক নুরুল আবছার চৌধুরী। কেঁওচিয়ায় চাউল বিতরণ করেছেন উত্তর সাতকানিয়া যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী। কেরাণীহাট মা-শিশু জেনারেল হসপিটালের পক্ষ থেকে কেওচিয়ার ব্যবসায়ী পাড়াসহ আরো কয়েকটি গ্রামে চাউল বিতরণ করা হয়েছে। একই ইউনিয়নে চাউল বিতরণ করেন দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক আমিনুল ইসলাম। নলুয়ায় বন্যার্ত মানুষের মাঝে ব্যাপক আকারে ত্রাণ বিতরণ করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান। পুরানগড়ে বন্যার্ত মানুষের মাঝে চাউল বিতরণ করেছেন শিল্পপতি আমানুর রশিদ হিরু।
সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোবারক হোসেন বলেন, এ বন্যায় অন্ততঃ ৪ লক্ষাধিক লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো পর্যন্ত লক্ষাধিক লোক পানিবন্দি অবস্থায় আছে। আমরা চেষ্টা করছি সকলের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিতে। বেসরকারিভাবেও বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান ত্রাণ বিতরণ করছেন। সব মিলিয়ে সরকারি উদ্যেগে এ পর্যন্ত ১২৫ মেট্রিক টন চাউল, নগদ আড়াই লক্ষ টাকা ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।