সাতকানিয়া কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ শহীদ কামিনী কুমার ঘোষ

1

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

আইনবিদ, শিক্ষাবিদ, সমাজহিতৈষী, শহীদ বুদ্ধিজীবী রায় সাহেব কামিনী কুমার ঘোষ ১ জানুয়ারি ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে সাতকানিয়া থানার কাঞ্চনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পিতামাতার তৃতীয় সন্তান। পিতা চৈতন্য চরণ ঘোষ এবং মাতা কমলা ঘোষ। চৈতন্য চরণ ঘোষ, বঙ্গ চন্দ্র ঘোষ ও দীনবন্ধু ঘোষ এরা এক পিতার তিন সন্তান। চৈতন্য চরণ ঘোষ বর্তমান ঘোষ বাড়ির পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত রাস্তার উত্তর পার্শ্বের ভিটার নতুন বাড়িতে উঠে আসলে ঘোষদের বাড়ি নতুন বাড়ি ও পুরাতন বাড়ি এ দু’অংশে পরিচিতি পায়। নতুন ভিটায় নতুন বাড়িটি বর্তমানে রায় সাহেব কামিনী কুমার ঘোষের বাড়ি নামে সুপরিচিত। চৈতন্য চরণের তিন ছেলে- (১) অন্নদা চরণ ঘোষ (২) ত্রিপুরা চরণ ঘোষ (৩) কামিনী কুমার ঘোষ।
গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে বালক কামিনী কুমার ঘোষের প্রাইমারি শিক্ষা জীবন শুরু হয়। আমিলাইষ গ্রামের ললিত মোহন চৌধুরী ও কামিনী কুমার ঘোষ পরস্পরের সহপাঠী ও বন্ধু ছিলেন বলে জানা যায়।
কাকা বঙ্গচন্দ্র ঘোষ ছিলেন চট্টগ্রাম জজকোর্টের একজন স্বনামধন্য মোক্তার। তাঁর কাছে থেকে পড়াশোনার জন্য কামিনী কুমার ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন। বর্তমান ঘাটফরহাদবেগ কুয়োর পার্শ্বের ঘোষদের বাসাটি তাঁরই। বঙ্গচন্দ্র ঘোষ ঐ বাসায় থেকে আইন ব্যবসা করতেন। তিনি তাঁর ভাইপো কামিনীকে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দেন। কলেজিয়েট স্কুলে ৬ বছর সুনামের সাথে লেখাপড়া শেষে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে সরকারী বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন কামিনী বাবু।
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে যুবক কামিনী কুমার ঘোষ চট্টগ্রাম কলেজে আই এ ক্লাশে ভর্তি হন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিভাগে আই.এ পাস করেন। এবারও কৃতিত্বের সাথে সরকারী বৃত্তি লাভ করেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের বাইরে ব্রিটিশ ভারতের কলকাতা শহরে বহু সুনামের স্বাক্ষর প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন কামিনী কুমার ঘোষ। এ কলেজ থেকে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে গণিতে অনার্সসহ বি.এ পাস করেন। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পালা।
১৯১২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন কামিনী বাবু। তাঁর নামের পাশে যোগ হয় এম.এ, বি.এল। এখানেই কামিনী কুমার ঘোষ তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষ করে ফিরে আসেন চট্টগ্রামে। এ চট্টগ্রামকেই ঘিরে আবর্তিত হয় তাঁর কর্মজীবন আর ব্যক্তিগত গার্হস্থ্য জীবন। গ্রামের মানুষকে নিয়ে তাঁর সামাজিক জীবন ও রাজনৈতিক জীবন।
প্রথমে তিনি কাকা দীনবন্ধু মোক্তার-এর সাথে আইন পেশায় শিক্ষানবিশ হিসাবে যোগদান করেন। পরে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম জজ কোর্টে স্বাধীন আইন ব্যবসা শুরু করেন। এর মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। জজ কোর্টে আইন ব্যবসা শুরুর পর ব্যবসায় বেশ অর্থাগম হয়। তাই কাকা বঙ্গচন্দ্র ঘোষ মোক্তার সাহেবের পার্শ্বে নতুন বাসার মালিক হন। এ বাসার নাম রাখেন তার প্রথম পুত্র সন্তান চিত্তরঞ্জনের নামানুসারে চিত্তভিলা। এ পুত্র সন্তান অতি শৈশবে এক শীতের সকালে মারা যায়। তা ছিল ১৯২৩-২৪ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। এ সময় কামিনী কুমার ঘোষ কোমরে স্নায়ুবিক বেদনায় আক্রান্ত হন। পুত্র সন্তান বিয়োগে শোকসন্তপ্ত পিতা-মাতা চিত্তভিলা-কেও পরের হাতে বিকিয়ে দেন। এর মধ্যে তিনি প্রায় ১২-১৩ বছর যাবৎ চট্টগ্রাম জজ কোর্টে ওকালতি ব্যবসা করেন। কোমরের স্নায়ুবিক বেদনা নিয়ে পাহাড়ি চট্টগ্রাম জজ কোর্ট ছেড়ে সমতলভূমির সাতকানিয়া মুন্সেফ কোর্টে ওকালতি পেশায় যোগদান করতে হয় তাঁকে। এবার সাতকানিয়ায় মোজাফফর মোক্তারের বাড়ির পশ্চিম দিকে নতুন বাসা বাড়ি তৈরি হয় তাঁর জন্য। এ সময় ব্রিটিশ সরকার প্রভাবশালী শিক্ষিত সমাজসেবক ব্যক্তিত্ব হিসেবে কামিনী কুমার ঘোষকে রায় সাহেব উপাধিতে ভূষিত করেন।
১৯২১ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধী ভারত শাসন আইনের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। মহাত্মার অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে কামিনী কুমার এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও আদর্শ প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত করেন এবং একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরূপে সমাজে সমভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্বিচারে জনগণ তাঁকে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করেন। যেমন-চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের নির্বাচনে তিনি দু’বার সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। কাঞ্চনা ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন। এ সময় তিনি সাতকানিয়া-বাঁশখালী এডুকেশন সোসাইটি গঠনের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে শিক্ষার আলো বিস্তারে উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে নিজ গ্রাম কাঞ্চনায় পার্শ্ববর্তী আমিলাইষ গ্রামের বাল্যবন্ধু ললিত মোহন চৌধুরী ও অন্যান্য বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিদের একত্রিত করে প্রথম শ্রেণীর উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এ বিদ্যালয় আমিলাইষ কাঞ্চনা বঙ্গচন্দ্র ঘোষ ইনস্টিটিউট নামে সুপরিচিত। তিনি এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আজীবন সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কাঞ্চনা বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায়ও তাঁর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।
পারিবারিক জীবনে তিনি ছিলেন পাঁচ পুত্র সন্তান ও পাঁচ কন্যা সন্তানের জনক। পুত্রদের মধ্যে প্রথম চিত্তরঞ্জন ঘোষ-শৈশবেই মারা যায়। দ্বিতীয় বাদল ঘোষ বা দেব প্রসাদ ঘোষ-তিনিও পরে মারা যান। তাঁর এক ছেলে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সুবীর ঘোষ এবং এক মেয়ে অলকা ঘোষ, শিক্ষয়িত্রী। রায় সাহেবের তৃতীয় পুত্র মিলন ঘোষ বা শিব প্রসাদ ঘোষ ও চতুর্থ পুত্র হারাধন ঘোষ বা রমা প্রসাদ ঘোষ পিতার পরে মারা যান। পঞ্চম পুত্র কনক ঘোষ বা শ্যামা প্রসাদ ঘোষ ছাত্র জীবনে প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার সময় ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ১৯৬২-৬২ শিক্ষাবর্ষে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র সংসদের ভি.পি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন। কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায় নিয়োজিত হন।
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে রায় সাহেব কামিনী বাবুর স্ত্রী শৈলবালা মারা যান। এ সময় তাঁর দ্বিতীয় পুত্রের বয়স ছিল দশ বছর এবং পঞ্চম পুত্র শ্যামা প্রসাদের বয়স ছিল প্রায় তিন বছর। রায় সাহেব কামিনী বাবুর পাঁচ কন্যার নাম হল- ১) নিভারাণী ঘোষ ২) বকুল রাণী ঘোষ ৩) পারুল রাণী ঘোষ ৪) গীতা রাণী ঘোষ ও ৫) কুলিকা ঘোষ। মা হারা এ সন্তানেরা বাপের স্নেহ আদরে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠেন। রায় সাহেব যথাসময়ে পঞ্চ কন্যাকে সৎপাত্রে প্রদান করেন।
ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ষাট-ঊর্ধ্ব বয়সে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে কামিনী কুমার ঘোষ সাতকানিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত হন। এ কলেজের জন্য তাঁর সফল প্রাথমিক প্রচেষ্টার মূল ভূমিকা ছিল সর্বজনপ্রশংসিত। আইন ব্যবসার পাশাপাশি তিনি নব প্রতিষ্ঠিত সাতকানিয়া কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দু’বছর তিনি বিনা বেতনে কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এতগুলো জনহিতকর ক্রিয়াকান্ডে তাঁর যুক্ত হওয়া সম্ভব হয় নিম্নোক্ত কারণে
১। তিনি প্রায় ২৮ বৎসর কাল যাবৎ চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সক্রিয় সদস্য এবং ৭ বৎসর কাল যাবৎ জেলা পরিষদের সহ-সভাপতি বা ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তখন গ্রামবাসীর স্বাস্থ্যসেবায় কাঞ্চনা স্কুলের উত্তর পার্শ্বে দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেন। যোগাযোগের জন্য নতুন জেলা বোর্ডের রাস্তা নির্মাণ ও বহু কালভার্ট স্থাপন করেন। পানীয় জলের সুবিধার জন্য নলকূপ স্থাপন করেন।
২। তিনি চট্টগ্রাম সদর লোকেল বোর্ডের ও চট্টগ্রাম জেলা স্কুল বোর্ডের ১৬ বৎসর সদস্য ছিলেন। এ সময় বিভিন্ন স্কুলের উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন এবং গ্রামে শিক্ষা বিস্তারে জনগণকে উৎসাহিত করেন।
৩। তিনি বেঞ্চ কোর্টের সভাপতিরূপে ২৫ বৎসর কাল যাবৎ দায়িত্ব পালন করেন।
৪। তিনি জেলার গ্রাম উন্নয়ন কমিটি, পানীয় জল সরবরাহ কমিটি, খাদ্য কমিটি, সৈনিক বোর্ড ও জেলা পরিদর্শক কমিটি সমূহের অন্যতম সদস্যরূপে দীর্ঘকাল দায়িত্ব পালন করেন।
৫। তিনি নিজ গ্রামে কাঞ্চনা ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচিত প্রেসিডেন্টরূপে গ্রামের জনগণের সেবা করার সুযোগ লাভ করেন।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম দিকে ২৪ এপ্রিল বেলা সাড়ে এগারটায় দোহাজারি সেনা ক্যাম্প থেকে পাকসেনারা এসে তাদের কিছু দোসরসহ কাঞ্চনা গ্রাম আক্রমণ করে। তাদের আক্রমণের লক্ষ্যস্থল ছিল আওয়ামী লীগ নেতা ও তৎকালীন নির্বাচিত এম,পি ডা. ফয়েজুর রহমানের বাড়ি ও কাঞ্চনা গ্রামের হিন্দু স¤প্রদায়ের বাড়িঘর ও লোকজন। পাক সেনারা হিন্দু সম্প্রদায়ের সকল বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং নির্বিাচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করে। এ হত্যাযজ্ঞে পাক সেনাদের বিশেষ সহযোগী দোসরের নির্দেশনায় শহীদ হন চুরাশি বছরের বৃদ্ধ বুদ্ধিজীবী চট্টলার অন্যতম প্রাণপুরুষ ও শিক্ষানুরাগী রায় সাহেব কামিনী কুমার ঘোষসহ আরো ক’জন হিন্দু স¤প্রদায়ের লোক। কাঞ্চনা হাই স্কুল (এ.কে.বি.সি ঘোষ ইনস্টিটিউট) এর উত্তর পার্শ্বে পুকুর পাড়ের উত্তর পশ্চিম কোণায় রয়েছে এ শহীদ বুদ্ধিজীবীর শ্মশান।
জানা যায়, রায় সাহেব কামিনী বাবুর শেষ ইচ্ছা ছিল নিজ গ্রামের কাঞ্চনা স্কুলকে সংশ্লিষ্ট করে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা। তাই তিনি ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে এ.কে.বি.সি ঘোষ ইনস্টিটিউট-এ বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পার্শ্বে কয়েকটি কক্ষ তৈরির কাজে অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু তা বাস্তবে রূপ দিতে পারলেন না তিনি। কারণ দেড় বছর পরেই তিনি নাম লেখালেন স্বাধীনতা ইতিহাসের শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায়।
কালস্রোতে রায় সাহেব কামিনী কুমার ঘোষের সন্তানেরা এ কাঞ্চনা গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু রায় সাহেবের কীর্তি এ.কে.বি.সি ঘোষ ইনস্টিটিউট নামক এ বিদ্যালয়টি ১৯২৯ সাল থেকে এ অঞ্চলের ছেলে মেয়েদের মাঝে জ্ঞানের আলো বিতরণ করে চলেছে।
বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত (অগ্রহায়ন ১৯৩২ বাংলা) শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ এর ৪১ পৃষ্ঠায় শহীদ রায় সাহেব কামিনী কুমার ঘোষ এ নামটি তাঁর প্রিয় গ্রাম কাঞ্চনা, থানা সাতকানিয়া, জেলা চট্টগ্রাম, ঠিকানা নিয়ে ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে স্থান পেয়েছে।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা