নিজস্ব প্রতিবেদক
সাতকানিয়া উপজেলার কাঞ্চনা গ্রামে রাতের আধারে এক জামায়াতকর্মীর ওপর হামলা চালিয়েছে সন্ত্রাসী সাইফুল ও তার সহযোগীরা। গত বুধবার রাত ১১ টার দিকে কাঞ্চনা ইউনিয়নের হাজারী খীল গ্রামের আক্তার হোসেনের (৫৫) ওপর তারা এ হামলা চালায়। হামলায় গুরুতর আহত আক্তার হোসেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
আহত আক্তার হোসেন জানান, গত বুধবার রাত ১১ টার দিকে ‘মোটরসাইকেল নষ্ট হয়েছে, একটু ঠিক করাতে হবে’- এমন অনুরোধ করে এক লোক বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আমার নাম ধরে ডাকতে থাকে। একটা মানুষের উপকার করার ইচ্ছায় আমি ঘর থেকে বের হই। কিন্তু বাড়ি থেকে রাস্তায় আসতেই আগে থেকে ওঁৎপেতে থাকা ৮-১০ জন আমার ওপর হামলা করে। দা-চুরি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাতে থাকে। অস্ত্রের বাট দিয়ে পেটাতে থাকে। এক পর্যায়ে আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তারা চলে যায়।
আক্তার হোসেন অভিযোগ করেন, যারা গত ১৫ বছর ধরে এই অঞ্চলে ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছে, তারাই আমার উপর হামলা চালিয়েছে। ৫ আগস্ট বিকালে সরকার পরিবর্তনের পর এলাকাবাসী মিছিল করলে আমিও মিছিলে যোগ দিই। এটাই ছিল আমার অপরাধ।
চরতি ইউনিয়নের মৃত নুর আহমদ ডাকাত প্রকাশ লেংগা নুর আহমদের ছেলে সাইফুল ইসলাম মেম্বার (৩৮), একই এলাকার মৃত জালাল আহমেদের ছেলে লেয়াকত আলী প্রকাশ লেকু ডাকাত (৫০), চরতির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত মো. আব্দুল্লাহর ছেলে মালেক খান (৪৫), ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত আব্দুল কাদেরের ছেলে ফারুক প্রকাশ ডাকাত ফারুক (৪৩), ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত নেছার আহমেদের ছেলে মো. সাইফুল, আমিলাইশ ইউনিয়নের মৃত নজিরা ডাকাতের ছেলে জিয়াউর রহমান, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত মাহমুদুল হকের ছেলে মো. মিনহাজ, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত আব্দুল ছালামের ছেলে জমির উদ্দিন, কাঞ্চনা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের আমিন শরীফের ছেলে মো. মাহফুজুল হক, মো. কামাল উদ্দিন ও মোহাম্মদ আকি-ই এ হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেন আহত আক্তার হোসেন।
একই ভাবে কাঞ্চনার জামায়াতকর্মী ইকবাল হোসেন অভিযোগ করেন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সাতকানিয়ার কেরানিহাট মোড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিলে হামলার ঘটনায় গত বুধবার থানায় মামলা দায়ের হয়। এর পরপরই আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা এ চোরা-গুপ্তা হামলা চালায়। দÐবিধি ও বিস্ফোরক আইনে মামলা হলেও গত চার দিনেও সাতকানিয়ার সবচেয়ে ত্রাস সাইফুলসহ কোন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
এছাড়া থানা পুলিশের সাথে এসব চিহ্নিত সন্ত্রাসীর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। পুলিশকে ম্যানেজ করেই গত ১৫ বছর এলাকায় সব ধরনের অপকর্ম করেছে তারা। এখনও বড় অংকের টাকা দিয়ে পুলিশকে ম্যানেজ করে তারা এলাকায় অবস্থান করছে। অথচ এসব সন্ত্রাসীর প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে।
সবশেষ দায়ের হওয়া মামলায় সাইফুলসহ মোট ৮১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এছাড়া অজ্ঞাত পরিচয় আসামি করা হয়েছে ১০০ থেকে ১৫০ জনকে। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
সর্বশেষ গত কোরবানির ঈদের পরদিন সাবেক দক্ষিণ চরতির কবির আহমদ মেম্বারের বাড়িতে হামলা ও লুটপাট চালায় সাইফুল বাহিনী। ওই দিন মারধর করে নিজেদের অস্ত্র দিয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় পুলিশের হাতে তুলে আতিকুল ইসলাম নামের স্থানীয় এক সিএনজি চালককে। ওইদিন স্থানীয় মেম্বারের বাড়ি ছাড়াও বেশ কয়েকটি বাড়ি ভাঙচুর করে সাইফুল বাহিনী। সন্ত্রাসীদের হামলায় স্থানীয় অন্তত তিনজন গুলিবিদ্ধ ছাড়াও ২০ জন আহত হয়। সব জেনেও পুলিশ সন্ত্রাসীচক্রের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নেয়নি।
ঘটনার বিষয়ে স্থানীয় কবির মেম্বারের ছেলে মো. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘মারধর করে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানো সাইফুলের পুরনো অভ্যাস। স্থানীয়রা সাইফুল বাহিনীর কাছে অসহায়। মুখ খুলতে ভয় পায়। আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তার শাস্তি চাই।’
অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানোর পুরনো কৌশল : এলাকাবাসী অভিযোগ করেন, মারধর করে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানো সাইফুলের পুরনো কৌশল। সাতকানিয়া থানা পুলিশের সহযোগিতায় এর আগে এ ধরনের অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে।
এর আগে পারিবারিক দ্ব›েদ্বর জেরে মিজবাউল হক নামের দশম শ্রেণির এক ছাত্রকে মারধর করে পুলিশে সোপর্দ করেছিল সাইফুল। এছাড়া আশরাফ নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে একই কায়দায় পুলিশে সোপর্দের অভিযোগ রয়েছে সাইফুলের বিরুদ্ধে।
ভূক্তিভোগী মিজবাউল হকের বাবা মোজাহেরুল হক কাদেরী বলেন, ২০১৯ সালে আমার স্কুল পড়ুয়া ছেলেকে মারধর করে অস্ত্র দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে সাইফুল ও তার বাহিনী। বানোয়াট এই অস্ত্র মামলার তড়িঘড়ি করে চার্জশিট দেয় সেই সময়ের থানা পুলিশের এস আই ইয়াছিন আরাফাত। আমরা এসব ঘটনার পুনঃতদন্ত ও সাইফুল বাহিনীর ক্যাডারদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করছি।
থানা পুলিশের প্রশ্রয় : সাতকানিয়া থানা পুলিশের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াছিন আরাফাতের পর, ওসি প্রিটন সরকার, এডিশনাল এসপি (সাতকানিয়া সার্কেল) শিবলী নোমান ও এস আই নাঈম উদ্দিনকে ম্যানেজ করে এসব সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়েছে সাইফুল বাহিনী।
গত নির্বাচনকে ঘিরে বেশি বেপরোয়া সাইফুল বাহিনী : ভূক্তভোগীরা জানান, গত ৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরপরই দক্ষিণ চরতিতে নৌকা প্রার্থীর সমর্থকদের বাড়ি-ঘর-দোকানে হামলা ও লুটপাট চালায় সাইফুল বাহিনী। এ সময় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ইউপি সদস্য ইলিয়াছ শাহীনের ফার্মেসি এবং কৃষক লীগ নেতা ফারুকের বাড়ি ও ডেকোরেশনের দোকানে লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয়। এরপর চরতী ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে ঢুকে চেয়ারম্যান রুহুল্লাহ চৌধুরীকে মারধর করে সাইফুল বাহিনী।
দক্ষিণ চরতী এলাকার ডিশ ব্যবসায়ী নুর মোহাম্মদের বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাকে পরিবারসহ বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে সাইফুল বাহিনী। নির্বাচনের পর থেকে ঘরছাড়া নুর মোহাম্মদের পরিবার বাড়িতে ফিরেছে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর।
ডিশ ব্যবসায়ী নুর মোহাম্মদ বলেন, জানুয়ারির নির্বাচনের পরপরই আমার লাখ লাখ টাকার ডিশের তার কেটে নেয় সাইফুল বাহিনী। আমি বাঁধা দিলে পরে আমার বাড়ি-ঘরে হামলা চালায়। আমার স্ত্রীর-সন্তানদের ওপর নির্যাতন চালায়। এমনকি আমার ছেলের এসএসসি পরীক্ষার সময়ও পরিবার নিয়ে আমাকে বাহিরে থাকতে হয়েছে। ওই সময় আমি মামলা করতে চাইলে- এস আই নাঈম উদ্দিন আমাকে মামলা করতে নিষেধ করেন, এমনকি আমার বিরুদ্ধে উল্টা তিনটা মামলা দায়ের হবে বলে হুমকি দেন।
এছাড়া নির্বাচনে চরতী ইউনিয়ন ছাত্রলীগ সভাপতি মাইনুদ্দিনকে মারধর করে অপহরণ ছাড়াও দক্ষিণ চরতির আরাফাত সিকদারকে মারধর করে এই সাইফুল বাহিনী।
জাতীয় নির্বাচনের আগে ২১ ডিসেম্বর রাতে দক্ষিণ চরতি কাটাখালী ব্রিজের পাশে নৌকাপ্রার্থী আবু রেজা নদভীর স্ত্রী রিজিয়া রেজা চৌধুরীর পথসভায় অস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালায় সাইফুল ও তার বাহিনী। এ ঘটনায় এমপির শ্যালক ও চরতি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রুহুল্লাহ চৌধুরীসহ অন্তত ২৫ জন আহত হন। এর দুই দিন আগে ১৯ ডিসেম্বরও দক্ষিণ চরতির সাবেক ইউপি সদস্য ইলিয়াছ শাহীনকে মারধর করে সাইফুল বাহিনী। এর আগে, ২০১৮ সালে সন্ত্রাসী সাইফুল বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ভিটে-মাটি ছেড়ে যায় দক্ষিণ চরতির ১০ পরিবার। নারী ও শিশুসহ এসব পরিবারের অর্ধশতাধিক লোক দীর্ঘ এক বছর নিজেদের ভিটে-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর উদ্বাস্তুর মতো দিনযাপন করছেন। বাড়ি-ভিটে ফিরে পেতে ২০১৯ সালের ২৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনও করেন উদ্বাস্তু পরিবারসহ এলাকার বিক্ষুব্ধ লোকজন।