ইকবাল ফারুক, চকরিয়া
কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে অবকাঠামোগত উন্নয়নকাজে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সাড়ে ৩ কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ছয়টি অবকাঠামোগত উন্নয়নকাজে এ জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের চট্টগ্রামস্থ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বিভাগীয় বন কর্মকর্তার (ডিএফও) কার্যালয়ে টেন্ডার কমিটির কাছে থাকা সরকারি গোপন মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দরপত্রের মূল্যায়ন দাম মিলিয়ে টেন্ডারে অংশ নিয়ে ৬টি উন্নয়নকাজ ভাগিয়ে নিয়েছেন ছয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। চলতি মাসের ৫ মে এ টেন্ডার সম্পন্ন হয়। তবে টেন্ডারে অংশ নেয়া বেশ কয়েকজন ঠিকাদার টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগ তুলেছেন। তাদের দাবি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যাপক অনিয়ম ও জালিয়াতির কারণে সচ্ছভাবে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েও সাফারি পার্কের উন্নয়নকাজ বঞ্চিত হয়েছে অপরাপর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মাঝে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তারা টেন্ডার প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির বিষয়টি তদন্তপূর্বক এসব উন্নয়ন কাজের টেন্ডার বাতিল করে পুনরায় দরপত্র আহবানের দাবি জানিয়েছেন।অভিযোগ উঠেছে, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের চট্টগ্রামস্থ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ তার কার্যালয়ের অধীনস্থ কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার মাধ্যমে মোটা অঙ্কের লেনদেনের মাধ্যমে সরকারি গোপন টেন্ডার মূল্য তার পছন্দের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের কাছে আগেভাগে ফাঁস করে দেয়ায় টেন্ডার প্রক্রিয়ায় এ জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। অভিযোগ উঠেছে, বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আর ডিএফও’র এ টেন্ডার জালিয়াতির কাজে সহায়তা করে তার কার্যালয়ের পুরোনো স্টাফ আরিফ আহমেদ এর নেতৃত্বে একটি চক্র।
তথ্যনুসন্ধানে জানা গেছে, গত মাসে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের অবকাঠামোগত উন্নয়নকাজের বিপরীতে টেন্ডার আহবান করেন চট্টগ্রাম বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের ডিএফও আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ। গত ৫ মে দুপুর ১২টায় দরপত্র জমাদান এবং খোলার শেষ তারিখের বিষয়টি দরপত্রে উল্লেখ করা হয়। ওইদিন ৬টি উন্নয়নকাজের বিপরীতে টেন্ডারের মাধ্যমে নির্বাচিত ছয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্যাকেজ নম্বর ২০২৪/২০২৫/ ডাবিøউ পি/০১ টেন্ডারের বিপরীতে বাউন্ডারি ওয়াল গেট নির্মাণ কাজটি ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮০ টাকায় পেয়েছেন ভাগ্যবান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মাছুম বিল্ডার্স। অথচ দরপত্রে ওই কাজের সরকারি মূল্য ছিল ৩৯ লাখ ৬৪ হাজার ২০০ টাকা। টেন্ডার কমিটির চেয়ারম্যান তথা প্রতিষ্ঠানটির প্রধানের (বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের ডিএফও) উপর অর্পিত ক্ষমতাবলে ওই কাজের মোট টেন্ডার মূল্য থেকে ১০ পার্সেন্ট মূল্য বাদ (লেজ) দিয়ে কাজের প্রকৃত মূল্য দাঁড়ায় ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮০ টাকা। সরকারি গোপন মূল্যের সঙ্গে সংগতি রেখে উল্লেখিত ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮০ টাকার বিপরীতে যিনি দরপত্রটি দাখিল করবেন কাকতালীয়ভাবে তিনিই কাজটি পেয়ে যাবেন। ঠিক তাই হয়েছে সাফারি পার্কের এসব উন্নয়ন কাজের টেন্ডার কার্যক্রমের ক্ষেত্রে। অথচ ওই কাজটি পেতে টেন্ডারে অংশ নিয়েছিল সর্বমোট ১০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তাদের মধ্যে মুজাহিদ ফাউন্ডেশন ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৭৯ টাকা ৪২১ পয়সা, মেসার্স মাছুম বিল্ডার্স ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮০ টাকা, মেসার্স নজরুল কনস্ট্রাকশন ৩৬ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮০ টাকা ৯০০ পয়সা, মেসার্স রহিমা এন্টারপ্রাইজ ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮১ টাকা ৯০০ পয়সা, মেসার্স বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮৫ টাকা ৫৫০ পয়সা, মেসার্স রুপকার ৩৫ লাখ ৯৫ হাজার ১০৪ টাকা ৫৩৪ পয়সা, মেসার্স জিয়া এন্টারপ্রাাইজ ৩৫ লাখ ৯৬ হাজার ৭৫৭ টাকা ৬৭০ পয়সা, মেসার্স আরএন এন্টারপ্রাইজ ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার ৫৭ টাকা ৮৭০ পয়সা, মেসার্স আবুল হাশেম ভূইয়া ৩৬ লাখ ১৪ হাজার ৯৯৯ টাকা ৪৫৩ পয়সা এবং দি এডি কনস্ট্রাকশন ৩৯ লাখ ৭৪ হাজার ৫০০ টাকা কাজটি পেতে দরপত্রে উল্লিখিত টেন্ডার মূল্য দিয়ে কাগজপত্র দাখিল করেন। সেখানে সরকারি গোপন মূল্যের সঙ্গে দরপত্র মূল্য ঠিক করে টেন্ডারে অংশ নিয়ে ভাগ্যবান ঠিকাদার হিসেবে মেসার্স মাছুম বিল্ডার্স ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮০ টাকার বিপরীতে কাজটি পেয়ে যান। এছাড়া জালিয়াতির মাধ্যমে ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের অবকাঠামোগত উন্নয়নকাজের টেন্ডার ভাগাভাগিতে সুযোগ পেয়েছেন মেসার্স করিম এন্ড ব্রাদার্স। সরকারি গোপন মূল্য মিলিয়ে ১ কোটি ৬৬ লাখ ৩১ হাজার ০০১ টাকার বিপরীতে কিপার গ্যালারি নির্মাণ কাজ পেয়ে এই যায় ওই প্রতিষ্ঠানটি। একইভাবে ৩৫ লাখ ৮৭ হাজার ৭৬৯ টাকার বিপরীতে এক্সচেঞ্জ রোড নেটওয়ার্ক ভেতরে বাইরে গেট নির্মাণ কাজ পেয়েছেন মেসার্স এডি কনস্ট্রাকশন। ২২ লাখ ৩৫ হাজার ৩১৬ টাকা ৫০ পয়সার বিপরীতে বন্যপ্রাণীর খাদ্য সরবরাহের ঘর তৈরির কাজ পেয়েছেন মেসার্স রহিমা এন্টারপ্রাইজ। ৩৯ লাখ ৯৪ হাজার ২২৩ টাকা ৪০ পয়সার বিপরীতে প্রাণীর ঘর নির্মাণ কাজ পেয়েছেন ফ্রেন্ডস ইঞ্জিনিয়ারিং। ৪৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫১৮ টাকা ৫০ পয়সার বিপরীতে আবর্জনা ফেলার স্থান (ডাম্পিং স্টেশন) নির্মাণ কাজ পেয়েছেন মুজাহিদ ফাউন্ডেশন। বর্তমানে সাফারি পার্কের উন্নয়ন কাজ ভাগিয়ে নেয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্টরা প্রতিদিন চট্টগ্রামস্থ বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়ে কাজের ওয়ার্কঅর্ডার পেতে ব্যাপক তোড়জোড় চালাচ্ছেন। ডিএফও কার্যালয়ের পুরানো স্টাফ হিসেবে পরিচিত আরিফ আহমেদের অর্থপূর্ণ উদারতায় ডিএফও আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজের কাছ থেকে ওয়ার্ক অর্ডার নিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন বলে জানিয়েছেন টেন্ডার প্রক্রিয়ায় প্রতারণার শিকার হওয়া একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন।
ডুলাহাজার সাফারি পার্কের টেন্ডার জালিয়াতির অভিযোগের বিষয়ে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) এবং ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের প্রকল্প পরিচালক আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ বলেন, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় জাল জালিয়াতির বিষয়টি সঠিক নয়। ইজিপি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এ টেন্ডার প্রক্রিয়ার কাজ সম্পন্ন হয়। সুতরাং এখানে প্রতিটি কাজের বিপরীতে সর্বনি¤œ দরপত্র মূল্য কত তা জানা সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষ ছাড়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তবে তিনি এটাও বলেন মোবাইল ইন্টারনেটের যুগে অনেক সময় হ্যাক করে বেশকিছু গোপন তথ্য বের করে নেয়া হয়। তিনি আরও বলেন, আমি শতভাগ নিশ্চিত ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের টেন্ডার কাজে কোন অনিয়ম দুর্নীতি হয়নি। যেসব ঠিকাদার কাজ পায়নি তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নানা প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছেন বলেও মন্তব্য করেন বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের চট্টগ্রামের বিভাগীয় এ কর্মকর্তা।