একদিকে সাগরে মাছ না পাওয়ার বেদনা অন্যদিকে জলদস্যুদের তান্ডব। আর পারছেন না জেলেরা। সম্প্রতি উপকূলে মাছ ধরতে গিয়ে জেলে অপহৃত হয়েছে। তাদের মধ্যে মুক্তিপণ দিয়ে কেউ ফিরে এসেছে। অনেকেই মুক্তিপণ দিতে পারছেন না, মুক্তিও মিলছে না। দস্যু বাহিনীগুলোকে যেসব ট্রলার চাঁদা দিচ্ছে না, সে সব ট্রলার ইলিশ আহরণ করতে নানা বিড়ম্বনায় পড়ছে। দস্যুরা ওইসব ট্রলারে হামলা করছে, জেলেদের ধরে নিয়ে গহীন অরণ্যে আটকে রাখছে। এরপর মুক্তিপণ দাবি করা হচ্ছে। তাদের অভিযোগ, উপক‚লে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সার্বক্ষণিক তদারকির অভাব। আর এতে লাখ লাখ জেলে বছরের পর বছর দস্যু বাহিনীগুলোর হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। গেলো ৩ সপ্তাহ সাগরে তেমন মাছ না পাওয়ায় লোকসানের কারণে সাগরে যায়নি অধিকাংশ ফিশিং ট্রলার। কিন্তু আবারো সাগরে ট্রলার নিয়ে গিয়ে জাল ফেলতেই জেলেদের জালে ধরা পড়ছে সামুদ্রিক মাছ। এতে দারুণ খুশি জেলেরা। কিন্তু সাগরে জলদস্যুর উৎপাত বাড়ায় জেলেদের উদ্বেগও বেড়েছে। তাই জলদস্যু দমনে প্রশাসনের প্রতি আরো জোরালো তৎপরতা চালানো দাবি জেলে ও ট্রলার মালিকদের। গত (৭ নভেম্বর) বৃহস্পতিবার বঙ্গোপসাগরের সোনাদিয়া চ্যানেলে গুলি কওে এক মাঝিকে হত্যা করে অস্ত্রের মুখে ১৯ মাঝিমল্লাসহ একটি ফিশিং ট্রলার নিয়ে গেছে জলদস্যুরা।
এফবি আল্লাহর দান নামক ফিশিং ট্রলারটির মালিক বাঁশখালীর শেখেরখিল ইউনিয়নের ইসমাঈল কোম্পানি। দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত খবরে উল্লেখ করা হয়, গত সোমবার মোকারম মাঝিসহ এফবি আল্লাহর দান ফিশিংট্রলারটি গভীর সাগরে মাছ ধরতে যায়। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ভোর ৪টায় ট্রালারটি উপক‚লে ফেরত আসতে মহেশখালী কুতুবদিয়ার সোনাদিয়া চ্যানেলে জলদস্যুদের কবলে পড়ে। এসময় তারা গুলি করে মোকরম মাঝিকে হত্যা করেন এরপর ১৯জন মাঝি ও জেলেসহ ট্রলারটি অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে মোকরম মাঝির লাশ উদ্ধার কওে বাঁশখালী সদর হাঁসপাতালে আনা হয়। সেখানে কর্তৃপক্ষ মৃত ঘোষণা করে ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিক্যাল হাসপাতালে প্রেরণ করেন। নিহত ও অপহ্নত জেলেদেও স্বজনরা সাংবাদিকদের জানান, সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুদের উপদ্রব উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। জলদস্যুদের কারণে মাছ ধরতে যাওয়া বড়রকমের জীবনের ঝুকি নিতে হচ্ছে। এতে একদিকে মাছের আহরণ কমে আসছে, অপরদিকে জেলেদের জীবন দুর্বীসহ হয়ে পড়েছে। এছাড়া সামদ্রিক মাছের দাম বাড়ার কারণই হচ্ছে, জলদস্যুদের অপতৎপরতা। বিগত সরকার বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুদের তৎপরতা রুখতে বেশকিছু কৌশলগত পদক্ষেপ নিয়েছিল, এরমধ্যে ছিল জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ ও অস্ত্র জমা দেয়ার বদৌলতে পুনর্বাসনের উদ্যোগ। দৃশ্যত দুই দুটি প্রোগ্রাম করে আত্মসমর্পণ ও অস্ত্র জমা নেয়া বিষয়টি আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি। কিন্তু তাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া হলো কিনা তা আমাদের জানা নেই। আমরা মনে করি, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী জলদস্যুদের দমনের তৎপরতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি দস্যুবৃত্তে অনুৎসাহিত করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা জরুরি। নচেৎ সাগরে নিরাপদ মাছ ধরার পরিবেশ সংরক্ষণ করা দায় হয়ে পড়বে। গত বৃহস্পতিবারের আগেও বঙ্গোপসাগরের রেজুখাল পয়েন্টে ট্রলার নিয়ে মাছ শিকারকালে জলদস্যুরা হানা দেয়। পরে জলদস্যুরা জিম্মি করে ট্রলারটি নিয়ে যায়। এর আগে মুহুরাকাটার ফিশিং ট্রলারেও দস্যুরা হানা দেয়। মালিক নুরুল আবছার জানিয়েছেন, এ ঘটনার পর তিন সপ্তাহ সাগরে যায়নি ট্রলার। এর আগে একই স্থানে আরো ২টি ট্রলার লুট করেছে জলদস্যুরা। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না পেলে ঝুঁকি নিতে চাইবে না কোন ট্রলার মালিক। গত ৩ সপ্তাহে কক্সবাজারের আরো ১২টি মাছ ধরার ট্রলারে লুটপাট, জেলেদেরকে মারধর ও জাল ছিনিয়ে নিয়েছে দস্যুরা।কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছড়ার আবদু শুক্কুর মাঝি জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন অলস সময় কাটানোর পর এখন আবারো ট্রলার নিয়ে সাগরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে জলদস্যুদের তৎপরতা বাড়ায় শ্রমিক পেতে সমস্যা হচ্ছে। উচ্চ মূল্য দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছেনা। সবাই নিরাপত্তা চায়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করলে অনেক ট্রলার সাগরে যেতে পারবে না। সোনাদিয়া, কুতুবদিয়া ও রেজুখালের মোহনায় জলদস্যুর তৎপরতা বেড়েছে। মাছ নিয়ে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার আড়তে আসতে বাধা হয়ে দাড়িয়েছে জলদস্যুরা। একটু সতর্ক না থাকলে লাখ লাখ টাকার জাল কেটে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় ইঞ্জিনের মূল্যবান পার্টস খুলে নিয়ে যায়। ট্রলার অচল করে সাগরে বাসিয়ে দেয়। যার ফলে মাঝি-মাল্লারা চরম নিরাপত্তাহীতায় থাকে। সকলের পরিবার থাকে প্রতিনিয়ত উদ্বিগ্ন। কক্সবাজারের পুলিশ প্রশাসন থেকে বলা হয়েছে, জলদস্যুদের ব্যাপারে উপকূলীয় সব থানাকে সতর্ক থাকতে নির্দেশনা দেওয়া আছে। থানায় অভিযোগ করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমরা মনে করি, অভিযোগের অপেক্ষায় না থেকে সমুদ্র সীমান্তে নৌ পুলিশ ও উপজেলার পুলিশ প্রশাসনকে টহল জোরদারসহ দস্যুদের দমনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।