মাহমুদুল হক আনসারী
বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম গ্রহণ করেছে। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা ভাংচুর ও ধ্বংস করার মতো কোনো আদর্শকে লালন করে না। বাংলাদেশ বর্তমানে একটি ক্রান্তিকাল সময় পার করছে। বৈষম্য বিরোধি ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। এই সরকার তার শাসন আমলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও মানবাধিকার নিয়ে জনগণের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে চাপে ছিলো। সরকারের একদলীয় শাসন ব্যব্স্থা জনগণের মতামতের বিরুদ্ধে চলছিল। আওয়ামীলীগ সরকারের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনিকে জনগনের বিপক্ষে মুখোমুখি ভাবে দ্বার করা মোটেও জনগণ সয্য করতে পারেনি। এরমধ্যে জনগনের ব্যয় ক্ষমতা বৃদ্ধি, শিক্ষিত বেকারত্ব, কর্মসংস্থান, বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র জনতা বিগত জুলাই মাস থেকে ফুঁসে উঠে। ফলে পাঁচ আগস্ট সোমবার হাসিনা সরকারকে বিদায় নিতে হয়েছে। বর্তমানে সংসদ বিলুপ্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের ও সেনা বাহিনীর তথ্যবদানে একটি এগারো সদস্য বিশিষ্ট অন্তর্বর্তীকালিন সরকার গঠিত হয়েছে।
বর্তমানে ছয় আগস্ট পর্যন্ত দেশের নানা স্থানে গুপ্ত হামলা ভাংচুর এবং বিভিন্ন জায়গায় বাড়িঘরসহ সরকারি বেসরকারি সম্পত্তিতে দুষ্কৃতিকারিরা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। ফলে ব্যাপক ভাবে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ। বর্তমান ক্রান্তিকালে এই ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিরোধি মতের উপর হামলা কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই ধরনের মানসিকতা থেকে সকল পক্ষকে বিরত থাকতে হবে। সকলের জান মাল নাগরিক অধিকার রক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা থাকতে হবে।
সম্প্রীতি, আন্তরিকতা, সহমর্মিতার বাংলাদেশ। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সব ধর্ম গোত্রের মানুষের সমান অধিকার নিয়ে বসবাসের দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মাটি, আকাশ-বাতাস, আলো সূর্য সব ধর্মের মানুষের জন্য সব সমান। ধর্মের বাণীর ভেদাভেদ কোন ধরনের সংকীর্ণতা এখানে পাওয়া যায়না। ধর্ম যার যার দেশ সবার। যার যার ধর্ম তিনি পালন করবেন, কোনো শংকা ও ভয়হীনভাবে। সেটির নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জন্ম সব ধর্ম গোত্র বর্ণের মানুষের জন্য। স্বাধীনতার পর আজকের দিন পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক, চিন্তাচেতনা সেভাবেই বলে আসছে। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র সবকিছু এ জন্যই বাস্তবায়ন হয়েছে। সব ক্ষেত্রে সব জায়গায় সব মানুষের রাজনৈতিক, ধর্মীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এদেশের স্বাধীনতার উদ্দেশ্য।
কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা হবে, মন্দির, গীর্জা আক্রান্ত হবে সেটি এ জাতি মানতে পারেনা। আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট হবে সেটি কোনো সুপ্ত নাগরিক মেনে নিতে পারেনা। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এমন ধরনের চরিত্র শোভা পায়না। তবে কখনো কখনো একটি কুচক্রি মহল ধর্মের নামে অধার্মিক কিছু ঘটনা ঘটিয়ে বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতি ্ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চায়। দেশ বিদেশে সেই চিত্র প্রচার করে স্বাধিন বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চায়। তাদেরকে কোনো ভাবে সুযোগ দেয়া যাবে না। যার যার অবস্থান থেকে তাদেরকে প্রতিরোধ করতে হবে। দেশে বর্তমানে অস্থির পরিবেশ বিরাজ করছে। এই সময়ে একটি অশুভ শক্তি গভীর ষড়যন্ত্র করছে আরো সামাজিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার জন্য। বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধিরে ধিরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনবেন বলে জনগনের বিশ্বাস। এ মুহূর্তে সম্প্রীতি বিরোধী ষড়যন্ত্র মোটেও কাম্য নয়।
আমাদের দেশে রাজনীতির সাথে ধর্মের একটি যোগসূত্র আছে। আমাদের ধর্মীয় সংস্কৃতির সাথে রাজনীতি জড়িয়ে পড়েছে। রাজনীতির জন্য ধর্মকে অধার্মিক কর্তৃক ব্যবহার হয়। প্রকৃত ধার্মিক যারা তারা, ধর্মকে সম্মান করে। ধর্মের ব্যবহার ঠিকস্থানে পালন করে। রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করেনা। প্রকৃত ইসলামের অনুসারীরা ধর্মকে রাজনীতির মাটে ব্যবহার করেনা। বাস্তব-ধার্মিক আর অশুভভাবে ধর্মের ব্যবহারকারী কারা সেটা আমাদের সমাজকে বুঝতে হবে। ধর্মের অনুশীলন, আচার অনুষ্ঠান থাকবে। আদর্শ পালন প্রচার বণ্টন থাকবে। যার যার ধর্ম সে তার নিয়ম নীতির মাধ্যমে পালন করবে। সেখানে স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশে কোনো ধরনের বাধা প্রতিবন্ধকতা থাকবেনা। ইসলাম ধর্মের অনুসারী ইসলাম ধর্ম প্রচার করবেন সুন্দর ও সাবলীল ভাষা দিয়ে। ইসলামের বাণীর উদ্ধৃতি দিয়ে মানব সমাজে ইসলামের বাণী প্রচার করবেন, কোনো বাধা নেই। অনুরূপভাবে হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান সম্প্রদায় আরো যারা আছে সকলেই তাদের ধর্ম, সংস্কৃতি স্বাধীনভাবে পালন করবেন। সেটায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র আর মানবাধিকার। বাংলাদেশের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিশ্বের অনেক দেশের জন্য অনুসরণীয় মডেল। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে শান্তি, শৃংখলা, সৌহার্দ্য, এক নজীরবিহীন ঘটনা। এখানে সব ধর্মের অনুষ্ঠানে মুসলীম অনুসারী মানুষ পর্যবেক্ষণ করে। সাহায্য সহযোগিতা করে। বড় বড় পুজা অনুষ্ঠানে অনেক মুসলীম ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে দেখা গেছে। বাংলাদেশে কোনো ধর্মের মানুষ অনিরাপদ নয়। সেই সংস্কৃতি এদেশে বিদ্যমান। দুনিয়ার বহুদেশে অন্য ধর্মের মানুষের নিকট মুসলিম অনুসারীগণ নির্যাচিত নিপীড়িত হলেও বাংলাদেশের মুসলমান তার বিপরীত।
এদেশে ধর্মীয় মন্দির প্রতিমায় হামলা ভাংচুর, কিছু দুষ্ট চক্র মানুষের কাজ ছাড়া কিছুই নয়। দেশের আইনশৃংখলা বাহিনী সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখে, অমুসলীম সম্প্রদায়ের মানুষ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উপর। সকল বড় বড় রাজনৈতিক দল, মুসলীম সম্প্রদায়ের নেতা তাদের বক্তব্য ও বয়ানে ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা বলেই থাকে। লেখালেখির মাধ্যমে সমাজ ও ধর্মীয় গবেষকগণ ধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য নিয়মিত লেখার মাধ্যমে সমাজকে সুশৃংখল রাখার জন্য অবদান রাখছেন। গোড়ামীর বিরুদ্ধে যেমনী বক্তব্য থাকে বক্তাদের, তেমনীভাবে ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা বক্তব্য আলোচনা চলেই আসছে। আমি মোটেও কোনো ধর্মীয় বক্তাদেরকে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার জন্য দায়ী করবনা। কোনো আলেম, মহাদ্দিস, মুফতীকে দায়ী করবনা। কোনো ইমাম, খতীবকে দায়ী করবনা। কোনা ধরনের ধর্মীয় ইসলামিক প্রচারক অন্য ধর্মের উপর হামলা আঘাত করার কথা বলেছেন বলে আমার জানা নেই। তাই বলব, এ ধরনের হামলার সাথে গভীরভাবে ষড়যন্ত্র জড়িত, অপ-রাজনীতি জড়িত, অধর্ম জড়িত। মানবতাবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরাই এমন ধরনের জঘন্য ধর্মীয় সংঘাত তৈরি করতে পারে। দেশের আমজনতা, সাধারণ মানুষ খুবই শান্ত। ধর্মীয় হানাহানি মোটেও সহ্য করেনা। তারা চায় ধর্মের অনুশীলন, ধর্মপালন ও ধর্ম সংরক্ষণ।
দেশকে অস্থীর, ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য যারা তৎপর তাদের বিরুদ্ধে দেশ জাতিকে সতর্ক থাকতে হবে। আমার দেশের মানচিত্র সকলের জন্য সমান। সকলেই এখানে কাধে কাধ মিলিয়ে মিলেমিশে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গঠনে এগিয়ে থাকবে। দেশের উন্নয়ন সকলের অবদান সমান। উন্নয়ন অগ্রগতি, সবকিছুতেই সমানভাবে অবদান রাখছে সামর্থ্যমত সকলেই। দেশ আমাদের সকলের দেশের মাটি, মানুষকে স্বাধীনভাবে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তকে এ জাতি আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিবেনা। দেশের সব অঞ্চলে সমস্ত এলাকার শান্তিকামী জনগণকে ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতার কল্যাণে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। অশুভ শক্তিকে সমাজ নষ্ট করতে দেয়া যাবেনা। ধর্মের প্রকৃত মূল্যবোধ আর স্বাধীনতার চেতনায় জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ধর্মবিরোধী, স্বাধীনতা সার্বভৌম বিরোধী যেকেনো ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ জাতি চাই। যার যার ধর্ম তার আদর্শ। ধর্মীয় শক্তি ঈমানি শক্তি। অন্যায়ভাবে কোনো ষড়যন্ত্রের কাছে মাথানত করতে পরিনা। আজকের সময়ে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে জাতীয ঐক্য ্ও ধর্মীয় শৃঙ্খলার মাধ্যমে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শান্তি, শৃংখলা, ধর্মীয় সম্প্রীতি, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সকলকেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে।
লেখক : সংগঠক, গবেষক, কলামিস্ট