সর্ষের মধ্যে ভূত; সড়কের শৃঙ্খলা আদৌ ফিরবে কি ?

1

সালাহউদ্দিন শাহরিয়ার চৌধুরী

বাংলাদেশে সড়ক যানজট নিত্যদিনের ঘটনা। এই যানজটের ফলে নির্গত ধোয়ায় হচ্ছে পরিবেশ দূষণ যার কারণে বাংলাদেশ হয়তো পরিবেশ দূষনে পৃথিবীর শীর্ষে অবস্থান করছে, যা অবশ্যই আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য এবং আতংকের বিষয়। প্রতিনিয়ত সড়কে বিশৃঙ্খলার কারনে ঘটছে দুর্ঘটনা, অব্যাহত আছে যানজট কিন্তু এর থেকে আমরা পরিত্রানের জন্য যারা স্টেক হোল্ডার হিসেবে আছি তা নিরসনকল্পে আমরা কতটুকু আন্তরিক বা সেই বিষয়ে কতটুকু সচেতন বা সৎ, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে কখনো ভূত তাড়ানো যাবে না। তেমনি এই সড়কে শৃঙ্খলা আনার দায়িত্বে যারা আছেন তাদের মধ্যে সে ভূত থাকলে আদৌ যানজট নির্মূল এবং দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়।
যানজট বা সড়ক বিশৃঙ্খলার অন্যতম কারন হচ্ছে সড়ক দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ, রাস্তা দখল করে হকারদের অবৈধ দোকান, অবৈধ বিভিন্ন গাড়ির স্ট্যান্ড, যত্রতত্র গাড়ির পার্কিং। প্রত্যেক গাড়ির ফিটনেস, রেজিষ্ট্রেশান, রুট পারমিটের, ড্রাইভিং লাইসেন্স হাল নাগাদ করার জন্য বি.আর.টি.এ যাওয়া বাধ্যতামূলক কিন্তু সরেজমিনে আপনি যদি কখনো বি.আর.টি. এ কার্যালয়ে যান দেখবেন যে গাড়িগুলো সড়কের শৃংখলা রক্ষায় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে বা আপনি রাস্তায় যে গাড়িগুলোকে ফিটনেসবিহীন মনে করেছেন সে রকম কোন গাড়ির সেখানে উপস্থিতি নেই। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় তাহলে সে গাড়িগুলো কি করে রাস্তায় চলাচল করছে, নিশ্চয় কোন অসদুপায় অবলম্বন করে সেই গাড়িগুলো ফিটনেস পাচ্ছে বা চলাচল করছে এবং তার দায় সরাসরি বি.আর.টি.এ এবং ট্রাফিক বিভাগের উপর বর্তায়।
যানজট শুধুমাত্র গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে নয়, বরং নাগরিক অসচেতনতা, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, অপরিকল্পিত সড়ক ব্যবস্থাপনা, রাস্তার ওপর গাড়ি পার্কিং এবং উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে সংকুচিত সড়কই যানজটের মূল কারণ। ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করা চালকদের এক অংশের চিরাচরিত অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।আইন বা নিয়ম মানা নিয়ে এখনও অনীহা অনেক গাড়ি চালকের।দায়িত্বরত ট্রাফিক সদস্য ও সার্জেন্টরা যানজট নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করলেও চালকদের মধ্যে পুলিশের নির্দেশনা মানার প্রতি তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। মূল সড়কে চলাচল করতে দেখা যায় অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা। সিগন্যাল দেওয়ার পরও অনেক চালক চালিয়ে যেতে দেখা যায়। এতকিছুর পরও অবৈধ যানবাহন ও আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকাও নেই ট্রাফিক বিভাগের, জরিমানা দিয়ে আবার চলছে সড়কে। গত এক দশকে যানবাহনের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে, কিন্তু বাড়েনি ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা। চট্টগ্রাম নগরের প্রায় প্রতিটি সড়কে বিশৃঙ্খলা, যত্রতত্র পার্কিং, অবৈধ ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল ও যাত্রী ওঠানামাসহ বিভিন্ন কারণে সৃষ্ট যানজটে অতিষ্ঠ নগরবাসী।তবে সড়কে শৃঙ্খলা দায়িত্বে থাকা পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ সংস্থার (বিআরটিএ) পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে দুটি সংস্থাই পৃথকভাবে আগের চেয়ে অনেক বেশি অভিযান পরিচালনা করছে। সচেতনতা বাড়াতেও পালন করা হচ্ছে নানা কার্যক্রম। যানজটের নিরসন ঘটিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে ট্রাফিক বিভাগ। এরই ধারাবাহিকতায় যারা সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে এবং সড়ক আইন অমান্য করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ।পুলিশ জানায়, নগরের সড়কগুলোতে অসংখ্য অবৈধ গাড়ি চলাচল করে। পাশাপাশি যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, উল্টো পথে গাড়ি চালানো, শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার কারণে সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। এছাড়া ফিটনেস না থাকা এবং রুট পারমিট না থাকাসহ সড়ক পরিবহন আইন অমান্য করলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। সেই অনুযায়ী আর্থিক জরিমানা ও গাড়ি আটক করা হয়। তবে অভিযান অব্যাহত থাকার পরও যানজট কমছে না। পর্যাপ্ত ডাম্পিং স্টেশন থাকলে এর সুফল পাওয়া যেত।বিআরটিএর অনুমোদিত গাড়ির পাশাপাশি মহানগরীর সড়কসমূহে অবাধে চলছে অনুমোদনহীন মোটরসাইকেল, টেম্পো, সিএনজি টেক্সি, শত শত লাইসেন্সবিহীন রিকশাসহ অন্যান্য গাড়ি। অবৈধ এসব গাড়ি সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী ও পুলিশকে ম্যানেজ করে চালায় বলে অভিযোগ রয়েছে। চালকদের যদি জিজ্ঞেস করেন তোমরা কি করে ফিটনেসবিহীন গাড়ি আপনারা রাস্তায় কিভাবে নামিয়েছেন, তখন তারা বলবে মাসিক টোকেন নিয়ে চালাচ্ছি, মাঝে মধ্যে মামলা হলেও পরে আমরা সেটি ম্যানেজ করে নেই। অন্যদিকে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের খোঁড়াখুঁড়ি এবং নগরীর বিভিন্ন সড়ক দখল করে ইটবালি, নির্মাণসামগ্রী রাখায় সৃষ্টি হয় যানজটের।
ট্রাফিক বিভাগ বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিকট যদি জিজ্ঞেস করেন- কেন সড়কে এই বিশৃংখলা, তারা বলবে আমরা চেষ্টা করছি কিন্তু জনবলের অভাবের কারনে আমরা সফল হতে পারছি না। মানলাম চেষ্টা করছেন কিন্তু অবৈধ আয় গ্রহন যদি বন্ধ করা না হয়, আইনের সঠিক প্রয়োগ যদি না হয় তাহলে সব সময় শুধুই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে সমাধান আসবে না। ফিটনেস বিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের দায়িত্ব ট্রাফিক বিভাগের কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে টোকেন বাণিজ্য ও প্রত্যেকটি জনবহুল মোড়ে যত্রতত্র গাড়ির পার্কিং স্ট্যান্ড তৈরীর মাধ্যমে অবৈধ আয়ের সবচেয়ে বড় অভিযোগ, যেগুলো যানজট সৃষ্টির মূল কারণ। দূর দূরান্তের গাড়ির জন্য নির্ধারিত বাস টার্মিনাল থাকলেও সে সব জায়গার পরিবর্তে বড় কোম্পানীগুলো বিভিন্ন জায়গায় তৈরী করেছে অবৈধ কাউন্টার যার ফলে সমগ্র শহরকেই মনে হয় বাস টার্মিনাল। চট্টগ্রামের কদমতলী, অলংকার, দামপাড়া, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট সহ বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে দূর পাল্লার বাসের কাউন্টার যা পুরোটাই অবৈধ আর পুরো শহর জুড়েই তো রয়েছে অবৈধ টেম্পো ষ্ট্যান্ড। তার জন্য প্রথমেই সবার মধ্যে অবৈধ আয়ের যে ভূত রয়েছে সেটিকে ধ্বংস করতে হবে অর্থাৎ অবৈধ আয়ের পথ রুদ্ধ করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আইনের মধ্যে আনতে হবে। অন্যথায় সড়ক শৃঙ্খলা কোনভাবে সম্ভব নয়।
পরিশেষে একটি বিষয় নিয়ে বলতে হয় – কোন মন্ত্রী, আমলা, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যে সড়ক দিয়ে যান সেদিন সেই সড়কে এত সুন্দর নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে গাড়ি চলাচল করে যা আপনার স্বপ্নের সেই সুন্দর সড়ক,কোথাও নেই কোন যানজট, নেই কোন বিশৃঙ্খলা কিন্তু পরদিন আবার তথৈবচ। সুতরাং যদি মন্ত্রী মহোদয় বা উর্ধ্বতন কর্মকর্তার আগমনে সড়কে শৃংখলা তৈরী করা যায় তাহলে অন্যান্য সময় নয় কেন? তাহলে বলতেই হয় এই সড়কে বিশৃঙ্খলা কারন হচ্ছে সর্ষের মধ্যে ভূত অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাসমূহ।

লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ