অপরাধের জন্য কোন ব্যক্তির সম্পত্তি ধ্বংস আইন সম্মত নয়। আইনি প্রক্রিয়ায় কোন অপরাধির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নেওয়া যায়, যদি আদালত এর পক্ষে রায় ঘোষণা করে। সাধারণ জনতা ইচ্ছা করলেই কারো সম্পত্তির উপর চড়াও হতে পারে না, এটা বেআইনি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট হলেও, তার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ থাকলেও, রাষ্ট্রীয় সম্পদ তসরুফ এবং টাকা পাচারের সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগ থাকলেও তা এখনো আদালতে প্রমাণিত হয়নি। আইনি প্রক্রিয়া চলমান অবস্থায় তার সম্পত্তি ধ্বংসের ঘটনা অনভিপ্রেত। এবিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা দেশের জনগণকে মেনে চলতে হবে। এবিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন সম্পত্তি ধ্বংস থেকে বিরত থাকুন। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের সম্পত্তি ধ্বংস এবং আওয়ামী লীগের লোকজনের ওপর হামলা থেকে সবাইকে বিরত থাকার আহŸান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টার ফেইসবুক পেইজে প্রকাশ করা এক বিবৃতিতে তিনি অবিলম্বে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে দেশবাসীকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল হওয়ার আহŸান জানান। বিবৃতিতে মুহাম্মদ ইউনূস শেখ হাসিনার পরিবারের সম্পত্তি ধ্বংস থেকে বিরত থাকা এবং ‘ফ্যাসিবাদী’ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি হওয়ায় কিংবা অন্য কোনো অজুহাতে দেশের কোনো নাগরিকের ওপর আক্রমণ না করার আহŸান জানিয়েছেন।
ভারতে অবস্থান করা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনলাইনে ভাষণ দেওয়াকে কেন্দ্র করে ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয় চালায়। আগুন দেওয়া হয় ধানমন্ডিতে শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদনেও। রাজধানীতে কাছাকাছি স্থানে বুধবার রাতের এ ঘটনার পরপরই দেশের অনেক স্থানে এবং বৃহস্পতিবার দিনের পর রাতেও হামলা ও ভাঙচুর করা হয় শেখ পরিবারের নামে থাকা বিভিন্ন ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও স্থাপনায়। দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের কার্যালয়সহ অনেক নেতার বাড়িতে করা হয়। এমন প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এসব হামলা থেকে বিরত থাকতে সবার প্রতি আহŸান জানান। এর আগে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় এক বিবৃতিতে দেশের কোনো প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় ভাঙচুর কিংবা অগ্নিসংযোগের ‘চেষ্টা কঠোরভাবে প্রতিহত’ করার প্রতিশ্রæতি দেয়। এরপর শুক্রবার বিকালে মুহাম্মদ ইউনূস বিবৃতিতে বলেন, ‘শেখ হাসিনা বছরের পর বছর জনগণের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়ন করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন। সংগত কারণেই এটি বোধগম্য যে, বিক্ষোভকারী ও তাদের আত্মীয়-স্বজনরা বছরের পর বছর ধরে শেখ হাসিনার নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, ফলে তাদের মনে ক্ষোভ রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা নয়া দিল্লিতে আশ্রয় নিয়েও তার দলীয় সন্ত্রাসীদের একত্রিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, দেশের পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে। বছরের পর বছর বাংলাদেশে নিপীড়নের শাসন কায়েম করা শেখ হাসিনা এখনও বাংলাদেশের পুনঃনির্মাণ ক্রমাগত বাধাগ্রস্ত করতে চাইছে। তা সত্তে¡ও সরকার দেশের সকল নাগরিককে আইন মেনে চলার আহŸান জানাচ্ছে। ‘এতে করে আমরা নিজেদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি জাতি হিসেবে বিশ্বের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব। ফ্যাসিবাদী শাসনের অধীনে পুরনো বাংলাদেশ থেকে আমরা যে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে একসঙ্গে কাজ করছি, আইন মেনে চলার মধ্য দিয়েই সেটি আলাদা হবে।’
ইউনূস বলেন, ‘আসুন আমরা বাংলাদেশিদের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার অনুভূতি ক্ষুণœ না করি; আইনের প্রতি যেকোনো অবজ্ঞা নাগরিকদের জীবন ও সম্পত্তির জন্য হুমকি।’ জুলাই-অগাস্ট আন্দোলনে অংশ নেওয়া সবাইকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজেদের এবং বিশ্বজুড়ে আমাদের বন্ধুদের কাছে প্রমাণ করা অপরিহার্য যে, আমরা একে অপরের নাগরিক ও মানবাধিকারকে সম্মান করব এবং আইন মেনে চলব। এই নীতির প্রতি আমাদের অঙ্গীকার অটল।’ রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে ভাঙচুরের পর শুক্রবার সকালে হাতুড়ি দিয়ে কংক্রিটের বিম ভেঙে অনেককে রড বের করতে দেখা যায়।
তিনি বলেন, ‘রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত নতুন বাংলাদেশের বিজয়ীদের নিশ্চয়ই এমন কিছু করা উচিত হবে না, যা দেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং স্বৈরাচারী হাসিনার আমলের সঙ্গে তুলনা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।’ শেখ হাসিনার সরকার পতনের ছয় মাস পূর্ণ হয় গত বুধবার। এদিন রাতে ভার্চুয়াল এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, যিনি ৫ অগাস্ট ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে ভারতের দিল্লিতে আছেন। এর আগেই বুধবার বিকালে আলোচিত ‘কন্টেন্ট ক্রিয়েটর’ ইলিয়াস হোসাইন ও পিনাকী ভট্টাচার্য ফেইসবুকে ‘ধানমন্ডি ৩২ অভিমুখে বুলডোজার মিছিল’ ঘোষণা করেন। সেই আহবানে বিপুল মানুষ ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। হামলা হয় সারা দেশে আওয়ামী লীগের কার্যালয়সহ অনেক নেতার বাড়িতে। এমন প্রেক্ষাপটে বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী এই গুরুতর পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং সকল বাংলাদেশির জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য সরকার দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে কাজ করছে।
‘সম্পত্তি ধ্বংস, ব্যক্তির ওপর আক্রমণ কিংবা কোনো ধরনের উসকানিমূলক কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অবিলম্বে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী যে কারও বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে।’ এ ধরনের কর্মকান্ডে দায়ী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে সরকার বিচারের আওতায় আনবে বলে হুঁশিয়ার করে দিয়ে তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী শাসনের নেতারা দেশকে সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে ফেলে গেছে। যতক্ষণ আমরা সতর্ক থাকব এবং নিজেদের নীতি-নৈতিকতা বজায় রাখব, ততক্ষণ তাদের ফিরে আসার আর কোনো সুযোগ নেই।’ তাদের সম্পত্তিতে যেকোনো আক্রমণকে তারা আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করার এবং তাদের বানোয়াট গল্প প্রচার করার সুযোগ হিসেবে নেবে। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিচার প্রক্রিয়াধীন থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘সমগ্র বিশ্ব আমাদের সঙ্গে আছে। এই মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলার যেকোনো অবনতি বিশ্বকে ভুল বার্তা দেবে।’ জনগণের উচিত সরকারের উপর আস্থারাখা। আইন হাতে তুলে না নিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বর্তমান সরকারকে সহায়তা করা সর্বস্তরের জনতার উচিত মনে করে বিশেষজ্ঞ মহল।