পূর্বদেশ ডেস্ক
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ওপরই নির্ভর করছে সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতা। তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে এ কথা বলেন তিনি।
গতকাল রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের শাপলা হলে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা। সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ডিসিদের মুক্ত আলোচনা হয়।
ডিসিদের সঙ্গে আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা জোর দেন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর। সেই সঙ্গে দেশের ৬৪ জেলাকে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করার আহŸান জানান তিনি। সঙ্গে জানান, পাসপোর্ট করতে এখন থেকে পুলিশের ভেরিফিকেশন লাগবে না।
দেশের বিভিন্ন খাত ডিজিটাইজ করা হলেও নাগরিকদের ভোগান্তি যে পুরোপুরি লাঘব হয়নি, সেই বাস্তবতা মাথায় রেখে মাঠ প্রশাসনকে কাজ করতে বলেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, শেষ বয়সে কোথাও কোথাও যেতে… একটা পাসপোর্ট দরকার। পাসপোর্ট করা হয়নি জন্মনিবন্ধন নেই বলে, জন্মনিবন্ধন লাগবে, আমার আমলে জন্মনিবন্ধন কে করত জানিও না ইত্যাদি। কিন্তু পাওয়া যায়- পয়সা দিলে ঠিকই চলে আসে; পয়সা দিলে যখন ঠিকই চলে আসে- তাহলে পয়সা না দিলেও আসার কথা।
এই সিস্টেমটা আমরা করতে পারছি না কেন? এটা তো একজন নাগরিকের অবশ্য প্রাপ্য- আমার জন্মসনদ। সরকার ব্যবস্থা করতে পারেনি, এই বলে অজুহাত দিয়ে তো চলবে না। নিশ্চয়ই ব্যবস্থা আছে- কিছু একটা করতে হবে।
তার কথায়, ওই যে বললাম যে- টাকা দিলে করে দিতে পারে, সেটা সরকার কেন পারবে না? কাজেই আমাদের সেই ব্যবস্থা করতে হবে; জন্মসনদ তার প্রাপ্য- যেকোনো সময়, যে বয়সেই চায়- তাকে দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।
নাগরিক সেবাকে কীভাবে পুরোপুরি অনলাইনভিত্তিক করা যায়, সেদিকে নজর দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে সরকারপ্রধান বলেন, ওইটা (জন্মসনদ) না হলে এনআইডি পাওয়া যাচ্ছে না, এনআইডি না হলে পাসপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে না, সব আটকে গেল- সবকিছু। আমি বলছি যে- এটা সবার একইসঙ্গে তার সমস্ত কিছু হতে হবে, যদি আমার জন্মসনদ থেকে থাকে, তাহলে আমি এনআইডি পাব।
সবকিছু ডিজিটাল হওয়ার কথা বলা হলেও প্রান্তিক পর্যায়ের চিত্র যে তা নয় সেটিই জেলা প্রশাসকদের মনে করিয়ে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, ভূমি মন্ত্রণালয় বলছে যে- আমরা সব করে ফেলছি, কিন্তু ইমপ্লিমেন্ট করতে পারছি না; ধীরে সুস্থ হচ্ছে না, কেন করছি না-এটাই হলো আমাদের অপারগতা।
একটা হলো যে ঠিক আছে- আমি করে ফেলেছি, তাদের বুঝ দেওয়া দরকার, বুঝ দিয়ে দিয়েছি- সেটা এক জিনিস। আরেকটা হলো যে- আমি কী করেছি? বুঝ দেওয়ার বাইরে যেটা আমার থেকে হোক, এখানে কারো রক্তচক্ষুর কারণে, কারো ধমকের কারণে কোনো কাজ করার প্রয়োজন নাই- অন্তত এই সময়টুকুতে; আমি নিজের মত করে যেটা আইন, যেটা দেশের জন্য করা দরকার, সেটা আমি করব; সেই কাজেই আমি ব্যস্ত থাকব- যাতে আমি করতে পারি।
নাগরিক সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) নির্দেশ দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নারী-শিশুদের রক্ষা একটি বিশেষ দায়িত্ব। আর মস্ত বড় দায়িত্ব হলো সংখ্যালঘুদের রক্ষা করা। এ বিষয়ে সারা পৃথিবী আমাদের ওপর নজর রাখে। একটা ছোট্ট ঘটনা সারা দুনিয়ায় বিশাল হয়ে যায়। সরকারের দায়িত্ব সব নাগরিকের সুরক্ষা দেওয়া। আমি সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের উদ্দেশে বলেছি, দেশের নাগরিক হিসেবে দাবি করেন। দেশের সংবিধান আপনাকে নাগরিক হিসেবে অধিকার দিয়েছে, সেটি সরকারের কাছ থেকে পেতে হবে। কাজেই সরকারের টিমকে এটার নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, সব নাগরিককে আমরা সুরক্ষা দেবো।
বাজারদর বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সমসাময়িক বিষয় যেমন- বাজারদর, এটি নিয়ে বহু কথা হয়। সেটারও একটা প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা করতে পারি। জেলায় বাজারদর, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রতিযোগিতা হতে পারে।
ডিসিদের উদ্দ্যেশে তিনি বলেন, ‘নিজের কাজ, সৃজনশীলতা প্রকাশ করার এটাই সুযোগ। গদবাধা কাজ তো আছেই। কিন্তু তারমধ্যেও ওই সৃজনশীলতা আছে। যত আইন আছে সবার মধ্যেই কাজ করা যায়। জেলার মধ্যে সময় যতটুকু হোক, সেটিকে স্মরণীয় করে রাখা। এটা একটা স্মরণীয় অধ্যায় হতে পারে, যদি আমরা করতে চাই।
ডিসি সম্মেলনকে মহাশক্তিধর সমাবেশ উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা আজ যারা এখানে বসে আছি, তারাই সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশ সরকার। এটা মহাশক্তিধর একটি সমাবেশ। আমরা যা করি, চিন্তা করি, পরিকল্পনা করি, সেটিই সরকার, সরকারের চিন্তা ভাবনা, কর্তব্য। এই মহাশক্তি নিয়ে আমরা কী কাজ করবো, কী কাজের জন্য তৈরি, সফল-বিফল, সেগুলো আজকের সমাবেশের আলোচ্য বিষয়। এখানে কাউকে স্তুতি দিয়ে সময় নষ্টের সুযোগ নেই। এই স্তুতিবাক্য পরিহারে আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিলাম, যেকোনও সভায়, স্তুতিবাক্য অগ্রহণযোগ্য জিনিস বলে আমরা গ্রহণ করবো, আমরা চালু করবো।
তিনি বলেন, সরকার গঠনের পর ছয় মাস চলে গেলো। এটা আমাদের প্রথম পর্ব বলছি, আয়োজনে যে সময় লাগে। অনেক ভুল-ভ্রান্তি হয়েছে আয়োজনের সময়। এখন সেগুলো ঠিকঠাক করে পুরো খেলার জন্য প্রস্তুত। আমাকে প্রধান অতিথি সম্বোধন করায় একটু কষ্ট পেলাম। মনে হলো এই খেলার মাঠ থেকে আমাকে বাইরে রাখা হলো। হওয়া উচিত ছিল, খেলার ক্যাপ্টেন, কিন্তু আমাকে করলেন অতিথি। আমি অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখতে চাই না, আমি ক্যাপ্টেন হিসেবে বক্তব্য রাখতে চাই।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, কাজগুলো আমাদের হাতে মাপা জিনিস। একই জিনিস ঘুরে ফিরে বারবার আসছে। আমার এমন অবস্থায় আছি শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা মস্ত বড় ইস্যু হয়ে গেলো। এটাতে আমরা কে কী পরিমাণ অগ্রসর হলাম, কী করণীয়, এক নম্বর বিবেচ্য বিষয় আইন-শৃঙ্খলা। এটাতে আমরা যেন বিফল না হই। কারণ এটাতে আমাদের অর্জন, সফল হতে পারে, বিফল হতে পারে। সেটাতে কী সমন্বয় হতে পারে তা নিয়েই আলোচনা হোক। পুলিশ প্রশাসন, সিভিল প্রশাসনের কাজ কী, সমন্বয়ের কাজ কী, কিন্তু ‘ওর কারণে এটা হয় না’ এগুলা বলে আমরা পার পাবো না। যেহেতু জেলার দায়িত্ব একজনের ওপর, তার সঙ্গে সমন্বয় করে করতে হয় সবকিছু। কাজেই সমন্বয়ে কী সমস্যা সেগুলো পরিষ্কার করে নিতে হবে, যাতে কাজ করতে গিয়ে আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে না যাই।