সরকারের চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ

1

চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা ছয় গুণ বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। ওই পর্যায়ে সক্ষমতা বাড়লে বছরে ৭ দশমিক ৮৬ মিলিয়ন কনটেইনার হ্যান্ডলিং সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। গতকাল শুক্রবার (২ মে) বিকেলে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন। প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন. ‘বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে আন্তর্জাতিক মানের কোম্পানিকে যুক্ত করার পরিকল্পনা আছে। এটা সফল হলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য জগতে পরিষ্কার বার্তা যাবে। বাংলাদেশ এখন প্রস্তুত, বিনিয়োগের জন্য খোলা।’ বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে শফিকুল আলম বলেন, ‘এখানে যে পরিমাণ বিনিয়োগ, তা দেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব নয়। এছাড়া ইফিশিয়েন্সিও একটা বড় ব্যাপার। প্রেস সচিব আরও বলেন, ‘পুরনো বাণিজ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর সবাই রপ্তানি দিয়ে ধনী হয়েছে। অথচ দক্ষিণ এশিয়া পিছিয়ে। এখন নতুন সুযোগ এসেছে। বাংলাদেশ সেই সুযোগ নিতে পারবে কি না, এটাই বড় প্রশ্ন।’। সক্ষমতা বাড়ায় সা¤প্রতিক সময়ে জাহাজ হ্যান্ডলিং এবং কনটেইনার ও খোলা পণ্য খালাসে রেকর্ড গড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত একবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে কোনো জাহাজ ও কনটেইনার জট তৈরি হয়নি। বরং জাহাজের অভাবে এখন খালি পড়ে থাকে বন্দরের জেটি। এর আগে গত বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও বিশ্বমানের সেবা নিশ্চিত করতে সম্ভাব্য বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলোচনা দ্রæত নিষ্পত্তি করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এসময় ড. ইউনূস বলেন, ‘বন্দর ব্যবস্থাপনায় এমন অপারেটরদের সম্পৃক্ত করতে হবে যাতে আমাদের পোর্টগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। আমরা যে ইনভেস্টমেন্ট হাবের কথা বলছি তা বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের বন্দরগুলোকে বিশ্বমানের করতেই হবে।’ বৈঠকে বিডা ও বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন জানান, বাংলাদেশের নৌবন্দরগুলোর বর্তমান হ্যান্ডেলিং ক্যাপাসিটি বছরে ১.৩৭ মিলিয়ন ইউনিট, যা সঠিক পরিকল্পনা ও কর্মপন্থার মাধ্যমে আগামী পাঁচ বছরে ৭.৮৬ মিলিয়ন ইউনিটে উন্নীত করা সম্ভব। তিনি জানান, বর্তমানে চালু থাকা চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বছরে ১.২৭ মিলিয়ন ইউনিট ও মোংলা বন্দর ০.১ মিলিয়ন ইউনিট হ্যান্ডেলিং করতে সক্ষম। এগুলোর সক্ষমতা যথাক্রমে ১.৫ মিলিয়ন ও ০.৬৩ মিলিয়নে উন্নীত করা সম্ভব। তিনি জানান, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল, লালদীয়া কনটেইনার টার্মিনাল, বে টার্মিনাল এবং মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ হয়ে গেলে পাঁচ মিলিয়নের বেশি ইউনিট হ্যান্ডেলিং ক্যাপাসিটি তৈরি হবে বাংলাদেশের।
বিদেশী বিনিয়োগে লালদীয়া বন্দরের কাজ দ্রæত শেষ করার ক্ষেত্রে সার্বিক অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেন। প্রধান উপদেষ্টা সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরকে সমন্বয়ের মাধ্যমে আগস্টের মধ্যে কাজ শেষ করার তাগিদ দেন। উল্লেখ্য যে, চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর এশিয়ার প্রথম এবং প্রধান প্রোতাশ্রয়, যাকে এশিয়ার প্রবেশদ্বার বলা হতো। যুগে যুগে বিদেশি পরিভ্রাজক, ধর্ম প্রচারক, বণিক সম্প্রদায় ও উপনিবেশ শাসকরা এ বন্দরকে কেন্দ্র করে তাদের আধিপত্যবাদকে সম্প্রসারণ করেছে। বিশেষ করে ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসনের গোড়া থেকে চট্টগ্রাম ছিল তাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। চট্টগ্রাম বন্দরকে তারা যেমন আধুনিক ও সক্ষমতা বৃদ্ধিও চেষ্টা করেছে, তেমনি এ বন্দও দিয়েই তারা এদেশের ধনসম্পদ লÐনে পাচার করতে মোটেই কার্পণ্য করেনি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন এ বন্দরকে পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের অস্ত্র চালান সরবরাহের কেন্দ্রে পরিনত করেছিলেন তৎকালীন হানাদার সরকার। সোয়াত জাহাজ ও অপারেশন জটপটের মত ঘটনা এর প্রমাণ। এসব ঘটনায় চট্টগ্রামবাসী তথা দেশপ্রেমিক বাংলাদেশি চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব কোন বিদেশি এজেন্সিকে দেয়ার কথা আসলেই সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায় অবস্থা। আমরা অতীতে দেখেছি প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী নিজ দলীয় সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও মামলা করতে দ্বিধা করেন নি। সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এ জাতীয় একটি উদ্যোগের কথা সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর দেশের দুই বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামি এর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়েছেন। জামায়াতে ইমলামি রীতিমত সংবাদ সম্মেরন করে চট্টগ্রাম বন্দও পরিচালনায় যেকোন বিদেশিকে দেয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে হুশিযারি করেছেন।
আমরা জানি বিষয়টি অত্যান্ত স্পর্শকাতর। সরকার দেশে বিদেশি বিনোয়োগকে উৎসাহিত করতে মূলত বন্দরকে আরো কার্যকর ও সক্ষম করে তোলার উপর জোর দিচ্ছে। এটিই আসলে বাস্তব। তবে এ বাস্তবতা সরলররেখায় উপলব্ধি করলে ভুল হবে বলে আমরা মনে করি। বন্দরের কইন্টেইনার হ্যান্ডিলিং বিষয়টি অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটিকে অনেকটা আধুনিক করা হয়েছে। একানে যেন জট না হয়, দ্রæত কন্টেইনার হ্যান্ডলিং সম্পন্ন হয়, সেই দিকে নজর রেখে যদি এ অংশটি বিদেশী কোন কোম্পানি দ্বারা পরিচালনা করা হয়, তাতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। এক্ষেত্রে গতকাল প্রধান উপদেষ্ঠার প্রেস সচিব সংবাদ কর্মীদের কাছে বিষয়টি ষ্পষ্ট করছেন বলে আমাদের ধারণা। আমরা আশা করি, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা যত বাড়বে এ দেশে বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ তত বাড়বে। তবে আমরা মনে করি, সাবধানতার কিল্প নেই।