সরকারকে অস্থিতিশীল পরিবেশ দমনে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে

2

দেশে একটি গণতাণন্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিজ্ঞা। দেশবাসির চাওয়াও একই রকম। দীর্ঘ ষোল বছর ধরে একটি সরকার দেশকে চরম ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করার পর কোটা সংস্কার তথা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতায় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। বিগত ষোল বছরে রাজনৈতিক দল হতে শুরুকরে কোন পেশাজীবী সংগঠন এবং ধর্মীয় সংগঠনসমূহ দাবি আদায়ের লক্ষে কোন রকম আন্দোলন সংগ্রামের অধিকার পায়নি। দীর্ঘ ১৬ বছরের জমে থাকা দাবি নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন , পেশাজীবী ও ধর্মীয় সংগঠন যৌক্তিক অযৌক্তিক দাবি তোলে অন্তর্বতী সরকারকে অস্থিতিশীল করতে উঠে পড়ে লেগেছে। এমতাবস্থায় জরুরি সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচন দেয়ার লক্ষে সরকার আন্দোলন অযৌক্তিক সংগ্রামের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছে। মাঠ ঠেকাতেই গলদঘর্ম নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বর্তী সরকার। প্রতিদিনই কোনও না কোনও অস্থির পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে সরকারকে। রাজপথের আন্দোলন সংগ্রাম নিরসনে হিমশিম খেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। অবশ্য কৌশলগত কারণে সরকার সংঘাত-সংঘর্ষ মোকাবিলায় ‘নমনীয় নীতিতে’ চললেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হার্ডলাইনে যাওয়ার কথা ভাবছে। সরকার ছাত্রদের বিষয়ে নমনীয় অবস্থানে থাকার ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করলেও অস্থিরতা সৃষ্টির পেছনে কারও ইন্ধন থাকলে কঠোর হস্তে দমনের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের তিন দিনের মাথায় ৮ আগস্ট নোবেল শান্তি বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠিত হয়। সরকার গঠনের সপ্তাহখানেক পর থেকেই নানান দাবিতে একের পর এক বিক্ষোভ-আন্দোলন এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ঘেরাওয়ের ঘটনা দেখা গেছে। আন্দোলনকারীরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা প্রাঙ্গণে অবস্থানসহ সচিবালয়ের মতো সুরক্ষিত স্থাপনায়ও ঢুকে পড়ে। পরে সরকার বাধ্য হয়ে যমুনা ও সচিবালয় প্রাঙ্গণে ১৪৪ জারি করে। তবে, আন্দোলন কখনোই পুরোপুরি থামানো যায়নি। কখনও আনসার, কখনও প্যাডেলচালিত রিকশাচালক, কখনও ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক, কখনও গার্মেন্ট শ্রমিক, পার্বত্য এলাকার ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠি, কখনও শিক্ষক-চিকিৎসক-নার্স, কখনও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের চাকরিজীবী, কখনও পল্লী বিদ্যুতের কর্মচারী, শিক্ষার্থী-নাট্যকর্মীসহ পেশাজীবীরা, আবার কখনও চাকরিতে বয়স বৃদ্ধির দাবিতে রাস্তায় নেমে পড়েছেন ছাত্ররা। নানা দাবিকে ঘিরে কমবেশি প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে খন্ড খন্ড আন্দোলন। এ অবস্থায় সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে অন্য দিনগুলোতে আন্দোলন যেন রুটিনে পরিণত হয়েছে। কখনও কখনও ছুটির দিনেও রাজপথে নেমেছেন তারা।
সরকারের সাড়ে তিন মাসের বেশি মেয়াদে অঙ্গীভূত আনসার, পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি-বাঙালি, সাত কলেজের শিক্ষার্থী, সোহরাওয়ার্দী, কবি নজরুল ও মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজসহ পুরান ঢাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টানা কয়েকদিনের আন্দোলন থামাতে খুবই বেগ পেতে হয়েছে। এসব আন্দোলন ঘিরে কখনও কখনও রাজপথ রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। রাজধানিতে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। সরকারকে সবশেষ বড় আন্দোলনের মুখে পড়তে হয়েছে সম্মিলিত সনাতন জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও পুন্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের সূত্র ধরে। রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় ইসকনের বহিষ্কৃত নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে ২৫ নভেম্বর ঢাকায় গ্রেপ্তার করার খবর প্রচারের পরপরই ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিবাদ মিছিল শুরু হয়। পরদিন চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণেও ব্যাপক হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওইদিন আদালত প্রাঙ্গণে একজন আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এদিকে চিন্ময় কৃষ্ণকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র দফতর বিবৃতি দেয়। অবশ্য বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে তার পাল্টা জবাবও দেওয়া হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, সরকার যে সংস্কার কাজগুলো হাতে নিয়েছে, সেটা সত্যিই খুবই জরুরি। মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের মাধ্যমে সরকার একটি জায়গায় রেখে যেতে পারলে পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার সেটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারবে। সংস্কারগুলো হলে রাজনৈতিক সরকার চাইলেও আগের মতো ফ্যাসিস্ট হতে পারবে না। দেশের জনগণের সহায়তায় সরকার যে সংস্কার উদ্যোগ নিয়েছে, সেটা বাস্তবায়ন সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞদের মত। গত ২৫ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্র্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, দেশে পরিকল্পিতভাবে একটা অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। বিগত সরকার নানাভাবে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এই ইন্ধনের পেছনে কারা জড়িত তদন্ত করা হচ্ছে। যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভবিষ্যতে আর এ ধরনের ঘটনা সহ্য করা হবে না বলে মত প্রকাশ করেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ তাদের দাবি নিয়ে যে মাঠে আসছেন, তা মোকাবিলায় সরকারকে সেই অর্থে কোনও বেগ পেতে হচ্ছে না এবং তাদের এই কর্মসূচি সরকারের চলমান সংস্কার কার্যক্রমে কোনও বাধা সৃষ্টি করছে না।’ আলোচনা করে সরকার ইতোমধ্যে অনেক সমস্যার সমাধান করেছে জানিয়ে শফিকুল আলম বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে কথা বলার পরে কিন্তু তারা আবার ফিরে যাচ্ছে। তারা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করলেও সরকার সহনশীল আচরণ করছে। অতীতের সরকারের মতো রাবার বুলেট, টিয়ারশেল ছুড়ে আন্দোলন দমন করা হচ্ছে না। আমরা এখনও আহŸান জানাই, কোনও দাবি থাকলে সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা বা দফতরের সঙ্গে আলোচনা করুন। তিনি বলেন, ‘চলমান এই আন্দোলন সংগ্রাম সরকারের সংস্কার কাজে মেজর কোনও ইম্প্যাক্ট ফেলছে না। স্বাভাবিক গতিতে সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে চলছে।’ এমতাবস্থায় সরকার জনগণের স্বার্থে ,দেশের স্বার্থে যে কোন অস্থিতিশীল পরিবেশ দমনে এগিয়ে আসবে এমন ধারণা বিশ্লেষকদের।