সম্প্রসারই জীবন, সঙ্কোচনই মৃত্যু

1

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

এক ব্যক্তি লাইফ জেকেট পরে ট্রলারে উঠে। আর কারো নিকট লাইফ জেকেট নেই। ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে ট্রলারটি ডুবে যায়। যে ব্যক্তি লাইফ জেকেট পরে সে আগেই মারা যায়। কারণ সবাই বাঁচার জন্য তাকেই চেপে ধরে ছিল। বুঝতে হবে সমাজে আপনি একা বাঁচতে চাইলে বাঁচতে পারবেননা। সবার কথা চিন্তা করতে হবে। সমাজে একা ভালো থাকা যায় না। সবাই ভালো থাকলে আপনিও ভালো থাকবেন। সমাজ ভালো থাকলে আপনার সন্তানরা ভালো থাকবে। আমরা নিজকে নিয়ে ভাবলে হবে না। নিজের রুটি রুজি ভাত কাপড়ের কথা চিন্তা করলে হবে না, তার বাইরে বিশাল জগৎ আছে তা নিয়েও ভাবতে হবে। ভাবতে হবে মাতৃভূমির কথা। অনেকে বলেন, দেশ আমাকে কী দিয়েছে ? দেশ আমাদের ছায়া মায়া, ফল, ফুল, দিয়েছে। বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা, সুন্দর পরিবেশ দিয়েছে। যে রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন হাঁটছি, স্কুলে যাচ্ছি, বাজারে যাচ্ছি, হাটে মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছি এসব কে দিয়েছে ? যে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া লেখা করছি সেটি কার ? আমার শিক্ষার জন্য আমি কয় টাকা বিনিয়োগ করছি, আর রাষ্ট্র কত টাকা বিয়োগ করছে, সে হিসেব কেউ করে দেখেছে। হাসপাতাল ব্যাংক বীমাসহ রাষ্ট্র আমাদের জন্য কত কিছু দিয়েছে তার হিসেব আমাদের নেই। কখনো চিন্তাই করিনি আমরা রাষ্ট্রকে কী দিলাম।
মানুষের জন্য যারা কিছু করেন তাদেরকে আমরা বলি ঘরের খেয়ে বনের, মোষ তাড়াচ্ছেন। নিজের খেয়ে নিজের পরে যারা দেশের জন্য কিছু করেছেন তাদের কারণেই দেশ আজ এতদূর এগিয়ে এসেছে। মেধাবীর সংখ্যা বাড়ালে হবে না, এই ধরনের দেশপ্রেমিকের সংখ্যা বাড়ানোর শিক্ষাই মনুষ্যত্বের শিক্ষা। এই শিক্ষার বিকল্প নেই।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, আমি আমার জন্য বাঁচবো না, মানুষের জন্য বাঁচবো। একটা জাতির নিকট এধরনের মানুষের সংখ্যা যত বেশি হতে সেই জাতি তত বেশি অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাবে।
সফলতা মানে নিজের কতটুকু উন্নতি হলো তা নয়, সফলতা মাঝে অন্যকে সফল করা। আমি কত মানুষের উপকার করলাম, কত মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করলাম, কত মানুষের জীবনকে সার্থক করলাম সফলতা তার উপর নির্ভর করে।
মানব জাতিকে বাঁচানোর জন্য যে মানুষগুলো নানা ধরনের টিকা আবিস্কার করছেন, জটিল রোগের ঔষধ আবিস্কার করেছেন, মানুষের কল্যাণে বিজ্ঞানের অনেক কিছু যাঁরা আবিস্কার করেছেন, তাদের কথা আমরা মনে রাখতে পারিনি। তাদেরকে আমাদের সন্তানরা চিনে না। নামও জানে না। তাঁদের এসব আবিস্কার ধনকুবের হওয়ার জন্য করেনি। কিন্তু আমাদের সন্তানরা দুনিয়ার সেরা সেরা ধনকুবের, লুটেরা, সন্ত্রাসীদের নাম জানে। আলোকিতদের চিনে না, কিন্তু আলোচিতদের চিনে। অর্থ আর স্বার্থের দুনিয়ায়, ভোগ নয়, উপভোগের দুনিয়ায় সবাই যেন পণ্য। পৃথিবীর জন্য প্রয়োজন ছিল বড় মানুষ, কিন্তু পৃথিবী পেল প্রচুর বড় লোক।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দ.) ইরশাদ করেছেন, ‘মহামানবতার সেবায় যিনি নিজের জীবনকে নিঃশেষে বিলিয়ে দেন তিনি ‘মহামানব’। এখন আমরা মহামানব খুঁজি না, পরোপকারী মানুষ খুঁজি। তাও পাওয়া কঠিন। উপকার না করুক, ক্ষতি করে না, এমন মানুষ হলেও চলে কিন্তু তারও সংখ্যা কম। এমন মানুষ সমাজে দেখি যারা নিজেই মানুষের কোন কল্যাণ করে না, অথচ অনেক কল্যাণকামী মানুষের সমালোচনা করে বলে, লোক দেখানো উপকার বা দান করছে। আমাদের দৃষ্টিতে এই ধরনের সমালোচনাকারীদের চেয়ে লোক দেখানো উপকার বা দান অনেক উত্তম। লোক দেখানো কল্যাণে পুণ্য না হোক, মানুষের কল্যাণ তো হয়। যে কোন ভাবেই মানুষের উপকার হলে চলে।
পুণ্যের কাজ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা উচিৎ। তাতে ইহকাল পরকালের কল্যাণ বয়ে আছে। মানুষের মৃত্যুর পর সুন্দর চেহরা নিয়ে কেউ আলোচনা করে না, পুণ্য কর্ম নিয়ে আলোচনা করে। সুন্দর চেহারা সারাজীবন সুন্দর থাকে না, সুন্দর ও কল্যাণময় কর্মই অজয় অমর অক্ষর অব্যয় হয়ে থাকে।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘সম্প্রসারই জীবন, সঙ্কোচনই মৃত্যু’। আপনার জীবন যদি দেশ জাতির জন্য হয় তাহলে আপনার বেঁচে থাকার অর্থ আছে। আর যদি আপনার জীবন শুধু নিজের জন্য হয়, আপনি যদি আত্মকেন্দ্রীক হন তাহলে আপনি মরে গেলে কোন সমস্যা নেই। জীবনকে অর্থবহ করতে মানুষের জন্য কিছু করে যেতে হয়। মরলে সম্পদ খাবে লোকে আর দেহ খাবে পোঁকে। মৃত্যুর পর মাল ওয়ারিশের, রুহ আজরাইলের, গোস্তা পোকা মাকড়ের, হাড় মাটির আর আমলই হবে শুধু নিজের। এটি হলো মৃত্যুর পর ভাগ বন্টন।
সেক্সপিয়র বলেছেন, তিনটি জিনিসের প্রতি মানুষের প্রচন্ড আকর্ষণ। যা অনন্তকাল থাকবে। সৌন্দর্য্য, ক্ষমতা আর অর্থ। এখন ক্ষমতা চায়, নেতা হতে চায়, কিন্তু মানুষের কল্যাণ করতে চায় না। কল্যাণ না করে নেতার অভিনয় করা যায় কিন্তু প্রকৃত নেতা হওয়া যায় না। প্রতারকরাই বলে, নেতা হতে হলে আগে অভিনেতা হও। ধরুন সড়ক দুর্ঘটনায় রাস্তায় কিছু মানুষ আহত হয়ে পড়ে রইল। সেখানে দেখবেন কেউ চুরি করছে, কেউ দেখে চলে যাচ্ছে, কেউ দাঁড়িয়ে দৃশ্য দেখছে আর কেউ আহতদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। আপনি যদি আহতদের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন তাহলে আপনি নেতা হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।
নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘নেতা হওয়ার উদ্দেশ্যে নয়, জনকল্যাণ করে যাও একদিন জনগণেই তোমাকে নেতা বানাবে।’। দুনিয়াতে বাঁচতে হলে ত্যাগ করতে হয়। ত্যাগ ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। শ্বাস নেওয়ার আগে একটা শ্বাস ত্যাগ করতে হয়। ক্ষমতা না করলে যেমন কারো হতে ক্ষমা আশা করা যায় না, তদ্রæপ ভালোবাসা না দিলে ভালোবাসা পাওয়া যায় না। সফল মানুষকে মহান আল্লাহর ভালোবাসেন। যে সকল মানুষকে আল্লাহ পাক ভালোবাসেন তাঁদের হতে মানুষের সেবা গ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্য গ্রন্থে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এই গ্রন্থের প্রথম কবিতাটি যেন মহান আল্লাহর নিকট একটি মোনাজাত বা প্রার্থনা। সে কবিতার একটি পংক্তি : ‘আমারে না যেন করি প্রচার / আমার আপন কাজে/ তোমারি ইচ্ছা কারো হে পূর্ণ/ আমার জীবন মাঝে’। অর্থাৎ হে প্রভু আমি যেন আমার কাজে নিজকে প্রচার না করি। তুমি দুনিয়ায় মহামানবতার জন্য বড় বড় কাজ করবে। যা তুমি নিজে এসে করবে না, তোমার মনোনীত মানুষ দ্বারা করাবে। আমি যেন তোমার সেই মনোনীত মানুষ হই। আমার হাতেই তোমার ইচ্ছা যেন পূর্ণ হয়। এই প্রার্থনা করি। মানুষ ভালোবাসুক আর নাই বাসুক মানবতার সেবকরাই মূল্যবান মানুষ। তাদের দাম কেউ কমাতে পারবে না। হযরত শেখ সাদী (রহ.) বলেছেন, ধূলাবালি আকাশে উড়লে তার মূল্য নেই। সোনা মাটির নিচে থাকলে অনেক মূল্যবান। তিনি আরো বলেছেন, ‘মূল্যহীন পাথরের টুকরো যদি সোনাকে থেঁতলে দিতে পারে, তবে পাথরের মূল্য বাড়ে না, সোনার মূল্য কমে না’। মূল্যবান মানুষ মূল্যবানই থাকবে। কেউ দাম কমাতে পারে না।

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক