
মোহাম্মদ আইয়ুব
আমাদের সমাজে একটি প্রচলিত ধারণা আছে-ধনী হতে হলে খুব বেশি মেধাবী হতে হয়, উচ্চ ডিগ্রি থাকতে হয়, বা বিদেশে পড়তে হয়। আবার অনেকে মনে করেন- ব্যবসায় বা কোনো কাজে বড় সম্পর্ক বা বিশেষ সুযোগ না থাকলে সফলতা আসে না। কিন্তু আমার প্রায় ২৫ বছরের প্রশিক্ষণ অভিজ্ঞতা আমাকে একটি বিষয় খুব স্পষ্ট করে দেখিয়েছে- সাফল্য ও সম্পদের ভিত্তি মেধা, ডিগ্রি, পদ-পদবী বা বংশগত প্রাপ্তি নয়; প্রধানত আচরণ, মনোভাব ও অভ্যাস। মেধা, ডিগ্রি ও সুযোগ অবশ্যই সহায়ক। কিন্তু জীবনকে সামনে এগিয়ে নেয় আচরণ। ধারাবাহিকতা তৈরি করে অভ্যাস। আর আত্মনিয়ন্ত্রণ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলে। টাকা উপার্জন সহজ; কিন্তু টাকাকে ধরে রাখা কঠিন।
বাংলাদেশে এমন অসংখ্য মানুষ আছেন- যারা জীবনে প্রচুর উপার্জন করেছেন, কিন্তু বয়সের শেষ প্রান্তে এসে আফসোস করেন – হাতে তেমন কিছু নেই, আছে আর্থিক অনিশ্চয়তা ও দুঃখ। কারণ- অর্থ উপার্জন এবং অর্থ ব্যবস্থাপনা-দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন দক্ষতা। অর্থ ব্যবস্থাপনার নিয়মগুলো খুবই সহজ- ১) আয় অনুযায়ী ব্যয় করা, ২) অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানো, ৩) নিয়মিত সঞ্চয় করা, ৪) সঠিক জায়গায় বিনিয়োগ করা কিন্তু বাস্তবে সমস্যা হয় তখন- যখন বুদ্ধির জায়গায় আবেগ কাজ করে এবং প্রয়োজনের তুলনায় চাহিদা বড় হয়ে যায়। ওয়ারেন বাফেট বলেন- ‘ধনী হতে বেশি বুদ্ধি লাগে না; লাগে ধৈর্য এবং খরচের উপর নিয়ন্ত্রণ।’
জ্যাক মা বলেন- ‘সম্পদ নির্ভর করে আপনি কত উপার্জন করেছেন তার উপর নয়; নির্ভর করে আপনি কত সঞ্চয় করেছেন তার উপর।’ একটি সাধারণ হিসাব, যার ফল অসাধারণ। ধরুন, আপনার বার্ষিক ব্যয় ৩,৫০,০০০ টাকা। শুধুমাত্র আর্থিক যথার্থতার মানদন্ড (Financial Propriety) অর্থাৎ মিতব্যয়িতা, বিচক্ষণতা এবং দূরদর্শিতা – উক্ত অর্থ ব্যয়ের সময় প্রয়োগ করলে কমপক্ষে ৭.৫% অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব। তাতে বছরে সাশ্রয় হবে- ২৬,০০০ টাকা মানে মাসে- ২,০০০ টাকার বেশি। এই ২,০০০ টাকা যদি নিয়মিত বিনিয়োগে যায়, ৩০ বছরে এর সম্ভাব্য মূল্য দাঁড়াতে পারে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা। যাদের বার্ষিক ব্যয় ৭,০০,০০০ টাকা, তাদের ক্ষেত্রে একই পদ্ধতিতে ৩০ বছরে সঞ্চিত সম্পদ ১ কোটিরও বেশি টাকা হতে পারে।
জাতীয় পর্যায়ে- যদি সরকারি ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানে আর্থিক যথার্থতা মানদন্ড নিশ্চিত করা যায়, তাহলে বার্ষিক বাজেট ব্যয় (প্রায় ৩ লক্ষ কোটি টাকা) থেকে ৫% সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। ফলে এক বছরে সাশ্রয় হবে ১৫ হাজার কোটি টাকা এবং তা বিনিয়োগের মাধ্যমে ৩০ বছরে তা বৃদ্ধি পেতে পারে ২৫ লক্ষ কোটি টাকায়। এখানে নেই কোনো জটিল হিসাব, নেই বিদেশি ডিগ্রি, নেই বড় পদ-পদবীর অহংকার-
আছে শুধু- আচরণ → সিদ্ধান্ত → অভ্যাস → ফলাফল। আচরণ বদলানোই মূল কাজ। আমরা সবাই জানি ধূমপান ক্ষতিকর, জাঙ্ক ফুড স্বাস্থ্য নষ্ট করে, এবং সবসময় দোকানের খাবার খাওয়া অপ্রয়োজনীয় খরচ। জ্ঞান আছে-অভ্যাস নেই। মানুষ জ্ঞান দিয়ে নয় – অভ্যাস দিয়ে জীবন চালায়।
আমি প্রশিক্ষণ ক্লাসে প্রায়শই বলি- ‘অর্থ ব্যবস্থাপনা শেখানো মানে শুধু হিসাব বা আর্থিক তত্ত্ব শেখানো নয়; বরং নিজের মনকে বোঝানো এবং আত্মজাগরণ শেখানো।’
রতন টাটা বলেন- ‘যে নিজের চাহিদা সীমিত করতে পারে, সে কোনোদিন অভাবে পড়ে না।’ লোভ ও ভয়Ñঅর্থ ব্যবস্থাপনার দুই বড় শত্রু বাজার বাড়লে অনেকে লোভে বিনিয়োগ করে, বাজার পড়লে ভয়ে বিক্রি করে। এটাই আবেগনির্ভর সিদ্ধান্ত- যেটি ক্ষতির সম্ভাবনা বাড়ায়।
চার্লি মাঙ্গার বলেন, ‘আবেগের বশবর্তী হয়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত ৯৯% ক্ষেত্রে ভুল হয়।’ তাই ধীরতা, শৃঙ্খলা, সংযম ও ধারাবাহিকতা-স্থায়ী সম্পদের ভিত্তি। সুস্বাস্থ্যই প্রকৃত সম্পদ অর্থ আছে কিন্তু স্বাস্থ্য নেই- তবে তাতে আনন্দ নেই, শান্তি নেই, ভবিষ্যৎ নেই। তাই খাদ্য, ঘুম, ব্যায়াম ও মানসিক প্রশান্তি- অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অপরিহার্য অংশ।
শেষ কথা ধনী হওয়া কোনো রহস্য নয়- এটি একটি শান্ত, শৃঙ্খলাপূর্ণ এবং ধারাবাহিক যাত্রা।
সম্পদ গড়ে ওঠে- চাহিদা সীমিত করার অভ্যাসে নিয়মিত সঞ্চয়ে সচেতন খরচে বিনিয়োগের ধারাবাহিকতায় এবং সবচেয়ে বড়Ñ আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মজাগরণে।
ওয়ারেন বাফেট বলেছেন- ‘ধনী সে নয় যার কাছে অনেক টাকা আছে; ধনী সে, যার চাহিদা কম।’
আর আমি বলি- ‘যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সেই সত্যিকারের ধনী।’
লেখক : আঞ্চলিক লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, চট্টগ্রাম











