সমৃদ্ধ হোক দেশের মৎস্যচাষ

3

বিশ্বের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননের নদী হালদা। নদীদূষণ অবৈধ প্রকৃতি ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে সরকারি নানা পদক্ষেপের কারণে হালদায় এবছর আশানুরূপ ডিম ছেড়েছে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাইশ ইত্যাদি কার্পজাতীয় মাছ। গত বৃহস্পতিবার (২৯ মে) ছিল অমাবস্যা তিথি’র দ্বিতীয় জো’র শেষ দিন। মধ্যরাতে প্রচন্ড বৈরী আওহাওয়ার মধ্যেই মেঘের গর্জন, বজ্রপাত, অতি ভারী বৃষ্টিতে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলের স্রোতে বিশ্বের অন্যতম জোয়ার-ভাটার মিঠাপানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র চট্টগ্রামের হালদা নদীতে ডিম ছেড়েছে রুই, কাতাল, মৃগেল ও কালিবাইশ প্রজাতির মা মাছ। প্রায় দুই মাস ধরে ডিম সংগ্রকারীদের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে বহুল প্রতীক্ষিত মা-মাছ পুরোদমে ডিম ছেড়েছে গতকাল শুক্রবার। নদীতে অপেক্ষমান ৫০০-৬০০ ডিম সংগ্রহকারী ইতোমধ্যেই মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহে নেমে পড়েছেন। যদিও এর আগে অন্তত দুই দফা নমুনা ডিম ছেড়েছিল মা মাছ। তবে তা খুবই নগন্য ছিল। গতকাল শুক্রবার বিকেল ৫ টার দিকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে মৎস্য অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্স ল্যাবরেটরি এবং বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। এবার হালদা নদীতে মা মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার কেজি।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আনুমানিক ২ টার দিকে প্রকৃতির এই বৈরি আবহাওয়ায় পুরনো ঐতিহ্যকে ধারণ করে হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার অংশে অবস্থিত হালদা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে মা-মাছ ডিম ছাড়তে শুরু করে। মা-মাছ ডিম ছাড়ার আগ মুহূর্ত থেকে নদীতে অবস্থানরত ডিম সংগ্রহকারীরা মা-মাছের ডিম ছাড়ার বিষয়টি আঁচ করতে পেরে হাঁকডাক শুরু করেন। এ সময় নদীতে অপেক্ষারত প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ ডিম সংগ্রহকারী ৩৫০-৪০০টি নৌকা, জাল ও পাতিলসহ নানা সরঞ্জাম নিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে মা মাছের নিষিদ্ধ ডিম সংগ্রহের উৎসবে মেতে উঠেন। তবে, গতকাল শুক্রবার ভোর রাতের দিকে আবহাওয়া বৈরি হওয়ায় স্বাভাবিক ডিম সংগ্রহে কিছুটা বিঘ্ন ঘটে। এরপরও এবার বিগত কয়েক বছরের মধ্যে ভালো পরিমাণ ডিম সংগ্রহ সম্ভব হবে বলে ধারণা হালদা গবেষকদের।
সরেজমিনে ঘুরে এবং ডিম সংগ্রহকারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাত আনুমানিক ২টা থেকে হালদা নদীর মদুনাঘাট ছায়ারচর থেকে রামদাস মুন্সিরহাট, আমতুয়া, নাপিতার ঘোনা, আজিমের ঘাট, মাছুয়াঘোনা, কাগতিয়া, সিপাহী ঘাট, নয়াহাট, পুরালিয়া স্লুইসগেট, কেরামতালির বাক এবং অঙ্কুরীঘোনা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা পর্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করতে পেরে অনেক ডিম সংগ্রহকারীরা খুবই খুশি। এই ডিম সংগ্রহ কার্যক্রম শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত চলে। এ সময় প্রতি নৌকায় ৩-১২ বালতি (৮-১০ লিটার পরিমাপের বালতি) পর্যন্ত মা-মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করেছেন। দেখা গেছে, প্রতি নৌকায় সর্বনিম্ন ৩/৪, সর্বোচ্চ ১০/১২ এবং গড়ে ৭/৮ বালতি ডিম সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে। যা বিগত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি বলে জানান ডিম সংগ্রহকারীরা।
হালদা রিভার রিচার্স ল্যাবরেটরির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে হালদা নদীতে মা-মাছ ডিম ছাড়েনি। তবে, তিন/চার বারের নমুনা ডিমের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬৮০ কেজি। তার আগের বছর ২০২৩ সালে সংগৃহীত ডিমের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৬৬৪ কেজি। তাছাড়া ২০২২ সালে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কেজি, ২০২১ সালে সাড়ে ৮ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছিল। ২০২০ সালে হালদা নদীতে রেকর্ড পরিমাণ ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম পাওয়া গিয়েছিল।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার বরাতে জানা যায়, নদীর পারে স্থাপিত সরকারি ও বেসরকারি হ্যাচারী এবং ট্রেডিশনাল মাটির কুয়াগুলোতে ডিম সংগ্রহকারীরা ডিমের পরিস্ফুটনে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছে। নদীতে মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নৌ-পুলিশ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি যৌথভাবে ডিম সংগ্রহের তথ্যসংগ্রহ এবং নদীর সার্বিক পরিবেশ মনিটরিং করছে। রাতভর ডিম সংগ্রহ করে সকালে ডিম সংগ্রহকারীরা সংগৃহীত নিষিক্ত ডিমগুলো হ্যাচারিতে নিয়ে আসেন। সেখানে কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক উপায় ১৮ ঘণ্টা পর ডিম থেকে রেণু হবে। তারা তিনদিন ধরে রেণুগুলোকে নার্সিং করবেন। এরপর পোনায় পরিণত হবে সেগুলো। অর্থাৎ সংগ্রহের ৯৬ ঘণ্টা পর মা মাছের ডিম বিক্রয়যোগ্য পোনায় পরিণত হবে।
অন্যদিকে, ডিম ছাড়ার পর ক্লান্ত মা মাছগুলো যাতে কেউ শিকার করতে না পারে এবং কৃত্রিম রেণু বিক্রেতারা যাতে সক্রিয় হতে না পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করেছে বলে জানান হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। তিনি বলেন, হালদাকে আগের রূপে ফেরাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
এবছর পর্যাপ্ত ডিমপ্রাপ্তি হালদা নদী রক্ষায় সমন্বিত ব্যবস্থাপনার একটি ফসল। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, মৎস্য অধিদপ্তর, নৌ-পুলিশ, পরিবেশ অধিদপ্তর, এনজিও আইডিএফ এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি সমন্বিতভাবে নিরলসভাবে কাজ করছে হালদা নদী রক্ষায়। হালদা নদী বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাপনার একটি সফল উদাহরণ। হালদায় মা মাছ ডিম ছাড়ায় দেশের পুকুর জলাশয়ে মাছের চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে এমন ধারণা বিশেষজ্ঞদের।